মা দিবস উপলক্ষে সকল মাকে ভালবাসা জানিয়ে
রাত ১২টা পার হয়ে গেছে বেশ আগে। এখন ঠিক কয়টা বাজে জানি না। পি জি হাসপাতালের আট তালার গাইনি ওয়ার্ড এর সামনের লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটছি। রাত দশটার দিকে ডাক্তার এসে বলে গেলেন ----কাল সকাল সাতটায় আপনার অপারেশন হবে। -----এই টেনসনে কিছুতেই ঘুম আসছে না।
আজ সাত দিন আমি এই হাসপাতালে। কারন আমি এক্লেমশীয়ায় ভুগছি। মাত্র ৩৪সপ্তাহ তিন দিন হল, আর কাল অপারেশন করে বেবীকে আমার থেকে আলাদা করা হবে। বিভিন্ন ধরনের এলোমেলো চিন্তা, অহেতুক ভয়, ইত্যাদি নিয়ে হাঁটছি। সহরোগী এবং তাদের সহযোগীরা -------------সবাই বলছে শুয়ে পর, কাল ভোরেই অপারেশন । ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে মুস্কিল হবে। ---------------------
এখানে যে সব রোগী আসে তার খুব বেশি পাঁচ দিন থাকে। এরই মধ্যে একজনের সাথে অন্য জনের যে কত গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে তা সত্যি অকল্পনীয়।
হঠৎ এক খুব সিরিয়াস রোগীকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হল। সোজা লেবার রুমে। রোগীর আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্ন লোক জন এ করিডোর ভরে উঠল। আমি নিজেও আর রুমে গেলাম না । সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবার কথা শুনছি। রোগীর নাম নিপা। রোগীর অবস্থা খুব জটিল তাই ঢাকার এক বেশ নাম করা ক্লিনিক থেকে এই রোগীকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
কিছুক্ষন পরেই কোরিডোর খালি হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে আছে নিপার মা সাজেদা চৌধুরী, স্বামী জয়, শ্বশুর-শ্বাশুরী ও ননদ। লেবার রুম থেকে বেড়িয়ে এলেন একজন ডাক্তার। হাতে তার ফাইল।
বললেন,"রোগীর স্বামীকে? এই ফর্মে একটা সিগ্নেচার দিন। আর এখানে একটা টিক চিহ্ন দিন।"
আমাদের দিকে ফিরে বললেন, "এটা আমাদের একটা ফর্মালিটি। তবে আপনাদের রোগী এবং বেবী দুইজনেরই অবস্থা খুব একটা ভাল না । আমরা মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। যদি বেবী ভাল থাকে, সেটা খোদার ইচ্ছা। খোদাকে ডাকুন। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব। তবে আমাদের একজনের ব্যাপারে একটু শীথিল হতে হবে। আপনারা আল্লাকে ডাকেন উনি জান রক্ষা করার মালিক। আমরা সাধারনত মায়ের ব্যাপারে যত্নশীল হই, কারন মা বেঁচে থাকলে আবার ও সন্তান হবে।" খুব দরদ দিয়ে ডাক্তার কথাগুলি বললেন।
ফর্মটা জয়ের হাতে দিয়ে ডাক্তার বললেন,"এখানে টিক চিহ্ন দিন।"
সেই মুহুর্তে জয়ের মা বলে উঠলেন,"না আমাদের বাচ্চা চাই।"
চমকে তাকালাম মহিলার মুখের দিকে।
জয়ের বাবা বললেন,"আমাদের এই একটাই ছেলে। আজ দশ বছর পর বাচ্চা হচ্ছে । এর পরের বাচ্চা হতে হতে যদি আমরা না বাঁচি। আমরা বাচ্চা চাই।"
ডাক্তার তার হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠে ফর্মটা হাতে নিয়ে চলে যেতে চেয়ে ধমকে দাঁড়ালেন। একটা স্নেহের হাসি ছড়িয়ে দিয়ে জয়কে বললেন ,"আপনি ভুল জায়গায় টিক চিহ্ন দিয়েছেন। আসলে এই সময় মাথায় কিছু থাকে না। এইখানে টিক চিহ্ন দিন।"
জয় বলল,"না আমি ঠিক যায়গায় টিক চিহ্ন দিয়েছি , আমি বাচ্চা চাই।"
ডাক্তার তার অবিশ্বাস্য চোখ দুটী তুলে জয়কে বলল,"কি বলছেন আপনি!!!!!!!!!! মা না থাকলে ৯০% বাচ্চা জন্মের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই মারা যায়।"
জয় আবার ও দৃঢ় কন্ঠে বলল,"আমি বাচ্চা চাই।"
ডাক্তার বলল,"আমি এই ধরনের ফর্মে কখন ও কোন অপারেশন করিনি।"
জয়ের বাবা বললেন,"না করার কি আছে ? যেহেতু অপশন আছে তবে নিশ্চই অপারেশন হয়।"
ডাক্তার হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। লেবার রুম থেকে ততক্ষনে অপারেশন থিয়েটারে নেবার জন্য রোগীকে বের করা হয়েছে।
রোগীর মা সাজেদা চৌধুরীর দিকে চোখ পড়ল। ভদ্র মহিলা একটি প্রস্তর মূর্তির মত, হাতে তসবী আর জায়নামাজ বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন । চোখে তার কোন ভাষা নাই। শুধু বিড় বিড় করে নিজের আত্মজার মঙ্গল কামনায় দোয়া পড়ে যাচ্ছেন।
