somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘালয় রাজ্য ঘুরে এসে........!!!

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বহুদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড হিসেবে পরিচিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং এবং পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের স্থান চেরাপুঞ্জি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরে দেখার। কিন্তু সময়ের সাথে বোঝাপড়া আর হয়ে ওঠে না। আমার অফিস থেকে ছুটি পাই না। আবার ছুটি পাই কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলের পরীক্ষা। আবার পরীক্ষা শেষ অফিসের ছুটিও পাইছি কিন্তু বাচ্চা একটার টনসিল ফুলে গেছে কিংবা বউয়ের পক্স উঠে বিছানায় পড়ে গেছে৷
এর মধ্য ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার চিন্তা আছে। এসব মিলিয়ে একবার ধরেই নিয়েছিলাম এবারের ভিসাটা বরবাদ হয়ে যাবে। জার্নি এ্যাভেইল করা মনে হয় এবার হবে না। আর আমার চেরাপুঞ্জি ও দেখা হবে না।

ওদিকে জুলাই মাস চলে। দেশব্যাপী তুমুল অস্থিরতা চলমান। ১৪৪ ধারা জারি। কারফিউ চলছে শহরে। মোড়ে মোড়ে জলপাই রংয়ের পোশাক পড়া মেলেটারির টহল গাড়ী। সরকার খালি ঘনঘন সরকারি ছুটি ঘোষণা করছে। বাসায় বসে বসে কতক্ষণ থাকা যায়। কিছুক্ষন পর পর খালি ক্ষুধা লাগে। বউয়ের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম হুট করে না গেলে আর যাওয়া হবে না। তাছাড়া সামনে হয়তো সরকার আর আন্দোলনকারীদের উত্তেজনার পারদ আরো বাড়তে পারে। তার চাইতে এখনি উপযুক্ত সময় ঘুরে আসার জন্য।

অফিস থেকে তিন দিন ছুটি নিয়ে নিলাম শুক্র শনিবার জরিয়ে। মোট পাঁচ দিনের মধ্যেই ঘুরে আসতে পারবো।
জুলাইয়ের পঁচিশ তারিখে রাত দশটার সময় রওনা হলাম স্বপরিবারে। তিনটা বাচ্চা আর আমরা দুজন, মোট পাঁচজন। কমলাপুর যাবো সিএনজি নিলাম। পথে হাইকোর্টের সামনে আটকায়া দিলো একটা মিলিটারির গাড়ী। জিগাইলো- কই যান এই রাইতে পোলাপান নিয়া? কইলাম ইন্ডিয়া যামু, এই দেহেন টিকিট আর পাসপোর্ট। বিরস মুখে কইলো আচ্ছা।

আমি ছাপোষা মানুষ। সারা বছর ধরে একটু আধটু করে টাকা জমিয়ে বছরে এক বার এদিক সেদিক ঘুরতে যাই। কমলাপুর আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি সপ্তায় একটা এসি বাস ছাড়ে। ওই বাসটা সরাসরি শিলংয়ে যায়। আমি চারটা টিকিট কাটছিলাম। কেননা ছোটটার জন্য টিকিট কাটলে পকেট থেকে আরো সাড়ে চার হাজার টাকা শেষ।

যাই হোক, রওনা দিলাম রাত দশটার সময়। কমলাপুর থেকে। ঢাকা থেকে বের হতে হতেই দেখি দেড় ঘন্টা নাই। ঐ দিন ডেমরা রোডে ব্যাপক জ্যাম ছিল। বাসে উঠার পর আবিস্কার করলাম এই বাসে আগামীকাল কাল পর্যন্ত কেমনে থাকমু। আমার সিট পড়েছে শেষ লাইনের দুই সিট আগে। খুব ঝাকি লাগতেছে আর এসির উইন্ডোটা খটখট করে বিকট আওয়াজ করতেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। সুপারভাইজারকে রিকোয়েস্ট করলাম সিট পাল্টায়া দেওয়া যায় কিনা? কিন্তু কে সাইধা ঝাড়ের বাঁশ ঘাড়ে নেবে?

