আমরা অস্থির এক জ্ঞানের সময় পার করছি। অস্থির কণার জগত দ্বারা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি বলেই অস্থির জ্ঞানের সময়। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নাকি বিভিন্ন কণিকা এবং প্রতিকণিকায় পরিপূর্ণ। শুধু বলছেনই না, গবেষণাগারে কণা এবং প্রতিকণা সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতির সাথে ধরছেনও। কিছু কিছু কণিকা ভর পেয়ে পদার্থে পরিণত হয়। আবার কিছু ভর হারিয়ে শক্তিতে পরিণত হয়। যারা ভর পায় তাদের দ্বারাই আমাদের দৃশ্যমান জগত। আমাদের দৃশ্যমান জগতের অনেক কিছুই আবার অদৃশ্য। মাত্র পাঁচ শতাংশ দৃশ্যমান। আর বাকি পচানব্বই শতাংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। চোখের সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে যদি ম্যাটার বা পদার্থ হিসেবে দেখি তাহলে দেখতে পাব মাত্র পাঁচ শতাংশ!
মানুষের শরীরে কোষ আছে। কোষের ভিতর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ আছে। এই রাসায়নিকসমূহ বিভিন্ন অনু-পরমাণু দ্বারা গঠিত। প্রতিনিয়ত কোষ মরে যাচ্ছে আবার নতুন কোষ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু অণু-পরমাণুর মৃত্যু নেই। আমাদের দেহ ছেড়ে চলে গেলেও কণিকা আকারে অন্য কিছুতে আশ্রয় নিচ্ছে। একমাত্র মস্তিষ্কের নিউরণ আর চোখের কোষ জন্মলগ্ন থেকেই আছে। শরীরের বাকি সব কোষ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এছাড়া টেবিল, চেয়ার, মাটি, ফসল, গাছ, জীবজন্তু যা কিছুই দেখি সবকিছুই অতি পারমাণবিক কণার জোটবদ্ধতা।
অতি পারমাণবিক কণার জগতটা বড্ড রহস্যময়। পদার্থের কণাকে ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা পর্যায়ে আনা হয়েছে যে, সর্বশেষ কণাটি রহস্যময় আচরণ করছে বিজ্ঞানীদের সাথে। এই কণাটি নাকি ক্ষণে ক্ষণে তৈরি হচ্ছে আবার প্রতিকণার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে। শূন্যেই উৎপত্তি আবার শূন্যেই বিলীন। বিজ্ঞানীরা এটিকে ভ্যাকুয়াম ফ্ল্যাকচুয়েশন বলছেন।
রহস্যময় এই কণাটির ক্ষেত্রে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব বলে যে, ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র কণিকাদের ক্ষেত্রে ভরবেগ বা অবস্থানের মতো দুটি রাশির মান কখনও একসঙ্গে জানা যাবে না। কিছু অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। অনিশ্চয়তা নীতি মহাবিশ্বের একটি মৌলিক নীতি। এই নীতি অনুযায়ী কোন কণা একইসময়ে নির্দিষ্ট অবস্থান এবং ভরবেগ, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারবে না, শুধু সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আমরা বলতে পারব কণাটির এখানে থাকার সম্ভাবনা a% এবং সেখানে থাকার সম্ভাবনা b%। মজার কথা হল কণাটি সত্যিকার অর্থেই এখানে a% এবং ওখানে b% থাকে বা একইসময় কণাটি অনেক জায়গায় অবস্থান করে। এটাকে তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য মাল্টিভার্স থিয়োরি নামক একটি মজার থিউরির সাহায্য নেওয়া হয়।
একটা কণার ভিতরে একটি উন্নততর অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে উঁকি দিলে আমরা দেখতে পাবো নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ইলেক্ট্রন অবিরত ঘুরছে। অনেক ইলেক্ট্রন একসাথে ঘুরলেও দেখা যাচ্ছে না। মেঘের মত মনে হচ্ছে। ইলেক্ট্রন মেঘ। ফুলস্পিডে একটি ফ্যান ঘুরলে ফ্যানের পাখাগুলোকে যেরকম দেখা যায় এরকম অনেকটা। ইলেক্ট্রন যাকে কেন্দ্র করে ঘুরে সেই নিউক্লিয়াসকে ভেঙে প্রোটন-নিউট্রন পাওয়া গেল। প্রোটন-নিউট্রনকে ভেঙে কোয়ার্ক নামক কতিপয় কণা পাওয়া গেল। তাদের প্রতিকণাও পাওয়া গেল। এভাবে কণার সংখ্যা বাড়তেই লাগলো আর বিজ্ঞানীদের মাথা খারাপ হতে থাকলো। অবশেষে তারা স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামে মডেল উন্নয়ন করলেন। তাবৎ কনিকাগুলোকে ফার্মিয়ন আর বোসন কণিকায় ভাগ করলেন। ভরযুক্ত কণিকা আর ভরহীন কণিকা। ভরহীন কনিকারা একটি ফিল্ড বা ক্ষেত্র অতিক্রম করলেই ভর পায়। এটির নাম দেওয়া হলো হিগস ফিল্ড। এই ফিল্ডও কল্পিত গ্র্যাভিটন কণার জগত।
কণাগুলোর অতি পারমাণবিক জগতটা যতই পরিস্ফূট হতে লাগলো ততই চমকপ্রদ সব সম্ভাবনার দেখা পাওয়া যেতে লাগলো। পদার্থবিজ্ঞানে অতি পারমাণবিক জগতটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে পরিচিত। ১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্স তত্ত্বের জন্য নোবেল পান।
কণার জগত আর বল বা শক্তির জগত নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গঠিত এবং পরিচালিত। আমাদের পৃথিবী সূর্যের চারিপাশে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরছে। এর কারণ হচ্ছে একটা মহাকর্ষ বল বা গ্র্যাভিটি ফোর্স পৃথিবী এবং সূর্যের মাঝে কাজ করছে। এই গ্র্যাভিটি ফোর্সকে বিজ্ঞানীরা কণা কল্পনা করে তা ধরার অপেক্ষায় কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আমাদের পৃথিবী তার চারিপাশের সবকিছু নিয়ে ঘুরছে। মধুর পাত্রে একটি ঘুরন্ত মার্বেল যেমন গায়ে মধু মাখিয়ে ঘুরবে তেমন করেই পৃথিবী ঘুরছে। পৃথিবীর আশেপাশের কণা, তরঙ্গ, রশ্মি পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরছে। সূর্যের চারদিক দিয়ে ঘুরার সময় মহাকর্ষ বলের টানে বেঁকে গিয়ে স্থান কালের সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুর ভরের কারণেই নাকি এমনটা ঘটে।
কণার জগতে ইশ্বর কনা আর বল এর জগতে মহাকর্ষ বলই বিজ্ঞানীদের জন্য এখনও ধাঁধা হয়েই আছে। কণার এই সুক্ষ্ম জগতে বিচরণ করতে পারলে মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আলোর কণা ফোটনকে কাজে লাগিয়ে ডাক্তার রোবট বানিয়ে শরীরের শিরায় উপশিরায় এমনকি কোষ মেরামতেও কাজে লাগানো যায়।
(চলবে...)