সুফিয়া বেগমের চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। স্বামী ইলিয়াস খাঁ গরীব খেটে খাওয়া মানুষ। সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু নেই। পূর্বপুরুষদের ভিটেটা আর হালচাষের জন্যে দুইটা গরু রুটি রুজির সম্বল। গ্রামের অন্য মানুষদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে সংসার চলে। একদিন ইলিয়াস খাঁ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় উনি মারা যান। অনেকে বলে ইলিয়াস খাঁ কালা জ্বরে মারা গেছেন। যে বয়সে একজন মহিলা স্বামী সংসার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে, সে বয়সেই সুফিয়া বেগম বিধবা হয়ে যান।
স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে মহা বিপদে পড়ে যান। মেয়ে আফিয়ার বয়স এগার আর ছেলে জমিরের দশ। কিভাবে কি করবেন বোঝে উঠতে পারছিলেন না। আত্মীয় স্বজনও এমন কেউ নেই যে যার কাছে সাহায্যের জন্য যেতে পারেন। এক ভাই আছেন উনার অবস্থা তেমন ভাল না, দিন আনি দিন খাই অবস্থা। অবশেষে কোন উপায় না পেয়ে একমাত্র সম্বল ঐ গরু দুইটা বিক্রি করে দিলেন। সেই টাকা দিয়ে বাঁশ কিনে এনে তা দিয়ে পাটি,খলুই,হাতপাখা এসব বানিয়ে হাঁটে নিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন। মাঝেমাঝে নকশী কাঁথাও বানাতেন। এসব করে কোন রকম দিন চলে যাচ্ছিল। মাঝপথে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল গ্রামের মোড়ল মতি মিয়া। ইলিয়াস খাঁ মারা যাওয়ার পর সে প্রায়ই সুফিয়া বেগমের বাড়িতে আসত। প্রথম প্রথম সপ্তাহে দুই একবার এসে সব কিছু কেমন চলছে, কোনরকম সমস্যা আছে নাকি এসব জিজ্ঞেস করে চলে যেত। আস্তে আস্তে সে প্রতিদিন আসতে লাগল, অনেক সময় ধরে বসে থেকে খেজুরে আলাপ করত। সুফিয়া বেগম তাতে প্রচণ্ড রকম ইতস্তত: বোধ করতেন। কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারতেন না, আবার সহ্য ও করিতে পারতেন না। মাঝেমাঝে সে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে চাইত কিন্তু সুফিয়া বেগম কখনও কোনরকম সাহায্য নিতেন না ।
অবশেষে একদিন সুফিয়া বেগম সাহস করে মতি মিয়াকে এভাবে প্রতিদিন বাড়িতে আসতে নিষেধ করেন। মতি মিয়া উত্তরে যা বলল তাতে সুফিয়া বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে বলল – দেখ তোমার স্বামী নাই, তোমার মাইয়্যা বড় হইতাছে। কিছুদিন পর ওরে বিয়ে সাদি দিতে হইবো। তোমার ছেলে জমিরেরও একটা ভবিষ্যৎ আছে। তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ, সব কিছু তোমার একলার পক্ষে সম্ভব হইবো না। তাই আমি তোমার পাশে থাইক্যা তোমারে সাহায্য করতাম চাই। এরকম দূরে থাইকা তো আর সাহায্য করা যায় না, তাই যদি আমারে তোমার আসবার সুযোগ দাও তাহলে তোমারে সাহায্য করতে সুবিধা হয়। সুফিয়া বেগম কোন কিছু না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করেন – আপনি আমার কাছে কি চান? মতি মিয়া সোজাসুজি বলে – আমি তোমারে বিয়ে করতাম চাই। আমার উপরে তুমি বিশ্বাস রাখতে পার, আমি তোমারে এবং তোমার ছেলেমেয়ে কাউরেই কোনরকম কষ্টে রাখব না, সুখে রাখবো। সুফিয়া বেগম এসব শুনে অবাক হয়ে বলেন – আপনার ঘরে দুই দুইটা বউ আছে, ছেলে মাইয়্যা আছে, আপনার লইজ্জা করে না এইসব চিন্তা করতে। উত্তরে মতি মিয়া বলে দুই বউ হইছে তো কি হইছে, ইসলামে চাইর বিয়া করা সুন্নত আছে। ভাল করে চিন্তা কইরা দেখ, আমি তোমার ভাল চিন্তা কইরা এসব বলতাছি। আচ্ছা আমি আজ চলে যাইতেছি কালকে আবার আসব। তখন তুমি আমারে ফাইনাল জানালে চলব।
