সুসির ভিসাতে দিনাজপুরের হিলি বন্দরের ট্রানজিট উল্লেখ করা। আর আমারটা বেনাপোল। ফলে আমি এদিক দিয়ে পার হতে পারলেও সুসিকে হিলি দিয়েই পার হতে হবে। এরকম যে নিয়ম থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। সুসি আবার কাঁদতে শুরু করেছে। আমি অফিসারকে বুঝাই সমস্যার কথা। উনি অপারগ। আইন। কোনভাবেই বোঝাতে না পেরে চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। সাথে আতঙ্কও গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। একটু পরে রাস্তার উল্টোপাশের একটি রেস্তরাঁতে কিছু খাওয়ার জন্য দুজনেই বসেছি। সারাদিনের টেনশন, ধকল নিয়েও ভাবছি কী করা যায় এখন? চরম উৎকণ্ঠায় সুস্থিরভাবে কিছু ভাবাও কঠিন হয়ে পড়েছে। সুসিও মুষড়ে পড়েছে। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।
ঠিক এমন সময় আমরা যেখানে বসে আছি সেখান থেকে একটু দূরে দুটি রয়েল এনফিল্ট বাইকে করে চারজন ছেলে শাঁ শাঁ করে বাইক চালিয়ে এসে ইমিগ্রেশনের দিকে রওয়ানা হল।
সুসির দিকে তাকাতেই দেখি ওর চোখমুখে মনে হচ্ছে একবিন্দুও রক্ত নেই। ফর্সা মুখটা রক্তশূণ্য। ও জানালো ওদের মধ্যে দুজন ওর কাজিন। আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম।
সাথে সাথে রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়ানো এক অটোচালককে বললাম বনগাঁ রেলস্টেশনে চল। ঘড়িতে দেখি ছয়টা সতের। অটোতে উঠে চালককে বললাম শিয়াল দহের ট্রেন কয়টায় আছে। জানালো ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। রাস্তাতে মোটামুটি ভীড় আছে। আশে পাশে কোথাও বাজার বসেছে মনে হয়। ৭ কিলোমিটারের কাছাকাছি রাস্তা। রাস্তার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। চালককে বললাম ট্রেন ধরাতে পারলে পাঁচশ টাকা বকশিশ। নিশ্চয় সুসির কাজিনেরা পেছনে বাইকে আসছে। মারাত্মকভাবে আতঙ্কিত আমি। কিন্তু সুসিকে বুঝতে দিচ্ছি না। কারণ প্যানিক ছড়িয়ে পড়লে ও ভেঙ্গে পড়তে পারে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ওর কাজিনেরা অটো থামিয়ে সুসিকে টেনে হিঁচড়ে কলকাতায় ফেরত...। এই বিদেশের মাটিতে কি ভয়ঙ্কর অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে যদি ধরা পড়ি...।
ওকে মিছামিছি অভয় দিচ্ছি। কীভাবে যেন বনগাঁ স্টেশনে সময়মত এসে পড়েছি। দ্রুত টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনের মধ্যে দুজনে একটি কথাও বলি নি। অজানা ভয়ে দুজনেরই ভাবনার স্রোত এলোপাথাড়ি ছুটে চলেছে। ঘন্টা দেড়েক পরে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছালাম। শীতের রাত। শৈত্য প্রবাহের ফলে কনকনে ঠান্ডা। স্টেশন থেকে বের হয়ে নেতাজী সুভাস ইন্সটিউট পার হয়ে পাশেই রাজাবাজারের একটি মোটামুটি মানের হোটেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুম বুক করলাম। এর আগে হোটেলের কর্মচারী পাসপোর্টে দুজনের নাম দেখে বিটকেল মার্কা হাসি দিয়ে গাইগুই করছিল। শেষে কি মনে করে রাজি হয়েছে।
৫
হোটেলের রুমে প্রবেশ করেই সুসি আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এতদিনকার কান্নার শেষ দমকা হয়ত ভাবছে। আমার চোখেও জলের ধারা? এটা কি আনন্দের? নাকি ভয়ের! নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের!
ওর অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা তুলে ধরে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মুখটা আর একটু নামিয়ে এনে ওর চোখের পাপড়িতে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। নোনা জল শুষে নিয়ে যেন বোঝাতে চাচ্ছি আজ থেকে এভাবেই তোমার কষ্টগুলো শুষে নিতে থাকব প্রিয়।
ও মনে হয় লজ্জা পেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুম খুঁজতে শুরু করল। ওয়াশরুম চেক করলাম। ও ভেতরে গেলে রূমের সোফাটাতে ধপ করে বসে টাইম মেশিনে গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত সময়গুলো নিয়ে ভাবছি। সাথে এরপরের পদক্ষেপ কী নিব সেটা নিয়েও চিন্তা করছি।
হিলি বন্দর দিয়ে পার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ওখানে হাতের তালুর মতোই সুসির বাবাকে সবাই চেনে। সুসিকেও অনেকে চিনে থাকবে। নারায়ণবাবুর এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বড় কারবার আছে বন্দরে। হিলিতে গেলেই ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। আবার বেনাপোল বন্দরও এখন নিরাপদ না। কারণ ওখানে গিয়েও ওর কাজিনেরা ইমিগ্রেশন অফিসারদের বলে আসা বা ছবি দেওয়ার সম্ভাবনাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। চরম এক বিপদের মুখে আমরা। এলগরিদম মেলে না। সমীকরণের পদে পদে জট।
সুসিকে এত কিছু বললে ও হয়ত আবার ভেঙে পড়বে। ও বাথরুম থেকে বের হলে সুসির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল সারাদিনের এত এত কষ্ট সার্থক। কী নিষ্পাপ একটি মিষ্টি মুখ! সারাজীবন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে।
আমার হাভাতে তাকানো দেখে ও মনে হয় একটু আরক্তিম হয়ে উঠল। ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে বাথরূমে প্রবেশ করলাম। গায়ে পানি দেওয়াতে মনে হচ্ছে টেনশন কিছুটা নরমালে আসছে। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। বাথরুমের দরজায় মৃদ টোকা পড়ায় হুঁশ ফিরল। তাড়াতাড়ি বের হলাম।
রাত প্রায় দশটা। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। নিচে নেমে রাজাবাজার মার্কেটের কাছে মজিদ রেস্তরাঁতে খেয়ে নিলাম। রাজাবাজারের দিকে সুসিকে কেউ চিনতে পারবে বলে মনে হয় না? কারণ এটা কিছুটা মুসলিম প্রধান এলাকা। নিউমার্কেট এলাকার হোটেলে থাকলে উনারা খোঁজ করতে পারত। তাই বেশ আরামেই হাঁটছি ফুটপাত ধরে। দুজনেই ভাবছি। জানি না সুসির মনে এখন কি ঝড় চলছে? আমি নিজেও আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বেনাপোলের ঐ ঘটনার পর। এখন যে অবস্থা তাতে ভারত থেকে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে যাওয়ায় কঠিন হবে।
একটু হাঁটাহাটি করে মনে হল সুসির সাথে কোনো পোশাক-আশাক কিছু নেই। আশেপাশের সব দোকানও বন্ধ করে ফেলেছে। মহা ঝামেলা হল। এই মুহূর্তে নিউমার্কেটের দিকে যেতেও ভয় করছে। ওকে পোশাকের কথা বলতেই মুচকি হেসে জানালো ওর ঐ ঢাউস সাইজের ভ্যানিটি ব্যাগে এক জোড়া সুতির সালোয়ার কামিজ রয়েছে। আপাতত এইটা হলেই চলবে। আগামীকাল সকালে এ নিয়ে চিন্তা করা যাবে। দুজনকেই ক্লান্তি পেয়ে বসেছে।
রূমে ফিরে এলাম। রাত প্রায় এগারোটা। এই প্রথম সুসির উপস্থিতিতে আমার লজ্জা লাগতে শুরু করেছে। কিছু উদ্ভট চিন্তা মাথায় খুট-খুট খুট-খুট করা শুরু করেছে। ঝেটিয়ে বিদায় করলাম। হাজী লতিফুরের পোলা তুই। বেফাজিল, বেলাহাজ বলে নিজেকেই গালি দিলাম।
মেয়ে মানুষের কি অতিরিক্ত চোখ আছে নাকি? আমার এই হঠাৎ পরিবর্তন সুসির নজরেও পড়েছে। ও না বুঝার ভান করে বাথরূমে ঢুকে গেল।
এদিকে একটু পর পর বাথরূমের দিকে চোখ চলে যায়। মর জ্বালা দেখছি! চোখ বন্ধ করে সোফাতে মাথাটা পেছনদিকে হেলান দিয়ে ঝিমাতে থাকলাম। ক্লান্তি! একটুতেই মনে হয় তন্দ্রা চলে এসেছে। মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ ডাকছে, অয়নদা! এই অয়নদা!
