অনেক সময় ধরে ঘুমাচ্ছি, অনেক অনেক দিন, অনেক অনেক মাস, অনেক অনেক কাল...। এখানে তো আর সময়ের হিসেব নেই, তাই সঠিক কত কাল তাও জানি না। থাকগে, এখানে তো আর দিন রাত নেই- সময়ের হিসেব দিয়ে কি বা হবে? তবে হ্যা প্রথম প্রথম মনটা কেমন ব্যকুল হয়ে যেত, ঘুমাতে ইচ্ছা করত না, ছটফট করতাম এক চিলতে আলোর জন্য। সেদিনের কথা এখনো মনে আছে, তখন তো আমি এখানে নতুন, অনেক দিন ঘুমানোর পর জেগে উঠে শুধু আলো নিয়েই তো খেলতাম। মাঝে মাঝে যখন খুব সুক্ষ কোন ফাঁক গলে ঢুকে যেত ঠান্ডা হাওয়া- উহ; সে কি প্রশান্তি। ভাবলে এখনো মনটা ভরে যায়।
কিন্তু কত দিন? মাস বোধয়, না বছর ই হবে, নাকি কত কাল? কি জানি,সময় তো মনে নেই, অনেক কাল আগের কথা তো। কিন্তু সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে- আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি, হঠাত দেখি সব ছাড়খাড় করা প্রবল আলো, আমি আর্তনাত করে চোখ
বন্ধ করতে চাইলাম কিন্তু তা কি আর হয়! চোখ তো কবেই খসে পরেছে, বন্ধ করব কি? ওহ; সে কি কষ্ট...কষ্ট...কষ্ট! অবশেষে আমার কষ্টের অবসান ঘটিয়ে কারা যেন কিছু মাটি ছুড়ে দিল আমার চোখে। আমি কিছুটা শান্ত হলাম। একটু বেশিই শান্ত, কারন কারা যেন আমার সারা শরীর জুড়ে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে মাটি, সেই প্রথম দিনের মত যেদিন এখানে এলাম। সেকি অন্ধকার! সেকি শুন্যতা! যেন বুক ফেটে যায়...। ওইদিন অবশ্য ঘটল অন্য ঘটনা। নিজের শরীরের সমান ভারি আর একটা শরীরের ভারে পিষে যেতে লাগলাম আমি। একদিকে এই যন্ত্রনা, অপরদিকে আবার সেই অন্ধকার। কোথাও এক চিলতে ফাঁক রইল না যেখান দিয়ে আমার জন্য একটু আলো আসতে পারে। বাতাসের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। সেই থেকেই তো এই অন্ধকারেই বাস। সময়ের হিসেব আর আমি জানব কিভাবে!
তা সে যাই হোক। সব কথা তো আর মনে করতে পারি না, তাই যতটুকু মনে পরে জেগে থাকলে তাই ভাবি শুয়ে শুয়ে। আলো-বাতসের জন্য এখন আর তেমন ছটফট করি না, শরীরের যন্ত্রনাও আর তেমন অসহ্য ঠেকে না। আচ্ছা কারা কারা এল এখানে? সেই বুড়িটা বোধয়, মাঝি পাড়ায় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে ভিক্ষা করত। যার থালা ধরা হাতে ছিল দগদগে ঘা...। তারপর খান বড়ির সেই ছেলেটাও হয়ত, বুড়ির ঘা দেখে যে নাক কুঁচকে ছুড়ে দিত দশ টাকার একটা নোট। আর কে কে এলো এখানে? কি জানি ,সবাইকে হয়ত চিনিও না!
পরিচিত কাউকে তেমন মনে পরে না, না মার চেহারাটাও তো আবছা! সেকি আমায় আদর করত? পাশের বাড়ির বাবুর মা যেমন বাবুকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেত! নাহ মনে নেই। আমাকে ছোট রেখেই তো সে চলে গিয়েছিল তার প্রেমিকের হাত ধরে, কি জানি তার সেই প্রেমিক কি তাকে সুখে রাখতে পেরেছিল কিনা! তবে হ্যা, আদর আমাকেও করেছিল একজন, তার বুকে ছিল উন্মাদনার গন্ধ, সেই উন্মাদনায় মেতেছিলাম আমিও। তবে ভালবাসা আর উন্মাদনায় যে পার্থক্য তা তখন বুঝি নি, বুঝেছিলাম পরে। আর ভালবাসা? হ্যা ভালও আমায় বেসেছিল কয়েজন, আমি বেসেছিলাম কিনা জানি না।
মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগে। আচ্ছা, আমায় কি কেউ মনে রাখে নি? কেউ না? কারো মনে কি আমার জন্য ভালবাসার একটি অশ্রু ও নেই? এই পৃথিবীর কোথাও কি আমার অস্তিত্যের এক বিন্দুও অবশিস্ট নেই? তবে আমি কেন আছি? আমি তো এরকম পরিনতি চাই নি! আমি আমার অস্তিত্য চাই,যেভবেই হোক চাই। আমি মুক্তি চাই, স্পর্শ চাই, ভালবাসা চাই, আমি ভালবাসতে চাই, আমি মুক্তি চাই, মুক্তি...।
এক চিলতে আলো এল বোধয়...! কোথ্যেকে এল? কোনদিক দিয়ে? না না, এবার আমি আর এক মুহুর্তও নষ্ট করব না। আমি নিজেকে নিঃস্ব করেই মুক্তির স্বাদ নেব।
এটি একটি বিচ্ছিন ঘটনাঃ
(ঐ দেখ কি সুন্দর একটা ফুল। ইস! কি সুন্দর গোলাপী রঙ! এনে দে না দাদা।
_ না না, আমার ভয় করে। আমি পারব না।
দে না দাদা। আমি গেলে মা বকবে। মা বলেছে মেয়েদের গোরস্থানে যেতে নেই। দে না দাদা, দে না...
_আচ্ছা এক শর্তে, তোর এই বাক্সে কি আছে আমায় দেখাবি?
দেখাব, তুই এনে দে।
_এই নে।
ইস! কি সুন্দর! কি সুন্দর!
_খবরদার ঠোট ছোয়াবি না, দূর থেকে ঘ্রান নে।
কি সুন্দর ফুল! কি সুন্দর!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৬