এরপর যখন চোখে একটু ঝিমানি লাগতেছে এ সময় দেখি বাসের স্টার্ট বন্ধ। আশুগঞ্জের উজান-ভাটি রেস্টুরেন্টে গাড়ি থামছে। সুপারভাইজার বলতেছে যাত্রা বিরতি নিবো পনেরো মিনিট। সবাই প্রাকৃতিক কর্ম সাইরা লন আর হালকা পাতলা কিছু খাইলেও খাইতে পারেন।
ভোর ছয়টায় সিলেটের হরিপুরের একটা পেট্রোল পাম্পে আবার গাড়ি থামল। সেখানে সবাই নেমে হাতমুখ ধুয়ে প্রায় বিশ মিনিট পর বাস ফুয়েল নিয়ে আবার চলতে শুরু করছে। সকাল সাড়ে সাতটার সময় আমরা আমাবিল বর্ডারে পৌছালাম। পোলাপান কয- বাবা খিদা লাগছে। তামাবিল বর্ডারে আসলে দুইটা ছাপরা টাইপে রেস্টুরেন্ট আছে দেখলাম।


এই বর্ডার দিয়ে মূলত কয়লা আর পাথরের ট্রাক আসা-যাওয়া করে তাই অধিকাংশ সময়ে বাস ট্রাকের শ্রমিকরা কম পয়শায় এসব ছাপরা টাইপের রেস্টুরেন্টে খায়। তবুও বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে। আমরা পরোটা ডাল ভাজি, ডিম ভাজি অর্ডার করলাম। খাবার তেমন একটা ভালো না। আমাদের বাস সকালে সিলেট শহরে থামায়নি। আপনারা যারা আসবেন তারা শহরে গাড়ি থামিয়ে নাস্তা সেরে তারপরে বর্ডারে আসাই ভালো।


খাবার পনেরো মিনিট পর আবারো বড় ছেলেটা গলগল করে বমি করা শুরু করছে। বাস ভ্রমণে তার এই এক সমস্যা। পলিথিন সবসময় আমার বউয়ের ভ্যানিটি ব্যাগে থাকে। বাস যাত্রায় তারে যতই ভালো কোম্পানির বমির ট্যাবলেট খাওয়াই সব ফেল। আর প্রতিবার বমির পর পোলাডা কটমট করে আমার দিকে তাকায়। তার প্রিয় জার্নি হলো ট্রেন। ট্রেনে তার বমি আসে না।

মেঘালয় যারা ঘুরতে যাবেন অবশ্যই ভিসায় ডাউকি বর্ডার এন্ডোর্স করে নিয়ে আসতে হবে অর্থাৎ ভিসায় ডাউকি বর্ডার উল্লেখ থাকতে হবে। ট্রাভেল ট্যাক্স পাঁচশো টাকা জনপ্রতি লাগছে। বর্ডারে অগ্রণী ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে সেখানে ট্রাভেল ট্যাক্স দেওয়া যায়। সময় বাঁচাতে চাইলে আসার আগেই অনলাইনে অথবা অফলাইনে ট্রাভেল ট্যাক্স পরিশোধ করে আসতে পারেন। বর্ডার সাড়ে আটটার আগে ওপেন হয় না।

দুই পাশে ইমিগ্রেশন শেষ করতে প্রায় এক দেড় ঘন্টা সময় লাগছে। তবে মানুষের চাপ বেশি হলে সময় আরো বেশি লাগে। আমাদের বাস ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করে ডাউকি বাজার এসে দাঁড়ালো। সুপারভাইজার বলল- এখান থেকে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিতে। ডাউকি বাজারে কয়েকটা দোকান আছে টাকা বদল করে নেবার। তার মধ্যে বৌদির দোকান ভাইরাল। আমি পাঁচ হাজার টাকা টাকার বদল করে রুপি নিয়েছিলাম। ঐ দিন সত্তুর টাকা করে রেট পেয়েছিলাম। তবে ঢাকায় রেট ভালো পাওয়া যায়। আমি ঢাকা থেকে ৭২ টাকা রেটে রুপি নিয়েছিলাম সাথে পাসপোর্টে ক্রেডিট কার্ড এন্ডোস করে নিয়ে গিয়েছিলাম।

আমাদের বাস ডাউকি থেকে সরাসরি শিলং চলে যাবে। ডাউকি থেকে নিজেদের মতো করে সারাদিন বিভিন্ন স্পট ঘুরেও সন্ধ্যায় শিলং পৌছানো যায়। ডাউকি বাজারে প্রাইভেট, মাইক্রো কিংবা টুরিস্ট বাস সবই পাওয়া যায়।
আমাদের সাথে আরো তিন চারটা ফ্যামিলি ছিলো। মোট প্রায় বারো তোরো জন। সবাই মিলে একটা টুরিস্ট বাস নিয়ে নিলাম। টুরিস্ট বাসটা সারাদিন বিভিন্ন স্পট ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় আমাদের শিলংয়ের পুলিশ বাজারে পৌঁছে দেবে।

ডাউকি বাজার থেকে ডাউকি ব্রিজ পার হয়ে দশ মিনিট পরই গাড়ী থামলো। সবাই বাস থেকে নামলো।
উমক্রেম ফলসঃ রাস্তার পাশেই এই ঝর্ণাটির অবস্থান। পাথর ছুঁয়ে কলকল শব্দে পানি পড়ার দৃশ্য দেখে বাচ্চারা খুবই এক্সাইটেড। একদম ছবির মত সুন্দর। উমক্রেম ঝরনার সামনে ১৫ মিনিট কাটিয়ে সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ী ছাড়ায় ২০ মিনিট পর আবার একটি ঝর্ণার দেখা পেলাম তার নাম-


বোরহিল ফলসঃ এই ঝর্ণাটি উমক্রেম ঝরনার চাইতেও বিশাল। বোরহিল ফলসের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। এই ঝর্ণাটার পানিই নিচের দিকে নেমে গিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যে যায়গাটা আমাদের কাছে বিছানাকান্দি নামে পরিচিত। বোরহিল ফলসের সামনে প্রায় আধঘন্টা কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। তারপর আরো আধঘন্টা পর পৌছালাম



লিভিংরুট ব্রিজঃ লিভিংরুট ব্রিজ মূলত পাহাড়ি একটা ছড়ার উপরে দুই দিক থেকে একটি অশ্বথ গাছের জীবিত শিকড় দিয়ে এপার ওপারের মধ্যে ব্রিজ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। পর্যটকরা এটার উপর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। আমরা লিভিংরুট ব্রিজের নিচের ছড়ায় বাচ্চাদের নিয়ে গোসল করলাম। অনেক মজা পেয়েছে বাচ্চারা কারণ বাসের মধ্যে গরম লাগছিলো। আধঘন্টা ওখানে আমরা ঠান্ডা পানিতে গোসল করলাম। গোসল শেষে আশপাশ ঘুরে দেখলাম, ছবি তুললাম। বাচ্চাদের এক্সাইটমেন্ট ছিলো আসলে দেখার মত আমি তাতেই খুশি।

প্রায় এক ঘন্টা উচু-নিচু সর্পিল পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এশিয়ার সবচাইতে ক্লিনেষ্ট ভিলেজ মাওলিনংয়ে। ডিসকভার ইন্ডিয়া নামের আন্তর্জাতিক ট্রাভেল ম্যাগাজিনে ২০০৩ সালে এশিয়ার সবচাইতে পরিস্কার গ্রাম হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে শুনলাম গ্রমাটি। দুপুরের খাবারটা মাওলিনংয়ে সারলাম সবাই। ধবধবে সাদা চিকন চালের ভাতের সাথে রুই মাছ ফ্রাই, শবজি ভাজি আর ডাল দিয়ে খুব তৃপ্তি সহকারে খেলাম। খাবার পর মাওলিনং ভিলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কয়েকটা দোকান আছে আশেপাশে। পাহাড়িদের হাতে বোনা শাল-টুপি-মাফলার এবং বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি করছে দোকানগুলোতে। তবে দাম খুব চড়া। মাওলিনংয়ের শুধু রাস্তাঘাটই পরিষ্কার মনে হয়েছে আর কিছু অতো পরিষ্কার মনে হয়নি। বউ বাচ্চারা ছবি তোলায় ব্যস্তছিলো। বাঁশের মাচা বা টং টাইপের কিছু ঘরবাড়ি দেখলাম। সবার বাড়ির সামনেই দারুন সব ফুলের গাছ আছে। খাসিয়াদের মুলত মেয়ে প্রধান সমাজ ব্যাবস্থা। তাই খাসিয়া মেয়েরাই দোকানপাট বা রেস্টুরেন্ট সবকিছুই পরিচালনা করে দেখলাম।



