একদল মানুষ থাকেন, যাঁরা সবকালেই শাস্ত্রাচারের বাইরে মানব মুক্তি ও ঈশ্বরলাভের পথ খোঁজেন। তাঁরা ধর্মকে নেন হৃদয়ে সহজ, সত্যের মত, জাতকূল সম্প্রদায় ইত্যাদিকে দূরে রেখে। বাউল কবি লালন শাহ্ও সেই একদল মানুষের সমকালের একজন।
লালন শাহের জন্ম নিয়ে, ধর্ম কিংবা জাত নিয়ে যে মত ভিন্নতা তা লালনকে পুরোপুরি রহস্যময় করে তুলেছে। তিনি শরা নাকি ধরা, আস্তিক নাকি নাস্তিক, মুসলমান কি হিন্দু এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হলেও এর মীমাংসা সূত্র আবিষ্কার হয়নি। যখন তিনি নিজেই বলেন:
সব লোকে কয়, লালন কি জাত সংসারে...
সব লোকের এ কৌতূহল তিনি মেটাননি। বরং মানুষের জাতহীনতার কথা বলেন:
মানুষের কি হয় জাতের বিচার?
মূলত, তত্ত্বের আড়ালে লালন যে দ্রোহের আগুন জ্বেলেছিলেন, তা তমসাচ্ছন্ন সমকালকে আলোকিত করে উত্তরকালকেও আলোকিত করেছে। লালনের প্রতিবাদ ছিল বর্ণপ্রথা, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা আর শাস্ত্রীয় শাসন-নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে।
লালন ফকির শুধুমাত্র একজন বাউল ছিলেন না-একজন বাউলের চেয়েও অধিক কিছু ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মতাশালী কবি। তাঁর কাব্যবোধ ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তাঁর এই অনন্য-সাধারণত্ব অর্জন হয়েছিল মানুষের সাধনায়। ধর্ম বা জাতিগত ব্যাপারে শুধু নয়, নর-নারীর সম্পর্কেও তাঁর উদার মনোভাব দৃষ্টিগ্রাহ্য:
মিঞা ভাই কী কথা শুনাইলেন ভারী
হবে নাকি কেয়ামতে আযাব ভারী
নর-নারী ভেস্ত মাঝার
পাবে কি সমান অধিকার
নরে পাবে হুরের বদলা
বদলা কি তার পাবে নারী।
এখানেই লালন চন্ডীদাসের চেয়েও মানবতাবাদী হয়ে উঠেন। বলা যায় তাঁর মানবতা বোধ অনেক বেশি বিশিষ্ট এবং কংক্রীট। এমনকি লালন ফকির নারী অধিকার নিয়ে ধর্মগ্রন্থকেও চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখান। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধই তাঁকে এ সাহস যুগিয়েছে। মানুষের মধ্যে জাতিভেদ করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। লালন বলেন:
লালন কয় জাতির বিচার গিয়াছি ভুলে।
এমনকি জাতি বিভাজনের চিন্তাও তিনি করেননি-
লালন কয়, জাতির কি রূপ দেখলাম না নজরে।
লালন শাহ্ একাধারে সাধক, গীতিকার, সুরকার। তাঁর সাধনা ছিল সমন্বয়ের সাধনা। সমন্বয়ের মধ্যে সিদ্ধি অর্জনে তিনি বিশ্বাস করতেন। সীমাবদ্ধ সাম্প্রদায়িক ধর্মের লালন মুক্তির পথ খুঁজেছেন।
রাম কি রহিম
মাটি কি পবন জল হুতাশন
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মুখ দেখে কেউ বলেন।
প্রকৃত অর্থেই লালনের গানে যেভাবে মানব মহিমা ও ধর্ম সমন্বয়ের ব্যাপারে কীর্তিত তা যুগদুর্লভ অনন্য উদাহরণ। তিনি বলেন:
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।
শ্রেণী, বর্ণ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি সামাজিক ও মানবিক সমস্যার উৎস। এ সম্পর্কে লালন বলেন:
ধর্ম প্রভূ জগন্নাথ
চায়নারে সে জাত অজাত
ভক্তির অধীন সে।
লালন শাহ এক উদার অভিনব শাস্ত্রবিহীন মানব ধর্মের প্রতিপোষক। লালন তাই জাত ধর্মের অচলায়তনের দূর্গে তীব্র আঘাত হানেন:
জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পুড়াতাম আগুন দিয়ে।
লালন শাহ সম্প্রদায় পরিচয়ের উৎসে আঘাত হানেন। জাতবিচারী দূরাচারীকে ধিক্কার দিয়ে ঘোষণা করেন:
লালন সে জাতের ফাতা,
বিকিয়েছে সাত বাজারে।
মানব জন্মের গৌরব ও গুরুত্ব লালনের গানে অনবদ্যভাবে ধরা পড়ে। ‘মানষ তত্ত্ব ভজনের সার।’ শাস্ত্র শাসিত সমাজে লালন বলেন:
পড়গে নামাজ জেনে শুনে
নিয়েত বাঁধগে মানুষ মক্কাপানে।
তখন এই বাণীর মানবিকরূপ ধরা পড়ে। তিনি বলেন:
এমন মানব জনম কি আর হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।
ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কিত লালনের কয়েকটি গান এখানে উদ্ধৃত করবো, যা থেকে তাঁর ধর্ম বিশ্বাসে উদারতা প্রকাশ পায়:
১. রাসুল চিনলে খোদা চেনা যায়।
২. যেই মুর্শিদ সেই তো রাসুল, তাহাতে নাই কোন ভুল।
৩. রাধার তুলনা প্রেম যদি কেউ সামান্য করে
মরে বা না মরে সে তো অবশ্য যায় ছারেখারে।
লালন শাহ স্রষ্টা ও সৃষ্টি, আত্মা ও পরমাত্মাকে একই সূত্রে গাঁথেন বলেই প্রেমময় সত্তাকে মনের মানুষ, সখের মানুষ, মানুষ রতন ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করেন-
এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন।
সমকালীন মানুষ যখন তাঁর জাত নিয়ে দোলাচলে দোলায়মান তখন লালন বলেন:
সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।
বস্তুত লালন শাহ এককভাবে না সাধক, না তাত্ত্বিক, না বাউল। তিনি ধর্ম প্রচারক নন, সংস্কারকও নন। শুধু তিনি বাংলা লোকজীবনে বিভিন্ন ধর্ম সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে তিনি এও বলেছেন-
ধর্মা ধর্ম বলিতে কিছু নাই তাতে
প্রেমের গুন গায়।
সর্বোপরি লালন শাহ বিশ্বাস করতেন:
সকল মানবের অভেদাত্মা ...