মফস্বলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদবী নিয়ে যিনি জীবন যাপন করেন, তিনি সৎ,আদর্শবান নিরীহ টাইপ হবেন এটাই স্বাভাবিক। রাম নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফ উদ্দিন সাহেব এর ব্যতিক্রম নয়। উনি উনার জীবনটা একটা নির্দিষ্ট রুটিনের আওতায় প্রায়ই কাটিয়ে দিয়েছেন। ফজরের নামাজ পড়ে একটু হাঁটাহাঁটি করেন। ঘরে এসে স্ত্রীর সাথে গল্প করে করে বেলা বিস্কুট দিয়ে চা খান। তারপর ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। ছেলেমেয়েরা সকালের নাস্তা করে পড়তে বসে। উনি গোসল করার আগ পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের পড়ার টেবিলে ওদের পাশে বসে থাকেন। তারপর গোসল করে সকালের ভাত খেয়ে স্কুলে যান। স্কুল ছুটির পর স্কুলের পাশে রাহমানিয়া লাইব্রেরিতে বসে স্থানীয় পত্রিকা পড়েন। পত্রিকা পড়া শেষে ঘরের জন্য কোন ধরনের বাজারপাতি থাকলে সেটা করে বাড়িতে চলে আসেন। ছুটির দিন ছাড়া প্রায় এইরকমই উনার প্রতিদিন যায়।
একমাত্র ছেলে কবির এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ প্লাস নিয়ে এস এস সি পাশ করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। একমাত্র মেয়ে মারুফা ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়ালেখায় ছেলেমেয়ে দুজনই ভাল, তবে তুলনামুলকভাবে মেয়েটা বেশি ভাল। সে ক্লাস ফাইভ ও এইটে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়েছে। সবাই আশা করছে ভাইয়ের মত এস এস সিতে সেও এ প্লাস পাবে। এলাকায় সৎ ও ভাল মানুষ হিসাবে আশরাফ সাহেবের যেমন নামডাক আছে, তেমনি উনার ছেলেমেয়ে দুজনই ভাল ছাত্রছাত্রী হিসাবে যথেষ্ট সুনাম আছে। এলাকার ভাল ও ভদ্র ছেলেদের কথা উঠলে প্রথমেই কবিরের নাম চলে আসে। ছেলের আচার ব্যবহার চলাফেরা নিয়ে আশরাফ সাহেব নিজেও সন্তুষ্ট। এলাকার অন্যদের মুখে ছেলের প্রশংসা শুনলে বাবা হিসাবে নিজেকে সার্থক ভেবে ছেলেকে নিয়ে কিছুটা গর্ববোধও নিজের মাঝে কাজ করে। ছেলেকে নিয়ে উনি অনেক স্বপ্ন দেখেন এবং মনপ্রানে বিশ্বাস করেন একদিন সে তাঁর সব স্বপ্ন পুরণ করবে। এই বিশ্বাস থেকেই আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব অনেকের নিষেধ করা সত্ত্বেও ছেলেকে এলাকার কলেজে ভর্তি না করিয়ে শহরের কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। আর যারা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে শহরের কলেজে ভর্তি করতে নিষেদ করেছে তাদেরকে তিনি বুক ফুলিয়ে বলেছেন – আমার ছেলে নষ্ট হওয়ার মত ছেলে না। কারণ ছেলের প্রতি উনার অগাধ বিশ্বাস আছে সে কোনদিনই নষ্ট পথে যাবে না, কখনও খারাপ কাজ করবে না। তাই শহরের কলেজে ভর্তি করলে অভিবাবকের অভাবে সে খারাপ হয়ে যাবে এধরণের কোন চিন্তা তার মাথায় কখনই আসেনি।
শহরের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কবির এলাকার এক পরিচিত বড় ভাইয়ের মাধ্যমে একটা মেসে উঠে। মেসে আরও তিনজন থাকেন। তিনজনই তার সিনিয়র। সবাই তাকে বেশ স্নেহ করেন, সেও তাদেরকে রেসপেক্ট করে। কিছুদিন যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল ওদের সাথে এই মেসে তার থাকা সম্ভব না। কারণ ওরা তিনজনই রাজনীতির সাথে জড়িত। ওরা নামে মাত্র ছাত্র, কিন্তু কলেজে ক্লাস বা বাসায় পড়ালেখা কিছুই করেনা। কলেজে মিছিল মিটিং আর বাসায় আড্ডা নিয়েই ওরা ব্যস্ত থাকে। মেসে সবসময় বখাটে টাইপ ছেলেদের আসা যাওয়া, রাত বিরাতে সময় অসময়ে আড্ডা,তাস খেলা, চিল্লাচিল্লি এসব চলে। তাতে করে তার পড়াশুনার অনেক সমস্যা হয়। তাই সে ঠিক করে সে অন্য কোন মেসে চলে যাবে, সে অনুযায়ী সে মেস খুঁজা শুরু করে দেয়। অনেক খুঁজাখুঁজির পর সে একটা মেস পেয়েও যায়, ওদের সাথে কথা হয় আগামী মাসে সে এসে এখানে উঠবে। এদিকে বর্তমান মেস মেম্বারদের সে জানিয়ে দেয় যে – সে আগামী মাসে মেস ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে উঠবে । তারা কবিরের মেস পরিবর্তনের কথা শুনে তাকে তেমন কিছু বলল না, কিছুটা দুঃখ প্রকাশের সুরে একজন বলল – বুঝতে পারছি তোমার এখানে সমস্যা হচ্ছে। তোমার আসলে ভাল কোন মেসে উঠা উচিত, যাতে করে তোমার পড়াশোনায় কোন ধরনের অসুবিধা না হয়। কবির তাদের কথায় বুঝতে পারল তারা তার সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছে।
নতুন মেসে উঠার তিন দিন আগে কবির কলেজ থেকে ফিরে গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকেছে। এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে বাথরুম থেকেই জিজ্ঞেস করল – কে? বাহির থেকে আওয়াজ আসে- আমরা পুলিশ, দরজাটা একটু খুলেন। পুলিশ শুনে সে থতমত খেয়ে তাৎক্ষণিক বুঝতে পারল না সে কি করবে। সে তাড়াতাড়ি করে কাপড় বদলে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলার পর সে দেখে – বাহিরে তিনজন পুলিশ আর তাদের সাথে কালো করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের একজন তাকে প্রথমে তার নাম পরিচয় আর এখানে কে কে থাকে তা জিজ্ঞেস করল। সে পুলিশের প্রশ্নের সঠিক করে সব উত্তর দিল। তারপর পুলিশের আরেকজন কালো করে ওদের সাথের ঐ লোকটাকে জিজ্ঞেস করল- দেখ তো এই ছেলে ছিল কিনা? লোকটা একটু চিন্তিত হয়ে বলে – স্যার উনারা দশ এগারজন ছিলেন। এই দশ এগারজনের মাঝে উনি ছিলেন কিনা সেটা মনে করতে পারছি না। তবে স্যার এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে ওরা সবাই এই বাসা থেকে বেরিয়ে আমার মাইক্রোতে উঠছিলেন। কবির ওদের কথা বুঝে উঠার আগেই এক পুলিশ বলে উঠল – আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। সে বলে – কেন, আমাকে থানায় কেন যেতে হবে? আমি কি দোষ করেছি? পুলিশ উত্তরে বলল – আজ দুপুর বারটার দিকে শহরতলি সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে দশ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারীরা সব পালিয়ে গেছে। কিন্তু ঐখানকার আশেপাশের লোকজন ছিনতাইকারীরা যে গাড়ি ব্যবহার করেছিল সে গাড়ি ও গাড়ির ড্রাইভার কে আটক করেছে। ঐ কালোমতো লোকটাকে দেখিয়ে সে বলল – এই হল সে গাড়ির ড্রাইভার। সবকিছু শুনে কবির ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পুলিশের হাতে পায়ে ধরে বলতে লাগল স্যার এসবের কিছুই আমি জানিনা, আমি ভাল ছেলে স্যার। আমি কোন ধরনের রাজনীতি বা সন্ত্রাসের সাথে জড়িত না। আমি স্যার তিনদিন পর এই মেস ছেড়ে চলে যাব। পুলিশ কবিরের কোন কথায় কান না দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেল ।
পরেরদিন স্থানীয় সব পত্রিকায় কবিরের নাম ঠিকানা ছবিসহ দশ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের খবরটা ছাপা হয়। খবরে লিখা হয় দিনে দুপুরে শহরতলি সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে দশ লাখ টাকা ছিনতাই। ছিনতাইকারীদের একজনকে পুলিশ আটক করেছে। তার সহায়তায় বাকিদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে। আশরাফ সাহেব স্কুল ছুটি দিয়ে রাহমানিয়া লাইব্রেরিতে বসে সেদিন স্থানীয় পত্রিকা পড়ছিলেন, তখন পত্রিকায় ছেলের ছবি দেখে সে ছবিতে তার চোখ আটকে গেল। তারপর পুরা খবরটা পড়ে উনি উনার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাই বারবার চোখ থেকে চশমাটা খুলে চশমার গ্লাসটা পরিস্কার করছিলেন। শরীর অবস হয়ে আসছিল, আর বারবার একটি বাক্য কানে ভাসছিল-মাস্টারসাব ছেলেরে শহরের কলেজে ভর্তি করিয়েন না,ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে। এইতো সেদিন এস এস সিতে এ প্লাস পাওয়ার পর মফস্বলের কৃতি ছাত্র হিসাবে কবিরের ছবি স্থানীয় সব পত্রিকায় ছেপেছিল। সেদিন আশরাফ সাহেব খুশিতে পরিচিত সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন -জানেন আমার ছেলের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সবাইকে তিনি সে ছবি দেখিয়ে বলেছেন-দেখেন দেখেন আমার ছেলের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই পত্রিকা আশরাফ সাহেব তার বিছানার নীচে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেদিন বাড়িতে এসে বিছানার নীচ থেকে পুরানো পত্রিকাটি বের করে ছেলের ছবি দেখার সময় আশরাফ সাহেবের চোখ থেকে টপ করে এক ফোটা অশ্রু মাটিতে পড়ল। সেই এক ফোটা অশ্রুতে মিশে ছিল একজন বাবার সহজ সরল কিছু মৌলিক স্বপ্ন।