পরের দিন মতি মিয়া আবার আসে। কিন্তু সুফিয়া বেগম কিছুতেই মতি মিয়ার প্রস্তাবে রাজি হননি। রাজি না হওয়ায় মতি মিয়া শুরু করে সুফিয়া বেগমের উপর বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র বিভিন্ন রকম অত্যাচার। কোন কিছু করে যখন সে সুফিয়া বেগম কে রাজি করাতে পারছিল না তখন ঠিক করলো এমন কিছু করতে হবে যাতে সে গ্রামে একঘরা হয়ে থাকতে হয়। সেই প্লানমাফিক একদিন সারা গ্রামে সুফিয়া বেগমের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে দেয়া হয় যে- ওর চ্যালা আসিকের সাথে সুফিয়া বেগমের অবৈধ সম্পর্ক আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুফিয়া বেগমের বিরুদ্ধে সালিশ ডাকা হয়। সালিসে সুফিয়া বেগম কে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তিও দেওয়া হয়। শাস্তি হিসাবে ওর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয় এবং তাদের এক ঘরে করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে গ্রামের কেউ তাদের সাথে মিশত না, কোনরকম যোগাযোগ করত না। তারাও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারত না, মিশতে পারত না। সবাই এড়িয়ে চলত, তারা যদি কারো সাথে মিশত চাইত তাহলে বিভিন্ন রকম বাজে অপবাদ দিয়ে গালিগালাজ করত। অবশেষে কিছু দিনের জন্যে উনি ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেন। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারলেন না। আর কোথাও যাবার জায়গা না থাকার কারণে আবার সে স্বামীর ভিটেতেই ফিরে আসতে হল ।
আবারও বাঁশের বেত দিয়ে পাটি খলই হাতপাখা এসব বানিয়ে হাঁটে নিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন। এখন মাঝেমাঝে ছেলে জমির আর মেয়ে আফিয়া কে হাঁটে পাটান। ঐদিকে মতি মিয়াও মাঝে মাঝে আসে এসে ওর সেই পুরানো প্রস্তাব মনে করিয়ে দিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে বলে যায় প্রস্তাবে রাজি হলে তাহলে ওদের আর এক ঘরা হয়ে থাকতে হবে না। তাদের উপর থেকে সব শাস্তি উঠিয়ে নেয়া হবে। সুফিয়া বেগম এখন আর মতি মিয়া কে ভয় পায় না,সে ওকে যা-তা বলে অপমান করে বিদেয় করে। শেষ যে দিন আসছিল সেদিন তো দা দিয়া দৌড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে সে এদিকে আসাটা বন্ধ করে। এভাবেই ওদের দিন চলছিল। এর মাঝে দেশে শুরু হল যুদ্ধ। সুফিয়া বেগম হাঁটে শুনে আসেন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে গ্রামে আসছে। ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলছে, যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে। ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে যুবতী মেয়েদের। যুবক ছেলেদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে মারছে। উনি ভাবছেন যদি পাকিস্তানি সেনারা তাদের গ্রামে আসে তাহলে তিনি কি করবেন। আফিয়ার মত একটা যুবতী মেয়ে তার ঘরে। এমন কোন জায়গাও নাই যেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়। খুব চিন্তায় পড়ে যান, বুঝতে পারেন না কিভাবে কি করবেন। ছেলেমেয়েকে কে নিয়ে সারাদিন ঘরে বসে থাকেন। জমিরকে একা হাঁটে পাঠান আর বলে দেন খবর নিয়ে আসার জন্যে পাকিস্তানি সেনারা তাদের গ্রামের দিকে আসছে কিনা! অবশেষে খবর পেলেন পাশের গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা এসে ঘাঁটি পেতেছে। তা শুনে সুফিয়া বেগমের চিন্তা আরো বেড়ে গেল। সব সময় অস্থির থাকেন, রাতে ঘুমাতে পারেন না। একদিন সকাল বেলা জমির কে নিয়ে ঘরের ভিতর দুইটা বড় গর্ত করেন। আফিয়া কে বলেন এই গর্তের ভিতরে যেন সব সময় লুকিয়ে থাকে । আফিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়ের কথা মত প্রতিদিন গর্তে লুকিয়ে থাকতে লাগল। একদম প্রয়োজন ছাড়া সে গর্ত থেকে বেরুত না।
