somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাত্যহিকী-৮

০১ লা জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একঃ
বনফুল পরিবহন নামে একটা বাসে গ্রাম থেকে আম-কাঠাল, পেয়ারা, আতপ চাউল সহ আরো অনেক কিছু পাঠিয়েছে আব্বা। আমি সেগুলো রিসিভ করতে যাত্রাবাড়ী মোড়ে দাড়িয়ে আছি। ঘটনা কোরবানির ঈদের আগের। হঠাৎ আমির আলীর সাথে দেখা। ডেমরায় থাকাকালীন সময়ে তার সাথে পরিচয় ঘনিষ্টতা ছিলো।

প্রায় বছর পাঁচেক আগে ও এলাকা ছেড়ে এসেছি। তবুও যোগাযোগটা থেকে গেছে।
আমির আলীকে দেখতাম ওখানকার একটা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিতো আর সকালে মসজিদের বারান্দায় ঐ এলাকার বাচ্চাদের আরবি পড়াতো। বাচ্চার সুর করে ছেপারা পড়তো একসাথে। আলিফ-যবর-'আ', বা যবর 'বা'। কচিকাঁচাদের সেই গলার আওয়াজ অনেক দুর থেকেও শোনা যেতো।

আমির আলীর সাথে মাঝে মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগ হলে তার সংসারের টানাটানি, দায় দেনা, মসজিদ কমিটি বেতন বাড়ায় না, বাইরে কাজ করতে দেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতাম। সেদিন দেখা হলো সামনা সামনি, তাও প্রায় বছর দেড়েক পর।
আমির আলী মুয়াজ্জিনের চাকরি ছয়মাস আগে ছেড়ে দিয়ে এখন যাত্রাবাড়ীর মোড়ে ভ্যান গাড়িতে করে শরবত বিক্রি করে বেলা এগারোটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত। আর সন্ধ্যার পর চলে যায় চিটাগং রোডে। সেখানে বিশাল একটা মাদ্রাসার সামনে হাঁস-মুরগির ডিম সিদ্ধ করে বিক্রি করে। সাথে একটা কড়াইতে দুধ জাল দিয়েও বিক্রি করে রাত দশটা পর্যন্ত।

আমির আলীর বেশভূষা, পোষাক-আশাক আগের মতো আর নেই। মাথায় টুপি থাকলেও লম্বা জুব্বা নাই। লুঙ্গি আর টি শার্ট গায়ে দিয়ে শরবত বেচে। সংসারের অভাব অনটন অনেক কমে গেছে, দায়-দেনাও শোধ হচ্ছে দ্রুত।
ইতোমধ্যে বনফুল পরিবহনের সুপারভাইজার ফোন করে জানালো "ভাই ধোলাইপাড় মোড়ে আসেন"। আমি রিকশা ডাকলাম।
আমির আলী আমার দেয়া ধারের পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দিতে চেয়েছে আগামী মাসে। বিকাশ নম্বর আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি বলেছি- "আমার কোন বিকাশ নম্বর নাই"!!

দুইঃ
মতিন এম.এ পাশ করেছে বছর দুয়েক আগে। এরকম একটা সুপার অলস ছেলে কিভাবে এম.এ পাশ করলো আমার বুঝে আসেনা। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। একদম নিম্ন বিত্ত পরিবার। বাবা দিন মজুরির কাজ করে সংসার চালায় এখনো। আমার আবার দুর সম্পর্কে ভাগনা হয়।মতিন গত ছয় মাস কোন ফোন-টোন করে না। আগে প্রায় প্রতি সপ্তায় কল দিয়ে একটা চাকরির জন্য কতো রিকোয়েস্ট করতো। একবার একটা চাকরির ব্যবস্থাও করেছিলাম তার জন্য । একটা প্যাকেজিং কোম্পানিতে। কিন্তু কম বেতনের কথা শুনে আর ঢাকায় আসেনি।

শনিবার রাতে মতিকে ফোন দিলাম ভালো-মন্দ খোঁজ খবর নিতে। শুনলাম মতি মিয়া শাদি করেছে ছয় মাস আগে। বৌয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বিয়ের আগে থেকে। শরমে আমারে জানায়নি। বিয়ের পর বউয়ের চাপে পড়ে এলাকার বাজারে কসমেটিকের দোকান দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসার অবস্থা ভালো না।

এবার আর মতি মিয়া আমার কাছে চাকরির জন্য রিকোয়েস্ট করেনি। এবার সে দুবাই যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতেছে। আমার কাছে কোন বিশ্বস্ত এবং ঈমানদার আদম ব্যাপারী আছে কিনা জানতে চেয়েছে। টাকা পয়সা নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে সব দেবে। আমি বলেছি আমার পরিচিত এবং ঈমানদার কোন আদম ব্যাপারি নাই।

তিনঃ
মেহেরুন পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়েছিলো। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। দুই মেয়ের মা। বড় মেয়ে ক্লাশ সেভেনে পড়ে। আর ছোটটা টু'তে। শশুর বাড়ি বলতে ঢাকায় ফ্লাট বাড়িতে ভাড়া থাকা। ঢাকায় আর কিছুই নাই। জামাইয়ের একটা দোকান ছিল কোন একটা মার্কেটে। সেই দোকান ভাড়া দিয়ে এবং বাপের বাড়ি থেকে ছোট ভাই প্রতি মাসে হাত খরচ বাবদ কিছু টাকা পাঠায় সেটা দিয়ে কোন মতে টেনেটুনে সংসার চলে মেহেরুনের।

মেহেরুন আমার চাচাতো বোনের বান্ধবী। একই গ্রামে আমরা থাকলেও আলাদা আলাদা পাড়ায় আমাদের বাড়ি ছিলো। একসময় তার সাথে আমার বিয়ের কথা-বার্তাও হয়েছিলো এক ঘটকের মাধ্যমে। দুই পরিবারের একমতে না পৌছাতে না পারায় বিয়েটা হয়নি আমার সাথে।

মেহেরুন আই.এ পাশ করার পরপরই বিয়ে হয়েছিল তারই ফুপাতো ভাইয়ের সাথে। বিয়ের পর আর লেখাপড়া হয়নি। পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গিয়েছিলো। স্বামী মরার পরের বছরেই তেজগাঁও কলেজে বি.এ ভর্তি হয়েছিলো। এবার সে বি.এ পাশ করেছে। আমার চাচাতো বোনের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে মাস তিনেক আগে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে।

মেহেরুন চাকরির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমি বিডি জবসে তার বায়োডাটা তৈরি করে কয়েকটা কোম্পানিতে এ্যাপলাই করে দিয়েছিলাম। গত পরশু দিন বনানীর একটা অফিস থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য কল করেছে রিসিপশনিষ্ট পদের জন্য।
মেহেরুন আমাকে কল করে জানতে চেয়েছে কোম্পানির কেউ কি আমার পরিচিত। আমি জানিয়ে দিয়েছি অনলাইনে আবেদন করেছিলাম তার জন্য। কিন্তু আমার পরিচিত কেউ ওখানে নাই!!!

চারঃ
কুতুবউদ্দিনকে চাকরী থেকে সাসপেন্ডও করা হয়েছে তিন মাস আগে। কুতুব আমার কলেজের দোস্ত। আমাদের পাশের থানায় ওদের বাড়ি। আমাদের গ্রামের একটা বাড়িতে জায়গির থাকতো। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলো আমাদের কলেজে। ও আর্টসের ছাত্র ছিলো আর আমি কমার্সের। কুতুবউদ্দিন ইন্টার পাশ করে সদরে চলে যায়। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেই তহশিলদারের চাকরি পেয়েছিলো।
আশপাশের জেলা গুলোতে ঘুরে ঘুরে বহু বছর চাকরি করেছে।

ঢাকার মোহাম্মদ পুরের বছিলায় ছয়তলা বাড়ি আছে কুতুবউদ্দিনের। সর্বশেষ কর্মস্থল সাভার তহশিল অফিস থেকে তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বহুকাল তার সাথে যোগাযোগ ছিলোনা। ফেজবুকের ফ্রেন্ড লিষ্টে সে থাকলেও কোনদিন আমার কোন পোস্টে লাইক কমেন্ট করেছে বলে আমার মনে পড়েনা।

হঠাৎ করে গত শুক্কুরবার আমার মোবাইলে তার কল পেয়েছি। সন্ধ্যার পর টিএসসিতে এসে দেখা করেছি দুজন। এখন আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে কুতুবউদ্দিনের সাথে টং দোকানে আড্ডা মারি রাত দশটা পর্যন্ত।
গতকাল কুতুবউদ্দিন আমার কাছে জানতে চেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আমার কোন জ্যাক আছে কিনা? আমি বলে দিয়েছি "আমার কোন জ্যাক নেই দোস্ত আর আজকের চা-বিড়ির বিলটা তুই দে দোস্ত!!!

পাঁচঃ
বাসার সামনের গলির পুরো রাস্তাটা গত দুই মাস ধরে সিটি করপোরেশনের লোক কেটে খুড়ে মোটা মোটা কনক্রিটের পাইপ ডুকিয়ে ফেলে রেখেছে। এখন বৃষ্টির দিন। এক পশলা বৃষ্টি হলে থিক থিকে কাদা হয়ে একদম মাখামাখি হয়ে যায়। সেই কাদা জুতোর তলায় করে সিড়ি থেকে বাসার দরজার সামনে পর্যন্ত চলে আসে।

একদিন পর পর সিঁড়ি মোছার জন্য কদমের মা আসে। সাত তলা থেকে সিড়ি মুছতে মুছতে নিচতলা পর্যন্ত মুছে দিয়ে যায়। মুছতে মুছতে একগাদা গালাগাল করতে থাকে। কাকে গালাগাল করে আল্লায় জানে।

প্রতিদিন এই দেড়শো মিটার গলির পথ পাড়ি দিয়ে মেইন রাস্তায় উঠি। যেতে যেতে গ্রামের কাঁদার রাস্তার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে এরকম এক মাইল কাঁদার রাস্তায় হেটে হেটে স্কুলে যেতাম। স্কুলের পুকুরে পা ধুয়ে ক্লশে ঢুকতাম।

আজ সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বাচ্চাদের স্কুলে যেতে নিষেধ করেছি কিন্তু বৌ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেছে "পোলাপান লাই দিয়া নষ্ট করবা না, যাও স্কুলে দিয়ে আসো"। আমি নিরুপায়। ছেলেকে রেইন কোট পড়িয়ে স্কুল ব্যাগটা আামর পিঠে ঝুলিয়ে বৌকে বললাম ছাতাটা দাও, বৌ বললো ছাতা গত সপ্তায় ভুলে বাসে রেখে নেমে গেছি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে। বাসায় আর কোন ছাতা নাই।!!

ঢাকা,
১৬ আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

ছবিঃ অন্তর্জাল।


প্রাত্যহিকী-১
প্রাত্যহিকী-২
প্রত্যহিকী-৩
প্রাত্যহিকী-৪
প্রাত্যহিকী-৫
প্রাত্যহিকী-৬
প্রাত্যহিকী-৭

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×