কে ডাকছে ডাকুক! গালে, ঠোঁটে ভেজা কিছুর স্পর্শ আবছাভাবে বুঝতে পারছি। তবুও ক্লান্তিতে চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না।
একটু পরেই ডাক থেমে গেল। এখন স্বপ্ন দেখছি স্কুলের ইংলিশের মান্নান স্যার দারুন চাবকাচ্ছেন আমাদের ক্লাসের সবাইকে। কারণ আমরা উনার নাকের ভিতর রুমাল ঢুকে দিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গী করার দৃশ্য দেখে হাসছি। মারের চোটে ব্যাথায় উফ বলে উঠলাম। এরপরেই ঘুম ভেঙে গেল। কিছু সময়ের জন্য আধো অন্ধকারের ভিতর নিজের সেন্স পাচ্ছিলাম না। কোথায় আমি। খাটের দিকে তাকাতেই হুঁশ ফিরল।
আমার গায়ে একটি সাদা চাদর জড়ানো। কাপল বেডের একপাশে ব্লাংকেটের ভেতরে পা দুটো দ-য়ের মতো মুড়িয়ে মিষ্টি করে ঘুমাচ্ছে সুসি।
বাথরূম থেকে ফিরে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি। আমার এখন কি করা উচিত? আবার সোফাতেই আগের মতোই শুয়ে পড়ব নাকি বেডের এই পাশের ফাঁকা ব্লাংকেটের ভেতরে ঢুকে পড়ব। মনে তো হচ্ছে সুসি আমার জন্যই এভাবে শুয়েছে। কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছি! কী অদ্ভুত বৈপিরত্য মনের! টস করলাম কয়েন দিয়ে। হা, সোফা ভাগ্য কপালে। কাত হয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়লাম উপরের সাদা বেড কাভারটা দিয়ে যেটা সুসি আমাকে আগেই সার্ভ করেছে।
একটু পরেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলাম। আবার বহুদূর থেকে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে ডাকছে, অয়ন দা! এই অয়ন দা! উঠবে না!
চোখ মেলে তাকাতেই দেখি সুসি আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এভাবে ডাকছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
-এতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমাকে। তুমি শুনছই না। রাতেও ডাকলাম। তুমি এখানেই ঘুমিয়েছ।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে ও একনাগারে বলে যাচ্ছে। তার জন্যই আমাকে এত এত কষ্ট করতে হচ্ছে। রাতে বেডে ঘুমালাম না কেন? কেন তার জন্য এত কষ্ট করতে হবে? সদ্য জাগ্রত আমি সোফায় বসে আছি আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে সুসি নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেকেই অভিসম্পাত করছে। উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে দেখি ও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওর কাছে গিয়ে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার বুকে মাথাটা কাত করে দিয়ে আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরল। ওকে নিজের শরীরের সাথে একটু হাল্কা চেপে ধরার চেষ্টা করছি। ওর শরীরের তাপ এখন বেশ অনুভব করছি। সুসি কি কিছু টের পাচ্ছে? কারো মুখে কোনো কথা নেই। বেশ খানিকক্ষণ পরে ওর মুখটা তুলে ধরে বললাম, ‘দুষ্টু মেয়ে এবার যে সকালের নাস্তার জন্য নিচে নামতে হয়’। ও দেখি আমাকে আরো জোরে চাপ দিতে ত্থাকে। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি কিন্তু রক্ত মাংসে গড়া মানুষ; দেবতা নই, মাটির ডিব্বাও নই। সাবধান, রাজকন্যা সুস্মিতা রায় চৌধুরী’। আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে সুসির আহব্বান, ‘আমিও দেবী নই রাজকুমার অয়ন মাহমুদ চৌধুরী’। আমি ওকে এবার পেছন থেকে ঝাপটে ধরার জন্য এগিয়ে যেতেই শুনি দরজার ওপাশে মানুষের পায়ের ধুপধাপ এগিয়ে আসার অ্যাওয়াজ ও একটু পরেই বেশ জোরে জোরে দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ…? (অয়ন...ব্যাটা তু গ্যায়া...আবার আসিব ফিরে, এই রাজাবাজার হোটেলের তীরে...)
*********************************************
ছবি: লেখক। একপাশে ধর্ম, আরেকপাশে দুনিয়াদারী, পেছনে নতুন সম্ভাবনার সূর্য যা নানারকম প্রতিবন্ধকতায় নিমজ্জিত। রেডফোর্টের পাশে, পুরান দিল্লী, ভারত।
: ভালোবাসার গল্প: দ্বিঘাত সমীকরণ (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:২৬