মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে এই লোকটা ইউরোপীয় বুর্জুয়াদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। প্রায় পাঁচশ বছর পরে আবারও সেই একই ব্যক্তি শুধু বাংলাদেশেরই নয় আরোও প্রায় কয়েক ডজন দেশে হানা দিয়েছে।
উপরের ছবিটা দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির রাস্তার পাশের একটি বিলবোর্ড। তাহলে বুঝতেই পারছেন উনি শুধু বঙ্গোপসাগর তীরেই সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আক্রমন করেন নি, আটলান্টিকও পাড়ি দিয়েছেন।
সুলেমান সাহেব কী এমন ভেলকি দেখালেন যে বাংলার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে!! মিডিয়ার লোকদের রুটি-রুজির লুঙ্গি ধরে টান দিয়েছে। ভালো করে জানার জন্য অন্তর্জালে ঘোরাঘুরি করতেই যা দেখলাম তাতে তো চক্ষু চড়ক। এ ব্যাটা তো কামাল করে দিয়েছে মানে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে অনেক দেশে।
বলকানে খলিফার যুগ ফিরে এনেছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বে যত ড্রামা সিরিয়াল হয়েছে দেশে দেশে এই সুলতান সুলেমান (তুরস্ক ভাষায় অন্য নাম ) তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় একশটা দেশে এটি বিভিন্ন ভাষায় দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, গ্রিস, ইটালি, রাশিয়াও রয়েছে। তাহলে বুঝায় যাচ্ছে উনি উনার ঘোড়া প্রায় সব মহাদেশেই দাবড়িয়েছেন।
এ রকম একটি দর্শক প্রিয় সিরিয়াল দেশি লোকেরা দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
শুধু সুলতান সুলেমান নয় তুর্কি আরোও অনেক সিরিয়াল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঝড় তুলেছে। যার প্রভাবে বিশ্বের ড্রামা সিরিয়ালের তুর্কি নাচন দেখছে বিশ্ব।
বিবিসির এক রিপোর্টে দেখলাম একজন চিলিয়ানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কোথায় চিলি আর কোথায় তুরস্ক, তা এখানে কীভাবে তাদের ড্রামা সিরিয়াল দেখার জন্য মানুষ নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে। উনার উত্তর ছিল তুর্কিরা সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক দিয়েও প্রায় সমজাতীয় দেশ। আর ওদের সিরিয়ালে সাধারণ প্রেম-ভা্লোবাসা, মধ্যবিত্তের জীবন-প্রণালী, সুখ-দুঃখের চিত্র তুলে ধরে যা বর্তমানের হলিউডভিত্তিক সিরিয়ালগু্লোতে অনুপস্থিত—সেখানে শুধু যৌনতা আর সাই-ফাইয়ের ছড়াছড়ি যা ক্লিশে হয়ে গেছে কিছুটা। এই কারণগুলো সাথে তুরস্কের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখজুড়ানো দৃশ্যায়নের ফলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকাতেই এখন তুর্কি ড্রামা সিরিয়ালগুলো সুনামি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এখন বাংলাদেশের জনগণও যদি এই সকল সিরিয়ালের বাংলা ডাব দেখে পরিতৃপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে তো আপনি জোর করে নিজের অখাদ্য-কুখাদ্যগুলো খাওয়াতে পারেন না।
বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই তুর্কি সিরিয়ালের কদর বেশি। গতবছর তারা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সিরিয়াল বিশ্বের প্রায় শতের অধিক দেশে রপ্তানী করেছে। এবং তাদের লক্ষ্য আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে তা ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করানো। ১৪০ এর বেশি দেশে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ তুর্কি সিরিয়ালগুলো দেখেছে।
