সকাল সাড়ে ৮টা । নিরালা আবাসিক এলাকার ৩ নম্বর রোডের ১৬০ নম্বর বাড়ির দোতলায় তখন ব্যাপক হুড়োহুড়ি । রোজকার মতন রাজিয়া বেগম তার ৭ বছরের ছেলে তপুর পেছনে দুধের গ্লাস হাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন । ছেলেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ভাই কে দিয়ে স্প্রিন্টের ট্রেনিং করানোর ফল এবার ভালোমত বুঝছেন তিনি । হরিণের মত লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াচ্ছে যেন ।শেষ পর্যন্ত ছেলের স্কুল ড্রেসের কলার পেছন থেকে ধরে ছেলেটাকে থামালেন । অমনি তপুর লাফালাফি শুরু হল রোজকার মত।" আম্মু আমার দুধ ভাল্লাগে না .... প্লিজ আজকে না ... আম্মু কালকে ঠিক ঠিক খাব. আম্মু প্লিজ আজকে ছেড়ে দাও ।" ছেলেকে কখনোই বকেন না রাজিয়া বেগম , কৌশলে সামলান তিনি । এবার দৌড়াদৌড়ি ছেড়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন তিনি । শান্ত গলায় বললেন, "আচ্ছা , খাস না । আমারই আসলে বোঝা উচিত ছিল যে আমার ছেলে চিরকাল টুশির পিছনেই থাকতে চায় , টুশির চেয়ে ব্রিলিয়ান্ট , টুশির চেয়ে বুদ্ধিমান হতে চায় না । কি আর করা ! আচ্ছা খাওয়া লাগবে না , থাকুক ।" তপু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো । এরপর সুবোধ বালকের মত দুধের গ্লাসটা পুরো ফাকা করে মাকে বলল " মা , দেখো আমিই এখন থেকে ফাস্ট হব । সেজন্য রোজ দুধ খাওয়া লাগলে তাও করব ।" লক্ষ্মী ছেলে " , বিজয়ীর হাসি হাসলেন রাজিয়া বেগম ।
ঠিক একই সময়ে একই এলাকার ৪ নম্বর রোডের ১৯৩ নম্বর বাড়িটার ৩ তলার খাটে ভারি চশমা চোখে " ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়া "বলে একটা বই পড়ছিল টুশি । মিসেস শারমিন তার চুলে বেণী করতে করতে বললেন " মামণী , আজকে তো রেজাল্ট ডিক্লেয়ারেশন ডে । ভয় লাগছে নাকি ?"নির্বিকার মুখে টুশি বলল " হুহ ! ভয় কিসের ? আমিই তো ফার্স্ট হব । তপু কখনোই আমাকে হারাতে পারবে না মাম্মি । তুমি ভেবো না । " মেয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে একই সাথে ভীষণ মুগ্ধ ও গর্বিত অনুভব করেন শারমিন ।
যখনের কথা বলছি তখন ঘড়িতে ১০ টা বাজে । সাড়ে ৮ টা থেকে ১০ টা , এই দেড় ঘন্টা কি হল তা আর বিস্তারিত না-ই বললাম । ১০টার সময় স্কুল বিল্ডিং এর সিড়িতে বসে কেদেই চলেছে টুশি । এত্ত মিষ্টি একটা মেয়ের অনবরত চলতে থাকা কান্না থামানোর জন্য প্রত্যেকেই কিছু না কিছু একটা বলে সান্ত্বনা দেয়ার চেস্টা করছে । কান্নার তোড় থামা শুরু করল যখন কিছু কিছু , ঠিক তখনই তপু পুরো ক্লাসে ফাস্ট হওয়ার মেডেল টা টুশির চোখের সামনে দুলিয়ে দুলিয়ে বলল "গত বছর তোর , এই বছর আমার । ১-১ । কিন্তু এখন থেকে আমার টাই বাড়বে ... বুঝছিস ।" এই বলে তপু নিজের মেডেল টা নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গেলেও ঐ জায়গা থেকে টুসিকে সরাতে তার মায়ের কি পরিমাণ তেল মালিশ করা লেগেছিল , সেটা বলাই বাহুল্য । এরপর ... ভাগ্যিস তপুকে বেদম পেটানোর জন্য টুশির পরিকল্পনাটাও টুশির মা বুঝে ফেলেছিলেন, নাহলে কি যে হত !!!!
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে সেই ঘটনার পর । অনেক কিছুই বদলে গেছে যেমন তপু বেশ লম্বা হয়ে গেছে , টুশির চশমার পাওয়ার আরো একটু বেড়েছে । কিন্তু কিছু জিনিস একই রকম রয়ে গেছে । যেমন টুশি আর তপুর প্রতিযোগীতা .. আরেকটু উন্নতি হয়েছে । আগে শুধু পড়াশোনা নিয়ে ছিল , এখন সব কিছু নিয়েই শুরু হয়েছে !! এই ক'বছরে মেডেলের হিসেব টা দাড়িয়েছে ৫-৪ , টুশির একটা বেশি । এই বিষয়টা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না তপু । কিন্তু ঐ একরত্তি মেয়েটা যে ২ সপ্তাহ আগে ইনডোর স্পোর্টস টুর্নামেন্টে দাবায় তাকে ১৪ চালে কিস্তমাত করল !!!! এই বিষয়টা একদম মানতে পারছে না তপু । ২ সপ্তাহ ধরেই মনে এ নিয়ে ভীষণ অশান্তি তার । যাই হোক , টেস্ট পরীক্ষাটা কষে দিয়েই এর যুতসই বদলা নেয়া লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে হলে ঢুকল তপু ।
প্রত্যেক পরীক্ষায় যেমন হয় , তেমনি আজো টুশির ঝাল ঝাল কথা শোনার জন্য এবং টুশিকেও কিছু ফোড়ন দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল ও । কিন্তু একি! মহারানী নিজেই তো আসেনি এখনো ! " যাই হোক , ভালোই হয়েছে , ডাইনীটার মুখটা অন্তত আজ দেখা লাগবে না !!! " ভাবল তপু ।
প্রত্যেক ভাল ছাত্রেরই কিছু চ্যালা থাকে । এই যেমন টুশির চ্যালা মিনি । প্রথম পরীক্ষাটা টুশি দিতে পারেনি , তাই কিছুটা চিন্তিত এবং অনেকটা খুশি হয়েই রাতে মিনি ফোন করলো টুশিকে । (চলুন আড়িপাতা যাক)
: হ্যালো টুশি ?
- হুম মিনি বল্ ।
: দোস্ত তুই আজকে পরীক্ষা দিতে আসলি না ?
-হ , আসমু না !! ১০৪ ডিগ্রি জৃর নিয়া পরীক্ষা দিতে আমি ! টাইফয়েড নিয়ে পরীক্ষা দেয়া তো খুব সোজা কাজ !!
: না , তা না ... দোস্ত তপু তো মনে হয় কোপায়ে পরীক্ষা দিতেসে , ১ ঘন্টার মাথায় হল থেকে বের হয়ে গেছে আজকে !
- যা গিয়া ওর কোলে উইঠা বইসা থাক ! আমি মরি আমার জ্বালায় আর এই বিবিসি আমার কাছে দুনিয়ার খবর মারাইতেসে !!