মাওলিনং থেকে ফের গাড়ীতে চড়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য সোজা শিলং শহর। প্রায় একশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। শরীরেও ক্লান্তি অনুভব করছিলাম।তাই চোখে একটা ঘুমঘুম ভাব চলে এসেছেিলো। এই পথটুকু যেতে যেতে পাহাড়ি রাস্তার দুইপাশে যে নৈসর্গিক মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেছি তা আসলেই মনে রাখার মত। পথের কয়েক জায়গায় থামলাম। চারপাশে পাহাড় আর পাহাড় মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় থরে থরে সাজানো মেঘমালা দেখতে দেখতেই শরীরের ক্লান্তি আসলে আর থাকেনা। সাদা পাথরের একটা বিরাট পাহাড় দেখলাম। বেকু মেশিন দিয়ে মানে এস্কাবেটর দিয়ে প্রায় অর্ধেক পাহার কেটে নিয়ে গেছে।। এখনো দেখলাম পাহাড় কাটা চলমান।

যখন শিলং শহরে প্রবেশ করেছি তখন শহরের প্রবেশের মুখে প্রচন্ড ট্র্যাফিক জ্যাম পেলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে সন্ধ্যার শিলং শহর দেখছি মুগ্ধ হয়ে। এপাড়ের পাহাড়ে দাড়িয়ে দেখছি ওপারে অজস্র বাতি শিলং শহরে জলছে। শহরের অজস্র বাতি দেখে মনে হবে নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।


ট্রাফিক জ্যামের জন্য বিরক্ত লাগা শুরু করেছে অলরেডি। পুলিশ বাজার যখন পৌছালাম তখন রাত নয়টা। শহরের অধিকাংশ দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। আমার আগে থেকে হোটেল বুকিং করা ছিল তাই সোজা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। শিলং এর পুলিশ বাজার এলাকায় অনেক রকম আবাসিক হোটেল আছে। বাজেট হোটেল থেকে শুরু করে দামি হোটেল সবই। আমি আগে থেকেই হোটেলে রুম বুকিং দিয়ে রাখছিলাম ডাবল বেডের। একটা বড় বেড আর একটা ছোট বেড। রাতের খাবারে তেমন কারো আগ্রহ নাই। বাচ্চারা বেডে শুয়েই গভীর ঘুমে। আমার হালকা খুদা লাগছিলো। একটু ফ্রেশ হয়ে আমি বাইরে গেলাম। একটা রেষ্টুরেন্টে ভাত খেয়ে বৌয়ের জন্য পার্সেল করে একটা খাবার নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখানে সকালের নাস্তার ব্যাবস্থাও ছিলো। লাল আটার রুটি, শবজি, ডাল আর দুধ চা।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলি- শিলং শহরে বাজার এলাকায় যতবার ঘুরেছি রাস্তার পাশে অনেক মাংসের দোকান দেখেছি। কোন কোন দোকানে দেখলাম শুকরের মাংশ এবং গরুর মাংস মুরগীর মাংশ সবই বিক্রি করছে। শিলংয়ে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি তবে মেক্সিমাম মানুষই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বি মনে হল। গির্জা দেখেছি কিছুক্ষণ পর পর। পাহাড়ের টিলায় টিলায় সিমেট্রি চোখে পড়েছে। শিলংয়ে প্রচুর রেষ্টুরেন্ট আছে যেখানে পর্ক, গরু, মুরগী সব ধরনের রান্না হয়। তাই যারা হালাল রেষ্টুরেন্ট খোঁজেন তাদের জন্য পুলিশ বাজারে দুটো মুসলিম রেস্তরা আছে দেখলাম। আমি ওখানেই খেয়েছি যে কয়দিন ছিলাম। রান্না মোটামুটি ভালোই, দামও রিজনেবল।