Merry Mahzabin নাম্নী একজন এই সম্পর্কিত লেখায় নিচের মন্তব্য করেছেন, ‘’
"সুলতান সুলেমান" যেমন ভাবে পুরো বাংলাদেশ কাঁপিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনই পুরো ভারত জুড়ে এখন তোলপাড় চলছে আরেক টার্কিশ সিরিজ "ফেরিহা" (#Feriha) নিয়ে। সেদেশের সোশ্যাল মিডিয়া এখন 'ফেরিহা' জ্বরে আক্রান্ত।
সাড়া জাগানো রোম্যান্টিক জুটি-- আমির এবং ফেরিহা (#Hazal_Kaya)। টার্কিশ ড্রামা সিরিজ 'ফেরিহা' বরাবরের মতোই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হবার পর ২০১৫ সালে শীর্ষ ভারতীয় সিরিয়াল হিসেবে নির্বাচিত হয় দর্শকপ্রিয়তার নিরিখে। এর আগের বছরই সিরিজটি মাতিয়েছিল পাকিস্তানি দর্শকদের(দর্শকদের দাবীর প্রেক্ষিত ৫ বার সম্প্রচারিত হয়)। তুর্কি সিরিজ 'ফেরিহা' কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় দর্শকদের মনও। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে এটি ভারতে দ্বিতীয়বার সম্প্রচারিত হচ্ছে এ বছর। এবং তৃতীয় বার পুনরায় দেখানোর জন্য দর্শকরা অনুরোধ জানাতে শুরু করে দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে "ফেরিহা" প্রিয় নাম।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা ধরনের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত 'ফেরিহা'র মত করে এত তুমুল ভাবে নাড়া দিতে পারেনি কোন কিছু। আমার জীবনে দেখা সেরা রোমান্টিক ট্র্যাজেডি।
ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন আকর্ষণীয় Scenic Locations, অসম্ভন সুইট Actor-Actress, অসাধরন Story Telling আর দুর্দান্ত অভিনয়- সিরিজটাকে এতো জনপ্রিয় করেছে। Roller Coaster Ride এর অভিজ্ঞতা পুরো সিরিজের বাঁকে বাঁকে। Full of twist & turns, ups & downs.
আশা করি, 'সুলতান সুলেমান' দেখানোর পাশাপাশি দীপ্ত টিভি বাংলাদেশের দর্শকদেরও (প্রতি পর্ব ১ ঘণ্টা করে) এটা দেখার সুযোগ করে দেবে। বিশ্বমানের জনপ্রিয় টার্কিশ সিরিয়ালগুলো বাংলায় ডাব করে সব চ্যানেলেই দেখানোর জোর দাবি জানাই। আন্দোলনরত মেধাহীন, অপদার্থ নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীদের ভাঁড়ামিপূর্ণ বস্তাপচা নাটকের চেয়ে এসব ডাবিং সিরিজ লক্ষগুন উৎকৃষ্ট। Dec 21, 2016 12:29pm’’
##'আকস লাফতান অানলামায' এই সিরিয়ালের জুটিও সম্প্রতি ঝড় তুলেছে গোটা উপমহাদেশেই।
মানুষ ভালো জিনিস টাকা ও সময় নষ্ট করে দেখবে। এটাকে মিথ্যা ধুয়া তুলে থামানো সম্ভব নয়। গোটা দুনিয়া হাতের মুঠোতে করে গ্রামের রাখাল বালক পর্যন্ত যখন ঘুরছে, তখন এই অতিশিক্ষিত নাকি অতি চালাক লোকগুলোর জানা উচিত এভাবে হয় না, সম্ভব না!!
অথচ এই লোকগুলোই কিন্তু রাস্তায় নামে নি যখন বাংলাদেশের বউ-বেটিরা বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত স্টার জলসা, জি বাংলা ও অন্যন্য বিদেশী টিভিতে বুঁদ হয়ে থাকত। এখন যখন সেই মহিলা দর্শকের একটা অংশ ভারতীয় টিভি সিরিজ থেকে মুখ সরিয়ে দেশি একটি চ্যানেলে দৃষ্টি দিয়েছে, অমনি এই অকাল কুষ্মাণ্ডরা একসাথে কা কা শুরু করেছে। এতে কি দেশের মানুষের মনেও সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে না কেন উনারা এতদিন চুপ ছিলেন ভারতীয় সিরিয়ালের বন্ধের ব্যাপারে? কেন মাঠে নামেন নি আদাজল খেয়ে?