এই বলে খট করে ফোনটা রেখে দিল টুশি । খুব জ্বর তার , সারা শরীর ব্যাথা ... কিন্তু ... তপু কি করে ১ ঘন্টায় অঙ্ক পরীক্ষা শেষ করলো সেটা ভেবেই পাচ্ছে না টুশি ।
আজকের রাতের জ্যোৎস্নাটা বেশ সুন্দর , যদিও সেটা টুশির জীবনে কোনো প্রভাব ফেলছে না । টেস্ট পরীক্ষা শুরুর দিন তার অবস্থা যেমন ছিল এখনো তেমনি । অনেক চেস্টা করে রাতে সে যখন একটু চোখ বুজেছে , তখনি খেয়াল হল বাইরে থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে তাকে ডাকছে । ভূত-প্রেতে ভয় নেই টুশির , তাই দূর্বল হাতে মাথার কাছের জানালাটা খুললো সে । কিন্তু একি !!!! তপু জানালায় কেন !!! দেয়ালঘড়িতে তখন আড়াইটা । মাঝরাতে ! তপু ! তার বাসার জানালায় ! মেজাজ টা গরম হয়ে গেল টুশির । নাক মুখ খিচিয়ে বললো -
: তুই এত রাতে আমার জানালায় কি করিস ! লজ্জা করে না ? অসভ্য ইতর জানোয়ার !
- আ লো আমার লজ্জাবতী এসেছেন রে ! শোন্ , আমি আসছি একটা কাজে , কেউ জানে না । কিন্তু তুই চিল্লাচিল্লি করলে সবাই এসে পড়বে এবং কালার আমি একা হবো না । বুঝছিস !!
: এত্ত রাতে কি জন্য আসছিস ? ফোড়ন দিতে না ? আমি পরীক্ষা দেই না ঐ জন্য খোচাইতে আসছিস ??
- তোর সমস্যা কী ? তুই ক বললে কলম্বো কুয়ালালামপুর সব ঘুরে কলকাতা বুঝিস ক্যান ! আরে কুমড়ামুখী , তোরে যে খোচা দিব , আমি তো নিজেই পরীক্ষা দেই না !
: তোর মাথায় বাজ পড়ুক হারামি ! কত্ত মিথ্যা বলিস ! সবাই বলল যে তুই অঙ্ক পরীক্ষা কোপায়ে দিসিস ! ১ ঘন্টায় বলে হল থেকে বের হয়ে গেসিস !
- তো হবো না ! ৪০ এর এ্যান্সার করতে কতক্ষণ লাগে ?
: (অবাক হয়ে) তুই ফুল এ্যান্সার করিস নাই ? ক্যান ?
- আরে এইটা কইতেই তো রাত বিরেতে পাইপ বাইলাম ! তুই তো বলতেই দিচ্ছিস না !
:আচ্ছা বল ।
- শোন , তুই তো আমার মেইন রাইভাল । তো তুই পরীক্ষা দিচ্ছিস না তাই একপেশে ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে হয় নি । আমিও দেই না এখন ।
: দয়া করতেসিস আমারে তাই না ???
- তুই কি উল্টা জন্মাইসিলি ? সব উল্টা বুঝিস ক্যান ?
; তো তুই সোজা টা বল !
- আসলে ... তুই আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী । আমি মরে গেলেও তোকে বন্ধু ভাবতে পারব না , তোকে বন্ধু বানাতেও পারব না ... কিন্তু মানে ... আমি না তোকে খুব ঐটা করি ।
: কোনটা করিস ?
- ধুর টিউবলাইট ! ...বাদ দে ...
আচ্ছা শোন্ , আমার সাথে অল্প অল্প প্রেম করবি ???
এইটুকু বলেই তপু তরতর করে পাইপ বেয়ে নেমে কয়েক সেকেন্ডেই অদৃশ্য ! জানালাটা বন্ধ করতে করতে টুশি মনে মনে তখন ভাবছে " এত্ত তামাশা করে আসলি , এত্ত আজাইরা কথা বললি , একটা 'হ্যাঁ" শুনে যেতে কি দোষ ছিল ! তার আগেই বীর পুরুষ দৌড় দিলেন ! হুঁহ ! সাধে তোকে গাধার বাচ্চা বলি !!!!"