বারডেম হাসপাতালের আইসিইউর করিডোর। প্রতিদিন এখানে অনেক স্বজনের আনাগোনা হয়। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সংক্ষিপ্ত রূপ আইসিইউ। বাইশজন রোগীর নিবিড় পরিচর্যা করা হয় এখানে। পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিধায় হীম শীতল নিরবতা ঘরটিতে। বাইশটি শয্যায় বাইশ জন রোগি। কেউ সুস্থ হয়ে চলে যান, কেউ সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। প্রতিদিন একজন দু'জন করে মারা যায় মূমুর্ষূ রোগিদের কেউ কেউ। খবর যায় স্বজনদের কাছে। তারা এসে আইসিইউর সামনে ভিড় করে। অটো সেন্সর যুক্ত কাঁচের দরজা খুলে দেয়া হয় লাশবাহী ট্রলি বের করার জন্য। স্বজনরা লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। লাশ একটি স্টিলের কফিনে ভরে লাশবাহী গাড়িতে তোলা হয়। স্বজনরা কাঁদতে কাঁদতে লাশবাহী গাড়ির সাথে চলে যায়। খালি হওয়া বেডে নতুন রোগী আসে। এভাবেই চলে আসা যাওয়ার খেলা।
আমার বাবা চারদিন হলো আইসিইউতে আছেন। বাইরে একটি নোটিশ বোর্ডে রোগিদের তালিকা টানানো আছে। তালিকার এক নাম্বার বাবা। জীবনের সবকিছুতে এক নাম্বার থাকা ভালো কিন্তু আইসিইউতে নয়। এক নাম্বার বেডের পাশেই দরজা। এই দরজা দিয়েই লাশ বের হয়। বাবা প্রতিদিন এক দুইটা মৃত্যু দেখেন। বাবার মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় জানিনা। আইসিইউর ভিতরে কেউ কাঁদে না। এখানে কাঁদার সুযোগ নেই। ডাক্তার নার্সরা নিরবেই বিদায় জানান লাশকে। নতুন রোগী আসে। আবার তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়।
আমি কল্পনায় নিজেকে দেখি। আইসিইউর এক নাম্বার বেডে শুয়ে আছি। শুয়ে থাকা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। সময়টা আমার কাছে থমকে আছে। দিন-রাত সমান মনে হয়। ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ডের কাঁটা আমার কাছে স্তব্দ হয়ে আছে। যে রোগির মৃত্যু হচ্ছে তার কাছে সময়ের হিসাবটা কি রকম?
প্রতিদিন নিয়ম করে ডাক্তার দেখে যায়। নার্সরা নিয়ম করে যত্নের সাথে ওষুধ পথ্য খাইয়ে দেয়। আমার অবাক লাগে এখানে আমাকে কিছুই করতে হচ্ছে না, কিন্তু আমি দিব্যি বেঁচে আছি। অনেক অসুস্থতা নিয়ে মানুষ এখানে আসে। বলা যায় যখন এখানে আসে তখন জীবন সায়াহ্ন প্রায়। শরীরের অর্গ্যানগুলো ঠিকমত কাজ করে না। মৃত্যুর প্রহর গুণতে গুণতে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। কিংবা বেঁচে থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আশি বছর বয়স মহাজাগতিক সময়ের কাছে কিছুই নয়। এই আশি বছরে আশিবার পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরেছে। এরকম লক্ষ কোটি বছর ধরে চলছে। আমি মাত্র আশি বছরের জন্য এসেছি। মহাকালের হিসেবে এই সময়টুকু কিছুই না। কিন্তু মানব হয়ে জন্ম নিয়ে কত কিছুরই না আয়োজন করি!
আমার শরীরে নানান যন্ত্রপাতি লাগানো। অক্সিজেন নল নাকে যুক্ত আছে। এই দীর্ঘ বছর বিধাতার ফ্রি অক্সিজেন ভোগ করেছি। এই অক্সিজেন শরীরে বহমান রাখার জন্য আমাকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। আর এখন কেনা অক্সিজেন দিয়ে আমার ফুসফুস সচল রাখতে হচ্ছে। এক সময় ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবে না। রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবে। সমস্ত অর্গ্যান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো আর সিগন্যাল পাঠাবে না। মৃত্যুর পর শুধুই মূল্যহীন লাশ মাত্র।
প্রতিটি মানুষকে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে-এটা চিরন্তন সত্য। মানবজাতি এ গ্রহের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ মস্তিষ্ক নামক একটি বুদ্ধির ভান্ডার তথা নিউরন সমৃদ্ধ ব্রেইন নিয়ে জন্মায়। এই নিউরণের কমান্ড দ্বারাই তার শরীর চলে। কর্ম করে, সংসার করে তারপর একসময় মরে যায়। নিউরণের কার্যক্রমও শেষ হয়ে যায়। এই ব্রেইনের ব্যবহার দ্বারা কেউবা বিশ্বের শাসনকর্তা বনে যায়। কেউবা অন্যের অধীনে থেকেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়। ক্ষমতাধররা অনেক প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েও মৃত্যুর কাছে হেরে যায়। বিজ্ঞান এই মৃত্যু রহস্য আজও ভেদ করতে পারেনি। বিজ্ঞান বিভিন্ন মারণাস্ত্রের সহায়তায় মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করতে পারে কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে এই দুনিয়ায় আর ফিরিয়ে আনতে পারে না।
মৃত্যুর ওপারে কি আছে তা দেখতে বিজ্ঞান অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে। মৃত ব্যক্তির রূহ বা আত্মার স্বরূপ কি বিজ্ঞান আজও তা নির্ধারণ করতে পারেনি। শরীরের সমস্ত অর্গ্যান কার ইশারায় সচল থাকলে আমরা তাকে জীবন বলি? মৃত্যুর মাধ্যমে ইহজাগতিক সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে চলে যেতে হয় ওপারে। নশ্বর দেহটা পরে থাকে এপারে। এপার আর ওপারের মাঝখানে কি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য আমার অস্তিত্ব ছিল এই গ্রহে? আইসিইউর বেড নাম্বার ওয়ানে শুয়ে আমার বাবার ভাবনা কি এরকমই?