পরের দিন সেন্টার পয়েন্ট থেকে সারাদিন ঘোরার জন্য ট্যাক্সি নিলাম। ভাড়া সারাদিন তিন হাজার রুপি। ওই দিনের গন্তব্য ছিল চেরাপুঞ্জি। আাসা যাওয়ার পথে কয়েকটা ভিউ পয়েন্টের সাইট সিয়িং করে স্পট দেখব যেমনঃ এলিফ্যান্ট ফলস, নোহকালিকাই ফলস, সেভেন সিস্টার ফলস, ইকোপার্ক।



প্রথমেই গেলাম এলিফ্যান্ট ফলসে বা হাতি ঝর্ণা দেখতে। ঝর্ণাটি রাস্তা থেকে অনেক নিচে নেমে গেছে। আমরা সিড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামলাম। এই ঝর্ণার মেইন পয়েন্টটা দেখতে নাকি হাতির শুরের মতো দেখাতো এক সময় তাই এই ঝর্ণার নাম হাতি ঝর্ণা। তবে আমি কোথাও হাতির মতো কোনো কিছুর আকৃতি প্রকৃতির সাথে মিল খুঁজে পাইনি। সব ঝর্নার কলরব প্রায় একই রকম মনে হয়েছে। কোনটার হয়তো বেশি শব্দ কোনটার কম। পানি প্রবাহের গতির জন্য হয়তো।

হাতি ঝর্ণা দেখে পৌছলাম নোহকালিকাই ফলসে। এটা মুলত একটা জলপ্রপাত। চেরাপুঞ্জির সব ঝর্ণা থেকে ব্যতিক্রম এটা। মেঘালয় ঘুরতে গেলে প্রায় সব পর্যটক স্পর্টটি ভিজিট করে থাকেন। ১১২০ ফুট উচ্চতা থেকে জলপ্রপাত হয়। ইন্ডিয়ার উঁচু জলপ্রপাত গুলোর মধ্যে নোহকালি কাই অন্যতম। নোহকালি কাই অর্থ "কালিকাইয়ের লাফ"। কালিকাই নামের এক মহিলার নাম অনুসারে জলপ্রপাতের নামকরন। ইচ্ছা করছিল নোহকালিকাই ফলসের এখানেই থেকে যাই আরেকটা দিন। যতগুলি স্পট এই টুরে ঘুরেছি তার মধ্যে এই জায়গাটা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই স্পটেই দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। বৌয়ের সাফ কথা সে কোনভাবেই কোন রকম মাংস খাবেনা শিলং-চেরাপুঞ্জি যতদিন থাকবে। শুকরের মাংশের দোকান দেখার পর তার নাকি খেতে বসলেই চোখের সামনে শুকর ভেসে উঠছে। সুতরাং ভাত সবজি, মাছ, ডিম, ডাল দুপুরের লাঞ্চের লাঞ্চ সারতে হলো।



খাবার সেরে করে ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম গন্তব্য সেভেন সিস্টার ফলসঃ এটি ভারতের চতুর্থ বৃহৎ ঝর্ণা। সবুজ পাহাড়ের মধ্য থেকে ছোট-বড় অনেক গুলো সাদা রংয়ের ঝর্ণা ধারার দৃশ্য দেখলে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। তবে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের কারণে এবং আবহাওয়া জনিত কারণে ভিউ পয়েন্ট থেকে সবসময় এই ঝরনার দেখা পাওয়া যায়না। ওয়েদার ভালো হলে দেখতে পাবেন। আমি যেদিন গিয়েছি ঝকঝকে রোদ পেয়েছি। পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করেছি সেই মায়াবী সৌন্দর্য। ভিউ পয়েন্টের পাশে বাচ্চাদের কিছু রাইড আছে যেমন দোলনা, স্লাইডার এসব। বড় ছেলেটা দোলনা থেকে পড়ে গিয়ে হাতের কনুইয়ের কাছ অনেকটা চামড়া উঠে গেছে। সে বিরাট চিৎকার করে কাঁদছে। সাথে কোন মলম টলমও নাই, কি করি। পানি দিয়ে ধুয়ে দিলাম বালু। তার কান্না থামছেই না। এক ভদ্রমহিলার কাছে ভ্যাসলিন পাওয়া গেলো৷ সেটা মাখিয়ে দিলাম। তাতেও কাজ হচ্ছে না। কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলছে- জলতেছে কেনো? ভ্যসালিন তুলে দাও। তার পর এখানে দেড় ঘন্টা থাকার পর আবার গিয়ে ট্যাক্সিতে বসলাম। গন্তব্য চেরাপুঞ্জি ইকোপার্কঃ ইকো পার্কে গিয়ে ছেলের কান্না থামলো।



ইকো পার্কে ঘন্টাখানেক ছিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় পার্ক। বাচ্চাদের জন্য কিছু রাইড আছে। এবার বড় ছেলে আর কোন রাইডেই চড়বে না। তার বাকি দুই ভাই-বোন মনের সুখে সবরাইডে চড়ছে দেখে সে আবার কান্না স্টার্ট করলো।
এই ভিউ পয়েন্ট থেকে দাঁড়িয়ে সিলেট সুনামগঞ্জের সমতল ভূমির একটা এরিয়াল ভিউ পাওয়া যায়। এক কথায় অনবদ্য সময় কাটানো জায়গা। ঐ দিনের ঘোরাঘুরি ওখানেই শেষ করে ফিরতি পথে রওনা দিলাম এবং রাত আটটা বাজলো হোটেলে পৌঁছাতে।



চতুর্থ দিনের ঘোরাঘুরির প্লান একটু শর্ট করতে হলো। বেলা তিনটা পর্যন্ত ঘুরবো। আজকের তালিকায় আছে লাইটলুম কেনিয়ন, মদিনা মসজিদ আর আর ওয়ার্ডস লেক। খুব ভোরে উঠে শহরের চারপাশে হেটে হেটে মর্নিং ওয়াক সেরে হোটেলে ফিরলাম ঘন্টাখানেক বাদে। হোটেলে ফিরে ফৃরেশ হয়ে নাস্তা সারলাম তারপর সারে নয়টার দিকে ট্যাক্সিতে উঠলাম গন্তব্য লাইটলুমঃ শিলং থেকে লাইটলুমের দুরত্ব ২২ কিলোমিটার। লাইট লুম যাবার পথে দুইটা অসাধারন ভিউ পয়েন্ট পেলাম। একটা ভিউ পয়েন্টের নাম....... ট্যাক্সি থামিয়ে আধঘন্টা সময় কাটালাম একেবারে ছবির মতো সুন্দর। মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায় এসব যায়গায় এসে দাড়ালে। পুনরায় গাড়ি চলা শুরু করলো লাইটলুমের উদ্দেশ্যে। কিছু দুর যাওয়ার পর শুরু হলো ঘন মেঘের সারি। অতি নিকটেরও সামনের কিছু দেখা যায় না। গাড়ি হেডলাইট জালিয়ে চলছে খুব ধীর গতিতে। তারপর একটা সময় পৌছে গেলাম লাইটলুমে।

কিন্তু কপাল খারাপ। এতো মেঘ এসে জমা হয়েছে এই ভিউ পয়েন্টে যে আশপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে এতো ঘন মেঘের মধ্যে এতো দির্ঘ সময় আর কখনো থাকিনি। তবুও অনেক আনন্দ পেয়েছি। সিড়ি ধরে আনেক নিচে নামার পরও দেখি মেঘ আর মেঘ।
লাইটলুম থেকে ফিরে চলে আসলাম মদিনা মসজিদ দেখতে। শিলংয়ে এতো সুন্দর একটা নান্দনিক মসজিদ আছে তা ধারনার বাইরে ছিলো। চারতলা উচু ভবন চারদিকের দেয়াল সব কাঁচের। দারুন স্থাপত্য শৈলি মসজিদের। আমি অযু করে দুই রাকাত নামায পড়লাম মসজিদে।



মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলাম ওয়ার্ডস লেকে। শহরের একপাশেই এই লেক। ভিতরে ডুকতে এন্ট্রি ফি লাগে।ভিতরে খুব পরিপাটি সাজানো গোছানো ফুলবাগান। লেকে বোটিং করার ব্যাবস্থা আছে। আমার পোলাপান ছোট সাতারও জানেনা তাই রিস্ক নিলাম না। ওয়ার্ডস লেকে ঘুরে আবার সেন্টার পয়েন্টে যখন ফিরলাম তখন সারে তিনটা বাজে।



দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমানোর চেষ্ঠা করলাম। কিন্তু বাচ্চারা ঘুমাতে দিচ্ছে না। কারন হোটেলের জানালায় মেঘের দল ভেসে ভেসে আসছে। তারা একবার গ্লাস বন্ধ করে দিচ্ছে আবার একটু খুলে মেঘ রুমের মধ্যে মেঘ নিয়ে আসছে। ভিষণ এক্সাইটমেন্ট সবার ভিতরে।

সন্ধ্যায় আমার বৌ মার্কেটে গিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করলো প্রসাধনী টাইপ। শেম্পু, স্নো, চকলেট এসব। আশেপাশে শ্রী-লেদারের শোরুম খুজছিলাম জুতা কেনার জন্য। খুজে পাইনি। একসাথে সবাই মুসলিম হোটেলে মাটন বিরিয়ানি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।

শেষের দিন সকালে আটটার মধ্যে হোটেল থেকে চেক আউট করে ডাউকির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে পাইনুরশলা ভিউ পয়েন্টে নেমেছিলাম এবং সোনাংপেদাংয়ে পৌছে সচ্চ পানিতে নৌকা ভ্রমন শেষ করেছিলাম। ইমিগ্রেশন পার হয়ে তামাবিল এসে যখন পৌছালাম তখন ঘড়িতে সময় বিকেল তিনটে। সিলেটের হরিপুরে ঝাল বেশি দিয়ে রান্না করা হাসের মাংশ দিয়ে ভাত খেলাম পেট ভরে।
ঢাকায় এসে যখন নামলাম তখন রাত সারে বারাটা।

ঢাকা
১২ পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপেক্ষা-২য় পর্ব

লিখেছেন শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৪

বিগত পাঁচ-ছয় মাস যাবত ফকির আবদুল হাই সাহেবকে মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমি নিজে থেকেই বিড়বিড় করে ওনার সাথে কথা বলা শুরু করেছি। দিন রাত যখনই অবসরে থাকি ফকির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ নিবে ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:২৭


আওয়ামী লীগের মিছিলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার ডেমরা-উত্তরা- বাড্ডা - মিরপুর সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল করছে। প্রায় তিনমাস ধরে রাস্তায় মিছিল নামানোর প্রস্তুতি ছিলো। মিছিলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি- যেদেশে হাসির জন্যও প্রাণ দিতে হয়!

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:৩৩

কয়েক দিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম হবু চন্দের আইন কবিতা নিয়ে, যেখানে কান্নার বিরুদ্ধে রাজা আইন জাড়ি করেছিলেন.....আজ লিখতে হচ্ছে- হাসির জন্য প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা নিয়ে। আমরা সবাই ইতোমধ্যেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

৭১ না দেখেও কেবল ইতিহাস পড়ে যদি আপনি ৫৩ বছর পরে এসেও পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে পারেন। তাহলে নিজ চোখে ভারতের আগ্রাসন দেখেও চুপ কেন?

লিখেছেন তারেক সালমান জাবেদ, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৪:৩৭

প্রথমেই শুরু করতে চাই সীমান্ত হত্যা নিয়েঃ -
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দ্বারা ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যা করা হয়েছে। ভারত সরকারের বাংলাদেশের সীমান্তে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চতুর্দিকে ওত পেতে আছে ফ্যাসিস্টের দোসর

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:৩৮

চতুর্দিকে ওত পেতে আছে ফ্যাসিস্টের দোসর

ছবি, অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। স্বৈরাচারী শাসনের পতন সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের ছায়া সমাজের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট শক্তির সহযোগীরা—যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×