ঐদিকে মতি মিয়া পাকিস্তানি সেনাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে চেয়ারম্যান করে এলাকায় শান্তি কমিটি করা হয়। একদিন সন্ধ্যাবেলা মতি মিয়া তার দুই চ্যালা সহ সুফিয়া বেগমের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সুফিয়া বেগম মতি মিয়াকে দেখে ভয়ে তার মুখ চুপসে যান। কি করবেন কিছুই বোঝে উঠতে পারেন না। মতি মিয়া বেতের মোড়ায় বসতে বসতে মুচকি হেসহেসে বলে- কেমন আছ সুফিয়া বেগম? কেমন কাটতেছে দিন কাল ? তার মুচকি হাসিতে এক ভয়ংকর রূপ ফুটে উঠে। সুফিয়া বেগম নির্বাক হয়ে মতি মিয়ার সামনে বসে থাকেন। মতি মিয়া সুফিয়া বেগমের কোন উত্তর অপেক্ষা না করে বলে যেতে থাকে – আমি ইদানীং খুবই ব্যস্ত তাই বেশিক্ষণ বসতে পারব না। শুনছো নিশ্চয় পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় আইসা পড়ছে এবং আমাকে ওরা অত্র এলাকার দায়িত্ব দিছে। আর ওদের কাজ কারবার সম্পর্কে নিশ্চয় খবর শুনতাছ। আজ থাইক্যা চার বছর আগে আমি তোমারে একখান প্রস্তাব দিছিলাম। কিন্তু তুমি তাতে রাজি হও নাই। রাজি না হওনের কারণে কি হইছিল সেইটা তো তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছ। আজ আমি তোমারে আরেকটা প্রস্তাব দিতাছি। যদি আমার এই প্রস্তাবে রাজি না হও তাহলে আমি তোমার জীবন ছ্যাড়াব্যাড়া কইরা দিমু। সুফিয়া বেগম সাহস করে জিজ্ঞেস করেন – আমি রাজি না হলে কি করবেন? মতি মিয়া মুচকি হেসে বলে কি করব শুনবার চাও, তাহলে হুনো- তুমি যদি রাজি না হও তাহলে আমি তোমার মাইয়্যারে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুইল্যা দিব। আর ছেলেকে মুক্তিবাহিনীর চর বানাইয়া তোমার চোখের সামনে গুলি কইরা মাইরা ফালানো হইবো। এখন আমার প্রস্তাব মন দিয়া হুনো, প্রস্তাবটা হইল তোমার মেয়ে আফিয়াকে আমি বিয়া করতাম চাই। তারে আমি রাজরানীর মত কইরা রাখব। কোনরকম কষ্ট দিব না। আর তোমাদের সবাইকে আমার বাড়িতে নিয়ে তুলব যাতে কইরা পাকিস্তানিরা তোমাগো কোনরকম ক্ষতি করতে না পারে। এই বলে সে উঠে চলে যেতে উঠে দাঁড়ায়, সুফিয়া বেগম হুমড়ি খেয়ে মতি মিয়ার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মাফ চাইতে থাকেন। আর বলতে থাকেন আমার উপর এত নিষ্ঠুর হইয়েন না, আমারে যে কোন শাস্তি দেন কিন্তু আমার মাইয়্যারে কোন শাস্তি দিয়েন না। মতি মিয়া লাথি দিয়ে সুফিয়া বেগম কে ফেলে দিয়ে বলে আমি কাইল আবার আসুম, তখন আমারে ফাইনাল সিদ্ধান্ত জানাইবা।
মতি মিয়া চলে যাওয়ার পর সুফিয়া বেগম পাথরের মূর্তির মত মাটিতে বসে থাকেন। মুখ দিয়ে শব্দ করে মেয়েকে ডাকতে পারেন না, তার চোখে সবকিছু অন্ধকার লাগে। কিছুক্ষণ পর আফিয়া মাকে এরকম মাটিতে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে – কি হইছে মা? উত্তরে কোন কিছু বলেন না শুধু মেয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মায়ের এই অবস্থা দেখে আফিয়া আর জমির কাঁদতে থাকে। সুফিয়া বেগম ফ্যালফ্যাল করে ছেলে মেয়ের কান্না দেখেন!
রাত যত বাড়ে ততই সুফিয়া বেগমের অস্থিরতা বাড়ে। আফিয়া মায়ের পাশে বসে থাকে,বারবার মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে – কি হইছে মা? মতি মিয়া তোমারে কি এমন কইছে যার জন্য তোমার এই অবস্থা হইল? কিন্তু সুফিয়া বেগম আফিয়াকে তার প্রশ্নের কোন উত্তর দেন না। শেষ রাতে হঠাৎ করে সে আফিয়াকে জড়িয়ে ধরে রোদন করে কান্না শুরু করেন। আফিয়াও মায়ের সাথে কাঁদতে থাকে আর বারবার জিজ্ঞেস করে তোমার কি হইছে মা, আমায় খুইলা কও। কিছুক্ষণ পর সুফিয়া বেগম মতি মিয়া যা বলে গেছে তা খুলে বলেন। বলার পর আফিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন তুই আমারে বল আমি কি করব? আফিয়া সব শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে! মায়ের পায়ের ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা আমাকে গলা টিপে মাইরা ফেলো তারপরেও আমারে ঐ জানোয়ারটার হাতে তুইল্যা দিও না ।
পরের দিন মতি মিয়া যখন আসে মা আর মেয়ে মিলে তাকে অপমান করে বিদায় করে। যাবার সময় মতি মিয়া বলে যায় সে এই অপমানের প্রতিশোধ সে নিবো! এর দুইদিন পর জমির বাজারে যায় কিন্তু সারাদিন পেরিয়ে যায় অথচ সে ঘরে ফিরেনা দেখে এদিকে মা মেয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন! সারা গ্রাম খুঁজে কোথাও তাকে পাওয়া যায় না! একে ওকে জিজ্ঞেস করেন কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। সময় যত যায় তাদের পেরেশানি তত বাড়ে। আর বারবার মনে পড়ে মতি মিয়ার সেই প্রতিশোধ নেয়ার হুংকার। অবশেষে মা আর মেয়ে মজিদকে খুঁজ করতে মতি মিয়ার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন! মতি মিয়া তাদের দেখে মুচকি হেসে বলতে লাগে – তোমরা আমার বাড়িতে আইবা এইটা আমি জানতাম! হুনলাম জমির কে খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না! আমার কাছে যখন আইছ তখন একটা ব্যবস্থা অইবো ইনশাআল্লাহ।
তারপর সুফিয়া বেগমকে মতি মিয়া আলাদা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে যায়! সুফিয়া বেগম ভয়ে ভয়ে মতি মিয়ার পিছেপিছে যান! আর আফিয়া ভয়ার্ত চোখে দেখে মতি মিয়ার পিছুপিছু মায়ের চলে যাওয়া! সুফিয়া বেগম নির্বাক হয়ে বসে থাকেন মতি মিয়া সামনে – মতি মিয়া তার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে কথা শুরু করে – শুনো আফিয়ার মা, আমি তোমারে অনেকবার সাহায্য করতাম চাইছি কিন্তু তুমি আমার সাহায্য নেও নাই। এইবার আমি তোমারে শেষবারের মত সাহায্য করতে চাইতাছি, যদি আমার সাহায্য তুমি নিবার না চাও তাহলে আমার আর কিচ্ছু করার থাকব না! এইটাই তোমার শেষ সুযোগ, ছেলে ফিরাইয়া চাও না ছেলের লাশ চাও এইটা নির্ভর করবো তোমার সিদ্ধান্তের উপর! মাইয়্যারে নিয়া আসছ, এটা খুব ভালো করছ । এখন আমি মৌলানা ডাকতেছি, বিয়া পড়াইয়া আমার কাছে রাইখ্যা বাড়িতে চইলা যাও! আমি জমিররে বাড়িতে পাঠানোর ববস্থা করতাছি। সিদ্ধান্ত যা লওয়ানের এখুনি নিতে হইবো, হাতে সময় একেবারে কম! সুফিয়া বেগম পাথরের মত শক্ত হয়ে মাটিতে বসে থাকেন মতি মিয়ার সামনে! একটু পরে সে আস্তে আস্তে করে বলেন – ঠিক আছে আপনি মৌলভী ডাকেন !