হঠাৎ করে উনারা শিল্প-সংকৃতির ধারক ও বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন কেন? কেনইবা এতদিন কুম্ভকর্ণের ঘুমে ছিলেন? এর শানে নুযুল জানতে পারলে ভালো হত!!
বিবিসি বাংলার নিউজঃ
‘’বুধবার ঢাকায় বিদেশি টিভি সিরিয়ালের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেছেন, বিদেশি টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে চলেছে।‘’
আমার প্রশ্ন হচ্ছে গত দশ-বিশ বছরে বাংলা নাটক কখন সুপন্ন অবস্থায় ছিল? গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সিরিয়ালের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গলার রগ ফুলিয়ে চিল্লা-ফাল্লা করেও এই কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙ্গাতে পারে নি। আর আজ নিজের থেকেই ঘুম থেকে উঠে বাঁশ নিয়ে সুলতানকে দাবড়ানি দেওয়ার কারণ ঠাওর করা যাচ্ছে না।
জনপ্রিয় জিনিসের প্রতি প্রত্যেক মানুষেরই একটি সহজাত আকর্ষন থাকে। এখানেই সেটা ঘটেছে। আর এটা যদি সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি, অার্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পেরু কিংবা ইকুয়েডরে জনপ্রিয় হতে পারে, তাহলে যে দেশের মানুষ খেলাফতের পতনের জন্য ব্রিটিশদের দায়ী করে যুদ্ধ করতে পারে সেখানে তো পুপুলারিটি পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। এই লজিকটা কাজে লাগিয়ে নতুন চালু হওয়া একটা চ্যানেল বুড়ো বুড়ো চ্যানেলের কর্তা ব্যক্তিদের গাধার পর্যায়ে নেমে এনেছে। যতক্ষণে উনার বুঝে উঠেছেন ততক্ষণে এই সুলেমান মিঞা বিপ্লব ঘটে ফেলেছে।
এরপর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতে নিজেরাও কিছু বিদেশী সিরিয়াল ডাব করে ছেড়ে দিয়ে দেখছেন এই সুলেমান মিঞাকে যুদ্ধে হারানো তাদের কম্ম নয় তখন তারা জগত শেঠের ভূমিকাই অবতীর্ন হয়ে সুলেমান সাহবেকে কতল করার ফন্দি বের করেছে। কিন্তু বেরসিক জনগণ মাঝখানে বাগড়া দিয়ে শেঠজির চাতুরিকে আপাতত ঠেকিয়ে দিয়েছে। কে না জানে জনগণ সবসময় বীর পূজারী?
কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষই চায় না নিজের ভাষা-সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে অন্য সংস্কৃতিকে নিয়ে মেতে থাকতে। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে সবাই কোনটা তাল আর কোনটা মাতাল পার্থক্য করতে শিখে গেছে। এখন নির্মাতাদের জল অার জলপাইয়ের পার্থক্যকে বুঝতে হবে। জলপাইয়ের নাম করে জল খাওয়ালে দর্শকেরা সবাই খুশি নাও হতে পারে । একজনকে আবার বলতে শুনলাম আমাদের সিরিয়াল নাকি ওদের সাথে টেক্কা দিতে পারবে না! এই ছাগলদের কে বুঝাবে ১৮ কোটি ভোক্তা নিয়েও যদি একটা ভালো মানের সিরিয়াল বা ছবি বানাতে না পারে তাহলে এই সেক্টরে না থেকে অন্য দিকে নিজের রুজির ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। প্রতিযোগিতার বাজারে এভাবেই টিকতে হবে। না পারলে ক্ষ্যামা দেন!!!!
তাই দেশীয় সিরিয়াল ও ছবিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করতে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে মেধা ও মননের চুড়ান্ত পরাকষ্ঠা দেখিয়ে জীবন ও বিকাশের রাস্তা মসৃন রেখে কৃষ্টি ও কালচারের নবরূপ উন্মোচনের দ্বারা যথোপযুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে নবধারা সৃষ্টিই হচ্ছে এর প্রধানতম উপায়। আর তা নাহলে আমাদের সামনেই ধ্বংসের লেলিহান শিখাগুলো লকলকিয়ে বাড়তে থাকবে যা একটা নির্দিষ্ট সীমার পর অার কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না!!!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩৯