এমন একটা জগৎ কল্পনা করা যাক, যেখানে ফেইসবুক নাই। কী হবে? কোন সমস্যা হবে কি?
হ্যাঁ, শুধু ফেইসবুক না, এর বিকল্প হতে পারত এমন কোন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট পৃথিবীতে নাই ধরে নেই। মানুষ কি চলতে পারবে না? সময় কাটবে না?
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নয়, আসলে নিজেকে ফেইসবুকের আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার প্ল্যান করছিলাম অনেকদিন। সিগারেট যেমন একটা জঘন্য বাজে নেশা, ফেইসবুক আমার জন্য সেইরকম। আমার আর কোনরকমের নেশা নাই, একমাত্র ফেইসবুকে অর্থহীন সময় কাটানো ছাড়া।
মেশিনে লগইন করলে অটোমেটিক যা করি, ব্রাউজার খুলে গুগল ডট কম কে পাশ কাটিয়ে ফেইসবুকে ঢোকা। লাল রং এর নোটিফিকেশন গুলো দেখে শেষ না করা পর্যন্ত আর কিছু করতে পারি না। ৯০% সময় বিরক্তিকর নোটিফিকেশন, ৯% এক্সপেক্টেড লাইক আর কমেন্টস, ১% অপ্রত্যাশিত কিছু। এগুলো শেষ করে হোমপেইজ স্ক্রল করতে থাকা, স্ক্রল শেষ হবে না কোনকালে যতক্ষণ না আমার মনে হয় এগুলো আমি জানি। কী কী জানতে পারি হোম থেকে?
মানুষের স্ট্যাটাস – কিছু স্ট্যাটাস পড়তে মজাদার যেমন আরিফ আর হোসাইন, আরিফ জেবতিক, হাসিন হায়দার, রাসয়াত রহমান জিকো প্রমুখ। কিছু স্ট্যাটাস বিরক্তিকর যেমন যাদেরকে আমি চেষ্টা করেছি হাইড করে দিতে। কিছু স্ট্যাটাস এভারেজ – পড়লে মন্দ লাগে না, ভাল ও লাগে না। এখন কথা হল, এইসব স্ট্যাটাস পড়ে কী হবে? উত্তর – বিনোদন পাওয়া। না পড়লে আমার কিছুই যায় আসে না। ঐ ব্যক্তির ও কিছু যায় আসে না। কথাটা মনে হয় পুরো সঠিক হল না। স্ট্যাটাস পড়ে লাইক দিলে ঐ ব্যক্তির ভাল লাগবে, কমেন্ট করলে হয়ত খুশী হতে পারে। বস ব্যাক্তিত্বদের অবশ্য কিছু আসবে যাবে না।
হোম থেকে আরো জানা যায় – কে কোথায় কফি খাচ্ছে, কী খাওয়া দাওয়া করছে (ছবি সহ), কোথায় ঘোরাঘুরি করছে (ছবি সহ), কার কী ফিলিং (বাংলায় অনুভূতি), সম্পর্কের আপডেট (রিলেশনশীপ স্ট্যাটাস) ইত্যাদি। এইসব না জানলে আমার কোন ক্ষতি হবে না নিশ্চিত জানি।
কেউ একটা গান শেয়ার দিল, ফানি ভিডিও/ছবি শেয়ার দিল, বই পড়ে, মুভি দেখে জানাল কেমন লাগছে – এই অংশটা আসলে মিস করার মত। ভাল গান-মুভি অনেককিছু ফেইসবুক থেকেই প্রথম জানতে পারি। ব্যাকআপ হিসেবে আছে আইএমডিবি, সাউন্ডক্লাউড, গুডরিডস আর ইউটিউব। দেখা যাক কতদূর যাওয়া যায়!
আসল বিষয়ে আসা যাক মানে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং – বন্ধু তথা মানুষের সাথে যোগাযোগ। ফেইসবুকের সাথে থাকা মানে বহু মানুষের সাথে বাস করা। মনে হয় দুনিয়াটা মস্ত বড়, ফ্লোরিডায় থাকা বন্ধু ছুটিতে কোথায় ঘুরছে, ইউরোপে থাকা বন্ধু কেমন মাস্তি করছে, দেশের অবস্থা নিয়ে বন্ধুরা কি ভাবছে – সব আপডেট চোখের সামনে। আর ফেইসবুক ছাড়া থাকা মানে শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে থাকা। আমি, আমার ফ্যামিলি, কলিগস, খুব কাছের বন্ধু-বান্ধব-রিলেটিভ ছাড়া আর কেউ নাই। ছোট্ট পৃথিবী, এই জিনিসটা খারাপ লাগার মত।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি অন্তর্মুখী মানুষ, আমাকে যারা রিয়াল লাইফে চেনে তারা জানে। আমি ন্যাচারালি এমন, এটা পরিবর্তন যোগ্য না। আমার ভার্চুয়াল লাইফ রিয়াল লাইফের সাথে একেবারে মেলানো যাবে না। ভার্চুয়াল মানে ফেইসবুক লাইফে আমি অনেক বেশী সোশ্যাল। প্রচুর লাইক আর কমেন্ট দেই। দীর্ঘ সব স্ট্যাটাসে নিজের অবস্থা জানান দেই। অনেকের সাথে বেশ লম্বা সময় ধরে অনর্থক চ্যাট করি। ইচ্ছা না থাকলেও, ভাল না লাগলেও ভদ্রতার খাতিরে অনেকসময় কথা চালিয়ে যাই। এইসব করে রিয়াল লাইফের শূণ্যতা কাটানোর ব্যর্থ প্রয়াস করি। কাজের কাজ কিছু না, শুধু সময় নষ্ট করা। পাঁচ বছর ফেইসবুক লাইফে পাঁচজন সত্যিকার বন্ধু যোগ করতে পারি নাই যেখানে আমার ফ্রেন্ডসংখ্যা প্রায় সাতশ। বাস্তবে যাদের সাথে ছিলাম তাদের সাথে আছি, জীবন-জীবিকার তাগিদে সেই তালিকায় কেউ যুক্ত হয়েছে, কেউ দূরে চলে গেছে, এভাবেই চলছে – চলবে।
আর একটা ব্যাপার থাকে – বিশেষ কারো প্রতি অবসেশন। সময় পেলেই তার প্রোফাইলে চলে যাওয়া, সে কী করে, তার সাথে মানুষজন কি করতেছে, তার এলবামের সৌন্দর্য গবেষণা করা। নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এই বিষয় থেকে অনেকদিন হল পরিত্রাণ পেয়েছি। সত্যি করে তেমন কাউকে মিস করছি না। যখন করব তখন হয়ত ফিরে আসতে হবে, সেই পর্যন্ত আলভিদা।
সুতরাং, ফেইসবুক ছাড়া আমার চলবে। অনর্থক কারো সাথে কথা বলে যাওয়া বন্ধ হবে। নিজের জন্য কিছু লিখলে নিজের কাছে থাকবে, লাইক আর কমেন্টের নোটিফিকেশনের জন্য বারবার ফেইসবুক উঁকি দেয়া লাগবে না। সেই সময়টা বরং দেই পড়াশুনা, কাজ অথবা পছন্দের কোন বিষয়ে।
১২-৮-১৩