এই রাতেই আফিয়ার সাথে মতি মিয়ার বিয়ে হয়ে যায়! সুফিয়া বেগম যখন আফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসেন, তখন আফিয়ার হাত ধরে বলেন– যদি পারস এই অভাগা মা’রে মাফ করিস! আফিয়া মাথা নিচু করে আস্তেআস্তে করে বলে– মা তুমি তোমার ছেলেরে ফিরাইয়া পাইতে মাইয়্যারে নিজ হাতে মাইরা ফালাইলা? সুফিয়া বেগম আর কিছু না বলে চোখে শক্ত হয়ে যাওয়া জল নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন! বাড়িতে ফিরে ছেলের প্রিয় খাবার শুঁটকি দিয়ে আলুর ঝুল রান্না করেন! তারপর প্লেটে ভাত নিয়ে হারিকেনের মৃদু আলোয় সুফিয়া বেগম ছেলে জমিরের জন্যে অপেক্ষায় বসে থাকেন। বাহিরে অন্ধকারে মাঝেমাঝে জোনাক পোকার আলো দেখে আৎকে উঠেন আর ভাবেন এই বুঝি জমির ফিরে এল। রাত বাড়ছে, অন্ধকার বাড়ছে, বাড়ছে হারিকেনের নিবুনিবু আলোয় সুফিয়া বেগমের ছেলের জন্য অপেক্ষা।
১৬ই ডিসেম্ব্রর ২০০২ রোজ সোমবার জাতীয় পত্রিকাগুলো পিছনের পৃষ্টায় একটা খবর আসে। খবরের শিরোনাম হল – কৃষি মন্ত্রী মতিউর রহমান চৌধুরীর গাড়ির ধাক্কায় এক বৃদ্ধা পাগলীর মৃত্যু। ঘটনাটা ঘটেছে জাতীয় সংসদের সামনে। কেউ চিনে না এই পাগলী কে,তার সম্পর্কে কেউ কোন রকম তথ্য দিতে পারেনি। এক বাদাম বিক্রেতা (যে সব সময় জাতীয় সংসদের সামনে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করে) ভাষ্যমতে – আমি ঐ পাগলী কে প্রায়ই এইখানে আসতে দেখতাম! একদিন সে আমার কাছ থাইক্যা বাদাম চাইতে আইছিল। তখন আমি তারে জিগাই ছিলাম তুমি এইখানে বারবার কেন আসো? সে কইছিল– আমি ঐ বড় বাড়ির ভিতরে ঢুকতাম চাই! তখন আমি তারে আবার জিগাইছিলাম– তুমি সংসদের ভিতরে ঢুকতে চাও কেন? সে কইছিল– এই বাড়ির ভিতরে একজন আছে যে জানে– আমার ছেলে কই আছে, যে আমার নিরীহ মাইয়্যারে বিয়া করার এক মাসের মাথায় শকুনদের হাতে তুইল্যা দিছিল। আর সেই শকুনগুলা আমার মাইয়্যারে ছিড়েছিড়ে খাইয়্যা কই ফালাইছে সেটা ঐ মানুষটা ছাড়া আর কেউ জানে না। এই বইল্যা সে ঝাপ্টা দিয়া এক মুটো বাদাম নিয়া সংসদের দিকে দৌড় দিছিলো। এরপর অনেকদিন ওরে দেখি নাই ! আজ দেখলাম ওর থেঁতলানো লাশ রাস্তা পইড়্যা আছে ।