অনেকদিন পর নীলাকে দেখল রিফাত . সালওয়ার কামিজ পরা , রেস্টুরেন্টের এক কোনায় বসে আছে , সঙ্গে দুটো পরীর মত বাচ্চা মেয়ে . পাছে সিন ক্রিয়েট হয়ে যায় এই ভয়ে রিফাত লাঞ্চ টা কোনরকমে শেষ করে তরিঘরি করে বের হয়ে আসছিল . হঠাত পিছু ডাকলো এক কিন্নরী কন্ঠ , "এই যে শুনছেন ?" পেছনে ফিরতে বাধ্য হলো রিফাত , এই কন্ঠস্বরকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই তার . হ্যা , এত বছর পরেও সেই কন্ঠস্বর চিনতে ভুল হয়নি তার , নীলাই ডাকছে . পেছনে ফিরে রিফাত বলল
- জ্বী বলুন
: আচ্ছা আপনি কি রিফাত নেওয়াজ ?
- সে কি ! ১০ বছরে কি এতটাই বদলে গেছি যে এবার প্লে গ্রুপের বাচ্চাদের মত নামের সাথে মানুষের মিলকরণ খেলছেন ম্যাডাম নীলা ?
:না , তা নয় , ভেরিফাই করছিলাম আর কি .. চোখও তো কখনো কখনো ধোকা দেয় তাই না ?
- মনটাই যখন ধোকা দিল তখন আর চোখের দোষ কি বলো !
: তোমাকে এভাবে দেখব ভাবিনি
- তবে কিভাবে দেখবে ভেবেছিলে ? মদের বোতল হাতে তোমার শ্বশুরবাড়ির সামনে মাতাল অবস্থায় ?
: সত্যি ! তোমার হেয়ালিপনা গেল না !
- কি করব ? রং বদলাতে পারলাম না যে ! কত মানুষ চোখের সামনে বদলে গেল , মিস থেকে মিসেস হলো , টিপ চুড়ি শাড়ি থেকে ডাইরেক্ট সালওয়ার কামিজে চলে গেল , আমি সেই এক ই রয়ে গেছি ...
: বদলে যাওয়াটাই কিন্তু জীবনের ধর্ম . এই পৃথিবীটাকেই দেখো না ! সৃষ্টিলগ্নে যেমন ছিল , এখন কি তেমন আছে ?
- তোমার স্বামী তো বিজনেসম্যান , তাই না ?
: হ্যা , কেন ?
- দারুন কথা শিখেছ আজকাল . তোমার পতি পরমেশ্বর বুঝি তোমার সাহিত্যের ক্লাস নেন ? তিনি তো তবে দারুন শিক্ষক ! ফান্ডামেন্টালিজমের ক্লাস করে তোমায় যান্ত্রিক বানিয়েছেন , ম্যানার্স এর ক্লাস করে একটা চঞ্চল বর্ণিল প্রজাপতিকে সোনার খাচার পাখি বানিয়েছেন .. এবার সাহিত্য পড়িয়ে মুক্তচিন্তাকে বাক্সবন্দী করবেন ....
: এসব দু-একটা কথা বলার জন্যে সাহিত্য লাগে না . বুকের ভিতরে জমে থাকা ব্যথা চীন চীন করে উঠলেই মুখ থেকে আপনা আপনি এসব কথা বেরোয় ..
- সে কি ! আপনার বুকের ভেতরেও ব্যথা আছে তবে !
: এতদিন পর দেখা হলো , ব্যথা বেদনার কথা আজ থাক না হয় ....
- হুমম , ব্যথা বেদনা বুঝতে গেলে সমব্যথী হতে হয় আর সে জন্য বুকের ভেতর মানুষটার জন্য অফুরন্ত ভালবাসা থাকা চাই . তা সেই ভালবাসা - মন্দবাসার পাট যখন চুকেই গেছে , তখন ব্যথা বেদনা ভাগাভাগিটাও আলমারির ওপরেই তোলা থাক .. তো কেমন আছ ?
: ওই তো শ্বাস চলছে আর কি !
- তা সঙ্গের দুজন কি ...
: আমার মেয়ে . বড়জন ভিকারুন্নিসাতে ক্লাস থ্রিতে পড়ে , নাম রিনকা . আর ছোটজন রিনী, সবে চার বছর হলো তার .. ও কি ! হাসছ কেন ?
- না মানে যতদুর মনে পড়ে বাচ্চাদের বাবার নাম ফারুক . তা সত্ত্বেও 'র' আদ্যক্ষর দিয়ে নাম রেখেছ ! ধন্যি মেয়ে তুমি !
: প্রশংসা করলে নাকি তিরস্কার ?
- যা ভাবো তাই ..
: রিনী নামটার একটা তাত্পর্য আছে , বলো তো কি ?
- এটা আমার দেওয়া নাম . তুমি তো জানি , আমার আবার মেয়ের বড় শখ .. ভেবেছিলাম একটা মেয়ে হলে এই নামটা রাখব . রিফাত আর নীলা - দুয়ে মিলে রিনী ... তা সে সব তো হলো না , ছোট মেয়েটার তবে এই নাম রাখলে কেন ?
: ও যখন জন্মালো , তখন মনে হলো মেয়েটা বোধ হয় তোমারই .. একই রং , একই চুল , একই চাহুনি ..
- বাব্বাহ !! বকাবকি আর ঝগড়ার অন্তরালে এত কিছু খেয়াল করলে কখন ?
: না গো . আজকাল দেখছি সে সত্যিই তোমার মতই হেয়ালি করে কথা বলে ..
- আহ , নীলা চুপ কর তো ! লোকে শুনলে তোমার এই সতী সাবিত্রী ইমেজে দাগ লেগে যাবে ! .... আচ্ছা মনে আছে তোমার , সেই যে চিঠি লিখতাম আমি ?
: হুমম , রিনী নামটাও তো চিঠিতেই লিখেছিলে ..
- জানো প্রথম যেই চিঠিটা দিয়েছিলাম তোমায় , সেটা প্রিটেস্ট এর খাতার কাগজে লিখেছিলাম . অংক পরীক্ষার হলে বসে ..
: হ্যা জানি , রাতের অন্ধকারে যখন বারান্দায় ডেকে চিঠিটা দিয়েছিলে হাতে তখন কাচুমাচু গলায় বলেছিলে ' প্লীজ চিঠিটা সিরিয়াসলি নিও . আমি আজকে পরীক্ষা না দিয়ে তোমার জন্যে চিঠি লিখেছি !'
- আমি শুরু থেকে শেষ অব্দি তোমাকে মোট ৩৫৬ টা চিঠি লিখেছি .. সেগুলোর কয়েকটাও কি আছে তোমার কাছে ?
: কেন ? নতুন প্রেমিকা জুটেছে বুঝি ? তাকে আবার নতুন করে চিঠি লিখতে পারবে না , তাই জন্যে পুরনো চিঠি চাইছ ?
- আগে বলো না কটা চিঠি আছে তোমার কাছে ?
: একটাও নেই ... বিয়ের দিনই পুড়িয়ে দিয়েছি ... কি দরকার নতুন জীবনে পুরনো আবর্জনা টেনে আনার !
- আবর্জনা ! ভালই বলেছ !
: তা এবার তোমার খবর বলো ...
- খবর ! ...মমম.. ভালই আছি .. ইউএস আর্মির চাকরি , মাস শেষে মোটা মাইনে , উপরওয়ালার সুনজর সবই পেয়েছি . এখন তো কোনো বার কিংবা পাবে গেলে চাকরি শুনলে মেয়েরা হামলে পড়ে ...
: আচ্ছা আমার সেই নীল ওরনাটা কিন্তু তুমি দিলে না !
- সরি , কোন ওরনা ?
: সেই যে একবার শাড়ি পরতে বলেছিলে কিন্তু আমি সালওয়ার কামিজ পড়ে এসেছিলাম সেই জন্য রাগ করে যে ওরনা টা রেখে দিয়েছিলে ?
- ও .. আ'ম সরি .. জানো তো , হারিয়ে ফেলেছি ... তোমার বিয়ের কদিন আগেই ... বোঝোই তো , আর্মির লাগেজ , জায়গা কোথায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর !!!
: বাহ ভালই আঘাত করে কথা বলা শিখেছ ..
- তোমার কাছ থেকেই তো শেখা ...
এমন সময় পেছন থেকে মা বলে দুটি কচিকন্ঠ ভেসে এলো . কিন্তু মায়ের সাথে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে দেখে থমকে দাড়ালো ওরা . বিষয়টা রিফাতের চোখ এড়ালো না . আদর করে বাচ্চাদুটোর গাল টেনে দিল সে . পকেটে দুটো বড় বড় ক্যাডবেরি ছিল , ধরিয়ে দিল বাচ্চাগুলোর হাতে . তারপর এটা সেটা , ছড়া শোনা , গান শোনা . সব শেষে চলে আসার আগে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলল ' বাহ তোমরা দুজনই যে মায়ের রূপ পেয়েছ গো কন্যেদ্বয় ! তবে .. কখনো কাউকে কষ্ট দিও না , কারোর অশ্রুর কারণ হয়েওনা তোমরা .. ' তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে বলল ' পারলে শাড়ি পরো কখনো সখনো .. ভালো লাগে তোমাকে ওভাবে ..' বাস এইটুকু বলে আর দাড়ালো না সেখানে . পার্কিং এ গিয়ে প্রিয় স্করপিওন গাড়িটা স্টার্ট দিল ও .. দুরন্ত বেগে গাড়িটা ছুটে চলল ঢাকার রাস্তায় . শুধু রেস্টুরেন্টে নির্বাক চলচ্চিত্রের মত ঠায় দাড়িয়ে রইলো নীলা ..
পর সমাচার ১
সন্ধ্যা ৭ টা . সবে বাংলাদেশ আর্মি কোয়ার্টার এ ফিরেছে রিফাত . একটা সিক্রেট মিশনে ইউএস আর্মি থেকে দেশে এসেছে সে . খুব তারাতারি কাজ শেষ করে ইউএস এ ফিরতে হবে ওকে . আজ সারাদিন তাই কাজের মধ্ধেই ছিল , হয়ত রাতেও তাই করতে হবে . বিছানায় বসে ব্যাগ থেকে একটা ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করলো সে . সেই ছোট্ট প্যাকেটে সযত্নে রাখা নীলার নীল ওরনা . ওরনাটা বের করে তার গন্ধ নিল রিফাত . ইশশশ , এত্ত বছর পরেও ওড়নায় নীলার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া যায় ! প্রত্যেকদিনই সে এভাবে এই ওড়নার ঘ্রাণ নিয়ে আসছে , যখন নীলা ছিল তখন , নীলা চলে যাবার পর ও .. তবুও আজ নীলা কে মিথ্যে বলল কেন সে ? " থাক না , সব সত্যি কথা জানিয়ে লাভ কি ! আমাকে ভুলে ও যখন সুখে আছে , তখন এসব জানিয়ে ওর জীবনে বিঘ্ন ঘটানোর কোনো মানেই হয়না !" ভাবলো রিফাত . হঠাত ফোন এলো , আজ রাতে জরুরি অপারেশন এর ডাক পড়েছে . শেষবারের মত ওড়নার গন্ধ নিয়ে আবার আগের মত করে গুছিয়ে রাখল সেটা . তারপর চটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল সে . হেলিপ্যাড এ হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে . হেলিকপ্টারে ওঠার আগ মুহুর্তে পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করলো . সেখানে সযত্নে রাখা নীলার ছবিতে আবেগী চুম্বনের পর আবেগী আলিঙ্গন . তারপর উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে . হেলিকপ্টার টা যখন মধ্য আকাশে উড়ছে প্রবল শব্দে , তখন নিচে হেলিপ্যাডে অধ:স্তন এক আর্মি অন্য এক আর্মি কে নিচু গলায় বলল " রিফাত স্যার বলেন অনার সব সক্তি সাহস নাকি ওই ওয়ালেটে বন্দী . কিন্তু বিষয়টা আজ বুঝলাম না !"
পর সমাচার ২
রাত ১১ টা . দুই কন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে নীলা সবে একটু সুস্থির হয়ে বসেছে . স্বামী ফেরেনি এখনো . আলমারি খুলে একটা কারুকার্য খচিত কাঠের বাক্স বের করলো নীলা . এই বাক্স বোঝাই রিফাতের আবেগ ভরা ৩৫৬ টা চিঠিতে . সেই প্রথম টা থেকে শেষ অব্দি . একদম প্রথম চিঠিত থেকে পরা শুরু করলো ও . রোজই পরে . তবুও আজ মিথ্যে বলল রিফাতকে . " রিফাতের কন্ঠ থেকে আমার জন্যে শুধু ঘৃনা আর শ্লেষ ঝরে পড়েছে আজকে . তাতে কি ! আমাকে ঘৃনা করে যদি ও সুখী হয় তবে তাই সই ! চিঠির কথা বলে আর মায়া বাড়ানোর দরকার কি ! ওকে তো সুখী করতে পারলাম না এই জীবনে , এভাবে না হয় একটু সুখ পাক ছেলেটা ! " একটা একটা করে যখন রিফাতের বিদায়ী চিঠিটা পড়ল নীলা , তখন নিজের অজান্তেই বুক চিরে বেরিয়ে গেল একটা দীর্ঘ শ্বাস . ঝড়ো বাতাস বইছে এখন বাইরে . অমনি আলমারিতে বাক্সখানা তুলে রেখে একটা শাড়ি বের করলো সে .. আজ শাড়ি পরবে ও , আজই তো রিফাত বলেছে এই কথা !! তারপর .. ভিজবে বৃষ্টিতে , যেভাবে রিফাতের সাথে ভিজতো ...
ঠিক একই সময়ে ঝোপের আড়ালে বসে শত্রুর অপেক্ষা করতে করতে রিফাতের চোখেও সেই একসাথে বৃষ্টি তে ভেজার স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাক .