দু বছর আগের কথা, বিভাগের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের হালহাকিত নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্ট করার আদেশ দিলেন। সেই অ্যাসাইনমেন্ট করার উদ্দেশ্য ডেডলাইনের মাত্র কয়েক দিন আগে বন্ধুদের সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট যাচ্ছিলাম।
দিনটি ছিল ৭ই মার্চ। এ উপলক্ষে রমনার শোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্কের মর্ধবর্তী রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে জনসভা ডেকেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। ক্ষমতাসীন দলের জনসভা পুলিশ আর র্যাব মিলে রাস্তাঘাট সব সিলগালা করে দিয়েছে। তাই অনেক ঘুরে ফিরে যেতে হচ্ছিল।
রাস্তা বন্ধ থাকায় সরাসরি রাস্তায় ঢুকতে পারি নি। তাই বার কয়েক রাস্তার পাশের বেড়া কোন রকমে টপকে পার্কের পাশের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম। মার্চ মাসের প্রখর রোদ, কপাল বেয়ে ঘাম গড়াতে বেশী সময় লাগল না। অনেকক্ষণ হাঁটায় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ধীরে ধীরে সবাই এগিয়ে যাচ্ছি, আর এভাবে রাস্তা বন্ধ করে জনসভা করার জন্য সরকারি দলের বুদ্ধির তারিফ!! করছিলাম।
হাঁটতে হাঁটতে যখন রমনার শেষ মাথায় এসে পৌছেছি এমন সময় দেখলাম সামনে ফুটপাতের পাশে এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে। তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে শুয়ে আছে একটা দেশী কুকুর। ছবিটা আমার কাছে খুব বেশি নতুন মনে হয় নি। এ রকম ছবি ঢাকা শহরে প্রায়শ দেখা যায়। বৃদ্ধটির লোকটার বয়স আশির কাছকাছি হবে বলে মনে হল। মলিন দেহখানা ফুটপাতের ধার ঘেষে এলিয়ে দিয়ে আাকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে দৃষ্টিতে শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু অবাক হলাম আমার এক বন্ধুর আচরণে। সে বৃদ্ধের আর কুকুরের পাশপাশি দেখে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হযে পড়ল। অনেকটা সিনেমার পরিচালকের মত। তার ভাবসাব দেখে বুঝলাম, ছবিটা তোলার কারণ ছিল ছবিটার অস্বাভাবিকতা। বৃদ্ধের ওভাবে শুয়ে থাকা তার মনে দাগ কাটেনি। ছবিটার মধ্যে যে মানুষের লজ্জা লুকিয়ে আছে সেটা আমার বন্ধুটির মাথায় হয়তো খেলেনি।
ভাবছিলাম ছবিটা ফেসবুকে দিয়ে হয়তো বেশ কিছু লাইক পাবে। ডজনখানেক হয়তো শেয়ারের ঘটনাও ঘটবে। ভাগ্যে থাকলে হয়তো পুরস্কারও জুটে যেতে পারে।
বৃদ্ধ লোকটা আর কুকুরটাকে যেখানে দেখিলাম তার থেকে অল্প কিছু দূরেই জননেত্রী ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। তাই ওই এলাকার পথঘাট অনেক আগেই ফাকা করে দেয়া হয়েছিল। জানি না সেই বৃদ্ধ লোকটিকে কেন সরানো হয় নি। আমার কাছে অবশ্য একটা উত্তর আছে সেটা ঠিক নাও হতে পারে, মনে হয় প্রহরীদের চোখকে ফাকি দিয়ে সেই বৃদ্ধটি প্রতিবাদ জানাতে এসেছিল। সেই প্রতিবাদ হল দুবেলা খেতে না পাওয়ার প্রতিবাদ.......থাকার জায়গা না থাকার প্রতিবাদ
চোখ দিয়ে পানি আসে নি আমার। আমাদের সমাজ আর রাষ্ট্রযন্ত্র আর দশজনের মত আমাকেও অমানবিক করে তুলছে ধীরে ধীরে।