সংযমের মাস শুরু হয়েছে। আর আমাদের অসংযমের গ্রাফও রকেট গতিতে উর্ধ্বমুখী ধাবমান। কাজে-কর্মে; চলনে-বলনে; আচারে-ব্যবহারে সবখানেই ভেজালে পরিপূর্ণ। মন যদি নিষ্কলুষ না হয় তাহলে কথায় কিংবা আচারে কি আর শুদ্ধতা আসে। আমাদের মন হয়ে গেছে অপবিত্র।
যেহেতু বিশ্বাসী তাই এই অপবিত্র মনটাকে শুদ্ধিকরণে সপ্তাহান্তে একবার হলেও পবিত্রঘরে যাই। কিন্তু সেখানেও হিংসার বীজ। মিথ্যা আস্ফলন। নিজেকেই নিজে সান্তনা দিয়ে শুদ্ধতার ভান ধরে বের হই।
কয়েক সপ্তাহ আগের এমনই এক পবিত্র দিনে শুভ্র পোশাকে উপস্থিত। তখন শ্রীলংকা জ্বলছে হিংসার আগুনে। কিন্তু এ নিয়ে পবিত্রঘরের নেতার মুখে একটি কথাও উচ্চারিত হতে শুনলাম না। আমি ভীষণরকম উৎসুক ছিলাম যে উনি কিছু বলুক এই বিপদগামীতা নিয়ে; এই মানুষগুলোর ভ্রষ্টাচার নিয়ে; এই ধর্মের নামে অধর্ম নিয়ে; এই মিথ্যা-পঙ্কিলতাপূর্ণ পথ নিয়ে; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য উনি একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। অথচ ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় পর পর তিন পবিত্র দিন উনি নানামুখী ইতিবাচক-নেতিবাচক আলোচনায় মুখর ছিলেন।
এবং ইনারা বিশিষ্ট ইসলামী বক্তা (উনাদের ভাষ্যমতেই)। গ্রামে-গঞ্জের মাহফিলের জন্য বছর খানেক আগে থেকেই ধর্না দিতে হবে। সাথে অগ্রিম। মহারাজা আসবেন আকাশ ডিঙিয়ে ধর্মের বানী শুনাতে। মাহফিলের বাড়বাড়ন্তে তৃতীয়বারের মতো হজটাও করা হচ্ছে না। এইসব বাগাড়ম্বরও শুনতে হবে পবিত্রঘরে বসে।
এখন আমি যদি এটিকে ভন্ডামী বলি, তাহলে কি আমি পাপিষ্ট হয়ে যাব; নরকে জ্বলব; তবে তাই সই।
একদিন বয়ানে শুনলাম মাজারপূজারীরা ভ্রষ্ট। আমারও কোনো দ্বিমত নেই এতে। উপমহাদেশের প্রায় সব বিখ্যাত মাজারেই গিয়েছি কৌতূহল বশত কিংবা পর্যটক বেশে; সেখানে ভালো কিছু দেখি নি; তবে ভালো কিছু শুনেছি কাওয়ালীর মুর্ছনায় ।
কিন্তু যদি নেতার মুখে এরকম শুনি যে-- এই মাজারপূজারী ভন্ডদের আজকের জমানায় নিজ হাতে জবাই করতেন যদি ঐ আওলিয়ারা আজ জীবিত থাকতেন।
শুনে জিহাদী জোসে উচ্ছসিত হয়ে শত শত মুসল্লী হৈ হৈ করে উঠলেন। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঐ বিশেষ দিনে পবিত্র ঘরে উপস্থিত কোনো সাইকো যদি জিহাদী জোসে সত্যি সত্যিই ভ্রষ্টদের কাউকে কতল করে ফেলে (প্রায়শই আমরা অবশ্য এরকম ঘটনা দেখতে অভ্যস্ত) তাহলে এর জন্য কে কে দায়ী থাকবে? আমি নিজেও কি কিছুটা দায়ী নই? কারণ আমিও তো পবিত্রঘরে সেই উগ্র বয়ানের অংশীজন ছিলাম কিন্তু এই উগ্রতাকে ঘৃণা করলেও কোনো প্রকার প্রতিবাদ করি নি।
২
বাহ্যিক লেবাস লাগিয়ে; চাকচিক্যময় মসজিদ বানিয়ে; মাহফিলে হাজারো ধর্মভীরু মানুষ জড়িয়ে; কথায় কথায় আজাবের ভয় দেখিয়ে; হুর-পরীদের কাহিনি শুনিয়ে লাভ কী? যদি সেই অতি দামি মনটাই অপবিত্রতার পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খায়; জীঘাংসার বাষ্পে বাষ্পীভূত হতে থাকে; ঘৃণার জালে হাসিমুখে বন্দিত্ব বরণ করে। ধিক, এমন আত্মাকে! ধিক, এমন কলুষিত লেবাসধারী মনকে!
আর এটাই দেশে-বিদেশে অনেক লেবাসধারীদের মনের ভেতরের চিত্র। এই ভীতিকর রূপ সাধারণ বিশ্বাসীদের পথে-প্রান্তরে, দেশে-বিদেশে জীবনকে কঠিন করে তু্লেছে, তুলছে, তুলবে।
ধর্ম যে শুধু টুপি-দাড়ি-তসবিহ-জোব্বা-পাগড়ি-পর্দা ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এটা ঐ লেবাসধারীর বেশিরভাগকে কে বোঝাবে? অথচ হওয়া উচিত ছিল এগুলোর পাশাপাশি বিস্তৃত মানবিক একটি মন।
বাস্তবতায় দেখছি-- আমরা যত বেশি এই দেখনেওয়ালা-লেবাসধারী ধর্মের দিকে ঝুঁকছি, ততবেশি উগ্র, অসংবেদনশীল, অসহিঞ্চু, অমানবিক, অসৎ, অসাধু, ও ভন্ডামীর চূঁড়াতে আহরণ করছি। চারপাশে দৃষ্টি ফেললেই এর সত্যতা নিরূপণে অবাক হতে হয় না।
কী মুসলিম! কী হিন্দু! কী ক্রিশ্চিয়ান! কী বুড্ডিস্ট! সকল ধর্মে, সকল জাতিতে, সকল সমাজে প্রায় একইরকম কর্কশ সুর ধ্বনিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাচ্ছি এক ঘৃনায় পরিপূর্ণ জীঘাংসামূলক পরিবেশ।
**************************************************************************************************
আখেনাটেন/মে-২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩৯