হাফিজ গোধূলি দেখছে।অস্ত যাওয়ার আর শুরু হওয়ার সময়টাকেই তো গোধূলি বলে?
হাফিজ মাত্র চাকুরী শুরু করেছে তখন।টাকা পয়সা রোজগার শুরু।এর আগে যা করত দিনে এনে দিনে খাওয়ার মত।একদিন কি এক অসুস্থতার জন্য তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে।হাসপাতাল থেকে জানতে পারে তার বাবার ব্লাড ক্যন্সার। এমন অবস্থা যে হয়তো তিনি বেঁচে ফিরবেন ।হাফিজ বাবার চিকিৎসায় কোন কমতি রাখল না।বেশ কয়েকটা কেমোথেরাপি দেয়ার পর হাফিজেরর বাবা চলে যান না ফেরার দেশে।এই কয়েকমাসে হাফিজেরর খরচ হলো কয়েক লাখ টাকা।সদ্য চাকুরী শুরু করা একজনের কাছে কয়েক লাখ টাকা অনেক কিছু।এর মধ্যে বেশিরভাগই ঋণ।টাকা নিয়ে হাফিজ এর চিন্তা নাই।বাবা তো একজনই।হাফিজ চিন্তা করে একদিন তার অনেক টাকা হবে কিন্তু তার বাবা থাকবে না।কোন লাভ আছে?
হাফিজ বাবার লাশটা কবরে নামানোর সময় পর্যন্ত এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলল না।বাবা বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতিটা রাতেই হাফিজ চোখের পানি ফেলত।শেষ কিছুদিন আই সি ইউর গেটে বসে প্রায় প্রতিরাতেই তার চোখের জল কোন বাঁধা মানত না।বাবার কষ্ট দেখে সন্তানের চোখে যে জল আসে সে জলে বাঁধ দেয়ার ক্ষমতা কারো নাই।সে জল তীর খোঁজে।তীরে এসে আছড়ে পড়ার আগে তার শেষ নাই।
হাফিজের জীবনে এই তীর ছিল তার অনাগত সন্তান।বাবা আর স্ত্রীকে নিয়ে হাফিজ হাসপাতালকেই নিজের আপন ঘর বানিয়ে ফেলেছিল।বাবার শেষ কেমোটা যে হাসপাতালে ছিল ঠিক সেই হাসপাতালেই তার সন্তান ভূমিষ্ট হয়।এক রুমে তার সন্তানের আগমনী কান্নাকাটির সুর অন্যরুমে তার বাবার নীরব প্রস্থানের প্রস্তুতি।হাফিজ একটা জিনিস লক্ষ্য করল আগমণ আর প্রস্থান দুটো জায়গায়ই কান্না একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে প্রস্থানের কান্নাকাটির কোন সুর থাকে না । প্রস্থানে থাকে অনেক হিসাব নিকাশ আর দেন দরবার।অবশ্য সব নিজের সাথেই ।আপনি একজন মানুষ খুঁজে পাবেন না যিনি চিৎকার করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে গেছেন না ফেরার দেশে ।
এই চোখের পানিই দুইটা ভিন্ন মানুষের চোখে ভিন্নভাবে প্রবাহিত হচ্ছে হাফিজের মাঝে।তবে একটা জায়গায় দুইজন বাবা প্রায় একই।একজন হাফিজ , অন্যজন হাফিজের বাবা।হাফিজ যেমন তার সন্তানকে দেখলেই সব কিছু ভুলে যায়।তেমনি ধীরে ধীরে প্রস্থানের প্রস্তুতি নেয়া হাফিজের বাবা তাকে দেখলেই সব ভুলে যান।তিনি ভাবেন তার পাশে তার সন্তান আছে।তার হাফিজ আছে। যদিও তিনি জানেন না তিনি এখন এই পৃথিবীর কাছে বোঝা কিংবা আবর্জনা ।তার প্রস্থানের জন্যই সম্ভবত আগমন হয়ে গেছে আরেকজনের ।
"এসেছে নতুন শিশু, তাকে
ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর
ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
.................................
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন
শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।"
ইতিহাস হতে চলছেন হাফিজের বাবা।এই নতুন শিশুর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবেন তাকে ।তিনি ঠিক একদিন পরই জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন।
হাফিজ সে সময় একবার তার বাবার কেবিনে যেত, একবার যেত তার সন্তানের কেবিনে।সে দেখছে সুখ আর দুঃখ কখনো সমান্তরালে চলছে না । যদি সমান্তরালে চলে তবে সেখানে সুখের কোন পাত্তা থাকছে না । দুঃখ তার আধিপত্য বজায় রেখে চলছে। দুঃখ জয়ী।
হাফিজ গোধূলি দেখছে আর এসব ভাবছে ।সে এমন একটা পৃথিবী চায় যেখানে কোন রাত নাই ,কোন দিন নাই ।সেখানে শুধু গোধূলি থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৪