এবারই প্রথম বুয়েট কিউএস বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ বিশ্বের প্রথমসারির ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবেধন নীলমনি হিসেবে কয়েক বছর ধরে ঐ একই কাতারে থাকলেও বছর বছর অবনমন ঘটছে। ২০১২ সালে যেখানে ৬০০+ ছিল, সেখানে এখন ৮০১-১০০০ ক্যাটেগরিতে। পরের বছর পৈতা হারিয়ে ফেলতে হয় কিনা কে জানে? দেশের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিশানা নেই।
অথচ প্রতিবেশী ভারতের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ৫০০ বিশ্বসেরার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ২৪টি ভার্সিটি ১০০০’র মধ্যে। এর মধ্যে Indian Institute of Technology, Bombay (IITB): ১৬২তম; Indian Institute of Science, Bangalore: ১৭০তম। প্রতিবছর এগুলোর উন্নতি ঘটছে।
এমনকি জঙ্গীসমৃদ্ধ পাকিস্তানেরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথমসারি ৫০০'র মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। Pakistan Institute of Engineering and Applied Sciences (PIEAS): ৩৯৭তম; National University of Sciences And Technology (NUST) Islamabad: ৪১৭তম।
অনেক শিক্ষিত-অশিক্ষিতরা বলেন এই র্যাঙ্কিংকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই। আমি মনে করি এটা তারা বলেন অজ্ঞতাপ্রসূত। এই র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা একটি দেশের উচ্চশিক্ষার মেদ-মাংস-কংকাল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়। কারণ এগুলো নির্ধারণ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার হালহকিকত, সাইটেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিংকিং, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতসহ নানা ধরণের মাপকাঠির উপর বিবেচনা করে। তাই এগুলোকে গুরুত্ব না দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’।
২
মনে রাখতে হবে শিক্ষাও এখন একটি পণ্য। আর পণ্যের গুণগত মান যদি তথৈচব হয়, সে পণ্য আমরা উপায় না পেয়ে গলাধ:করণ করলেও সমঝদার মানুষ কিন্তু সেটা করবে না। তারা পরখ করে দেখে তবেই তা কিনবে।
আর এ জন্যই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে প্রায় ৩৪ হাজার ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৪৮ জন ছাত্র বিদেশি। এমন কি দেশের পয়সাওয়ালারাও আর এদেশের উচ্চশিক্ষার উপর ভরসা পায় না। ফলে দেশ থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পাশের দেশ কিংবা উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে।
যে মালয়েশিয়া আশির দশকেও বাংলাদেশের ইউনিগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিয়ে পড়তে পাঠাত, সেই মালয়েশিয়া এখন এশিয়ার অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র। লাখেরও উপর বিদেশী শিক্ষার্থী পড়ছে তাদের পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
শত কোটি টাকা গবেষণার জন্য বরাদ্দ করছে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। বিদেশ থেকে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। প্রায় প্রতিটি দেশে শিক্ষক নিয়োগে সহকারী অধ্যাপককে বেইজ ধরা হচ্ছে। মানে পোস্ট-ডক করা ছাড়া নিয়োগ নাই।
ব্রেইন ড্রেইন থেকে রক্ষা পেতে নতুন নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করছে। কিছুদিন আগে ভারতের মোদি সরকার সে দেশের আইআইটি থেকে মেধাবীরা যাতে উন্নত দেশে চলে না যায় সেজন্য ডক্টরাল ফেলোশিপ হিসেবে ক্ষেত্রভেদে ৮০ হাজার রুপী পর্যন্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভাবা যায়।
চীন মেধাবীদের দেশে ফেরত আনতে নানামুখী প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তুরস্ক নিজেদের উচ্চশিক্ষার খোলনোলচে পালটে ফেলেছে। ব্রেইন গেইনের জন্য উচ্চ বেতনে তাদের নিজেদের রিসার্চ ক্ষেত্রগুলোতে ডেকে এনে নিয়োগ দিচ্ছে।
এগুলো দেখেও কি আমাদের শেখার কিছু নেই। আর কতদিন অন্ধ হয়ে থেকে জাতিকে মৃত্যুকূপের দিকে টেনে নিয়ে যাব।
আমাদের শিক্ষাপণ্ডিত, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা কি এগুলো নিয়ে কখনই ভাববেন না? নাকি ক্ষমতা ও গদির মধু উনাদের বিবেক নামক বস্তুটিকে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন।
৩
ছোটকাল থেকেই আমরা ভাবসম্প্রসারণ মুখস্ত করে আসছি ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’। মানে মেরুদন্ড যেমন মানুষকে খাড়া রাখতে সাহায্য করে, সেরকম শিক্ষাও জাতিকে খাড়া রাখতে সাহায্য করে। অথচ আমাদের সেই শিক্ষা নামক মেরুদন্ড এখন কুঁজো হতে হতে মাটিতে খত দেওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে।
একজন সেইন মানুষও কি নেই উপরতলায়, যিনি এগুলো নিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
কেউ সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হলে লোকরঞ্জনবাদের ঢোল পিটিয়ে কয়েকটি চড়ামূল্যের নন-সাসটেইনেবল ফ্লাইওভারের উন্নয়নের চেয়ে জাতির আত্মিক ও মেরুদন্ডের উন্নয়নেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হবেন। যেমনটা, দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক, সিঙ্গাপুরের কুয়ান, মালয়েশিয়ার মাহাথিররা হয়েছিলেন ষাট, সত্তর ও আশির দশকে। ঠিক একই সময়ে সুহার্তো, ইন্দিরারা, আইয়ুব-ভুট্টো-জিয়াউলরা, মার্কোসরা লোকরঞ্জনবাদকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ফলাফলটা এখন আমরা দেখছি। কবে হুঁশ ফিরবে এ জাতির?
কিছু পরামর্শঃ
১। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সহকারী অধ্যাপক ছাড়া নিয়োগ না দেওয়া। এবং অবশ্যই প্রার্থীর বিদেশের হায়ার র্যাঙ্ক ইউনি থেকে পিএইচডির সাথে ভালো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের আন্তর্জাতিক জার্নালে দুই বা ততোধিক আর্টিকেল প্রকাশিত হতে হবে। পোস্ট-ডক থাকলে অগ্রাধিকার পাবে। পাশের ভারত-পাকিস্তান দুই দেশও তাই করছে।
২। পাবলিক ভার্সিটির ভিসি, ডিন ও শিক্ষক নিয়োগে একটি গার্ডিয়ান প্যানেল থাকবে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়ে। উনারায় এই নিয়োগে নিয়োজিত থাকবেন। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ এখানে দেখা হবে না। মেধায় চুড়ান্ত।
৩। দলীয় ছাত্র রাজনীতি চিরতরে বিলুপ্ত করতে করতে। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে সংগঠন থাকবে। ডাকসু-বাকসু-চাকসু-হাগসু'র নির্বাচিত সদস্য থাকবে, তবে অবশ্যই দলীয়ভাবে নয়।
৪। মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো করতে হবে। এবং অবশ্যই স্থায়ী শিক্ষক হতে হলে কিছু শর্ত পুরুন করেই তবে সে মর্যাদা পাওয়া যাবে।
৫। পাবলিক ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীর বেতন কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা দরকার। কেবল অসচ্ছল মেধাবীরাই বিনা বেতনে পড়বে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের জন্য বৃত্তি ও বিনা সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা সরকারীভাবে করতে হবে। বাকী সচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীরা মোটামুটি বেতন কাঠামোই পড়াশুনা করবে। এভাবে ইউনির আর্থিক সামর্থ বাড়াতে হবে। যেগুলো গবেষণা ও বুদ্ধিরৃত্তিক কাজে ব্যয় করা হবে।
৬। কঠোরভাবে শিক্ষকদের আমলনামা বছর বছর মুল্যায়ন করতে হবে। অযোগ্যদের আইনের আওতায় নিয়ে নিয়োগ বাতিল করে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ( এটা করলে পাবলিক ভার্সিটিগুলো ধূ ধূ মরুভূমি হয়ে যাবে এতে কারো সন্দেহ আছে কী?)
৭। সর্বোপরি মাথামোটা রাজনীতিবিদ- সর্ব বিষের হাতুড়ে ওঝা আমলারা ও অসাধু শিক্ষাগরুরা যাতে কোনোভাবেই উপরের বিষয়গুলোতে নোংরা নাক গলাতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এরপরও কেউ নাক গলালে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইটের লেজে বেঁধে মহাকাশে নিক্ষেপ করতে হবে।
আর এগুলোর জন্য একজন সত্যিকারের…(নিজেরা পুরুন করুন)।
*********************************************************************************************
@আখেনাটেন/এপ্রিল-২০১৯
এ বিষয়ে আমার আগের লেখাগুলো পড়তে চাইলে:
*বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার লেজেগোবরে অবস্থাঃ অচিরেই কি আমরা একটি মেধাহীন জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি????
*বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অভ্যন্তরীণ র্যাঙ্কিং জরুরী হয়ে পড়েছে?
*বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক হিসেবে আমাদের গড়ে তুলছে?
*বাংলাদেশের শিক্ষার মান কী এতটাই খারাপ!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৪০