কী নিষ্ঠুর এই সমাজ, কী নির্মম আইন। আমার সন্তানের দন্ড মুন্ডের কর্তা এই এরা । বিবাহ নামক এক শৃংখলের মাধ্যমে যাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। আমার মেয়ে আমার না সে ওদের বাড়ীর বউ। তাই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার ওদের, আমার চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নাই। আমার মেয়ের নিজের ও ক্ষমতা নাই এই পৃথিবীতে সে থাকবে নাকি তার বাচ্চা থাকবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার। সাজেদা চৌধুরী চোখ বন্ধ করে যেন নিপার জন্ম মুহুর্তটির কথা স্মরন করার চেষ্টা করলেন।
শুরু হয়ে গেছে হৈচৈ। এবারে সব শিক্ষানবিশ ডাক্তারেরা। ডাক্তার লিজা জয়ের সাইন করা ফর্মটা হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল এক টানে। আর একটা ফর্ম আনল।
জয়ের সামনে ফর্মটা ধরে কলমটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
"এখানে সাইন করুন। আমি টিক চিহ্ন দিয়ে দিয়েছি।" জয় একবার তাকাল তার মায়ের দিকে, লিজা জয়ের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড রাগে চিৎকার করল,"ও দিকে তাকাতে বলিনি, এখানে সাইন করতে বলেছি।" জয়ের চারিদিকে ২০-২৫ জন ডাক্তার যারা সবাই শিক্ষানবীশ। ডাক্তারী শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী নেবার জন্য এখানে ভর্তী হয়েছেন।
নিপা কেমন যেন ঘোর লাগা চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বাধ্য ছেলের মত সাইন করে দিল, জয়। স্ট্রেচার ছুটে চলল। সেই সঙ্গে চলল ডিউটিরত ডাক্তারেরা আর জয়।
এই দৌঁড়েও পিছিয়ে পড়লেন সাজেদা চৌধুরী। তিনি অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছানোর আগেই বন্ধ হয়ে গেল থিয়েটারের দরজা।
নিপার মা সাজেদা চৌধুরী কোরিডোরের বেঞ্চে এসে বসলেন একা । ক্লান্ত, বেদনা ভারাক্রান্ত, অসহায় এক মা। সারাটা জীবন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। স্বামী একজন সরকারী কর্মকর্তা। তারপর ও কত অসহায়। খোদাকে বলছেন আমার মেয়ের হায়াত দাও,আমার মেয়েকে আমাদের আগে তুলে নিও না।
কিন্তু এদের এই নিষ্ঠুরতার কাছে যে তিনি পরাজিত। তার এত আদরের মেয়ে এই ভালবাসা শূন্য পরিবারে দিনের পর দিন থেকেছে অবাঞ্চিতের মত। দশ বছর সন্তান না হবার দায়তো আমার মেয়েটা একাই বহন করেছে। এবার ওরা নিপার মৃত্যু দন্ড দিয়েছে। ঐ সংসারে নিপা আবারও যাবে!!!!!!!!!!!????????????
তিনি মনে মনে ডাক্তার লিজার মঙ্গল কামনা করলেন, সে যেন সারাটা জীবন এমন ভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। তিনি ভাবলেন ডাক্তার লিজা যদি পারে তবে সে বা তারা কেন পারবে না অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে?
ঠিক আধাঘন্টা পরে একজন নার্স বের হয়ে বলল ----বাচ্চা নেন, ছেলে বাচ্চা, মা ভাল আছে, চিন্তার কিছু নাই।---- এবারে সাজেদা চৌধুরী আর হারলেন না। ক্ষিপ্র চিতার মত একলাফে নার্সের কাছে পৌঁছে গেলেন। হাতের জায়নামাজে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে বুকে তুলে নিলেন পরম মমতায়। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে আবার বেঞ্চ এ এসে বসলেন।
জয় ও তার মা এক মুখ হাসি নিয়ে এসে দাড়াঁল। বাচ্চাকে দেখবে বলে। বাচ্চাকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়াল বাচ্চার দাদী। বাচ্চাকে একটু আড়াল করে ধরলেন সাজেদা চৌধুরী, যার অর্থ বাচ্চা আমি আপনাকে দেবনা।
সাজেদা চৌধুরী জয়ের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভাবে বললেন," বাবা , তুমি যদি আমার মেয়ের সাথে সংসার করতে চাও, তবে বাচ্চাকে কোলে নেবার জন্য নিপার আনুমতি নিয়ে আমার কাছে আস। আমি তোমার ছেলেকে তোমার কোলে দেব। আর যদি তুমি সংসার করতে না চাও, কোর্টে যেয়ে বাচ্চা দাবী কর। কোর্ট যা রায় দেবে আমরা তা মাথা পেতে নেব, কিন্তু তার আগ পর্যন্ত বাচ্চা আমাদের।
সাজেদার চৌধুরীর চোখ জ্বলছে, যেন সে এক বাঘীনি মা , যে কোন মূল্যে সে তার বাচ্চাকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। তার চেপে বসা চোয়াল, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত , জ্বলন্ত আথচ ক্লান্ত ও স্নেহার্দ চোখ বলছে '''''''আমি মা'''''।
যজ্ঞাগ্ণি সম্ভূতা নারী এক।