তোমার সাথে আমার বেসিকে মেলে না। - মাথাটা নিচু করে একটা ম্যাটাডোর কলম টেবিলের উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কষ্টে বলল শফিক।
কিসে মেলে না? – মেয়েটার চোখে উৎসুক প্রশ্ন।
বেসিক। মানে বুঝতে পারো নাই?
মেয়েটি জবাব দেয় না। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শফিকের দিকে।
শফিক এবার মুখ তুলে মেয়েটির চোখের দিকে তাকায়। ঐশ্বরিয়া কিংবা রানী মুখার্জীর মত বিড়াল চক্ষু। এই চোখের কথা মা তাকে আগেই বলেছে। শফিকের অবশ্য খারাপ লাগা দূরে থাক, উল্টো খুব করে ঐ চোখের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণের জন্য সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
আমি বুঝতে পারিনি।
ও হ্যাঁ। আমি আসলে বলতে চেয়েছি, আমি সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে। পড়াশুনায় একটা বয়স পর্যন্ত খুব সিরিয়াস ছিলাম। এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়েছি।
হুম, আম্মু বলেছে, আপনি ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বড় একটা জব করেন।
না সেটা না, আমি আসলে বলছিলাম, আমি প্রচুর গান শুনি। গান ছাড়া আমার চলে না। মাঝে মধ্যে টুকটাক গাইতেও ইচ্ছে করে, গলা ছেড়ে চিৎকার করি।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে আয়েশা হেসে দেয়।
শফিক আরো বিহবল হয়ে পড়ে, সে ভাবে মেয়েটার দাঁতগুলো আশ্চর্য সুন্দর! তার তখন ছোট চাচার বলা কথা মনে পড়ে, ‘সুন্দর হাসির সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে দাঁতে, দাঁত সুন্দর হলেই হাসি সুন্দর হবে, অন্যথায় নয়।’
আর কি কি করেন?
ওহ যা বলছিলাম। আমি প্রচুর মুভি দেখি, বাংলা-হিন্দী-ইংরেজি সব। তামিল
মুভি ও দেখি।
তাই?
হুম। তুমি টিভি-সিনেমা দেখ?
আমাদের বাসায় ডিশের লাইন নাই। মামার বাসায় মাঝে মধ্যে দেখেছি। আসলে ছোট বেলা থেকে না দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর খারাপ লাগে না।
তোমার অবসর কিভাবে কাটে?
আমি প্রতিদিন কোরান শরীফ পড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। বাসার কাজে আম্মুকে সাহায্য করি। ভার্সিটি খোলা থাকলে আর খুব বেশী সময় পাই না। আর আমি একটু অলস প্রকৃতির তো, তাই সুযোগ পেলেই ঘুমাই।
আয়েশার কথা শুনে শফিক চূড়ান্ত হতাশ হয়। অবশ্য হতাশ হবার খুব বেশী কারন নাই, এমনটাই সে ভেবেছিল। তবু সে আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে ঠিক করে।
তুমি গল্পের বই পড়ো না?
হ্যাঁ পড়ি। আমাদের বাসায় অনেক ধর্মীয় বই আছে, সেগুলো অনেকবার পড়েছি। গল্পের বই আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে এনে পড়ি। হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এগুলো পড়েছি। তিন গোয়েন্দা আর সেবার আরো অনেক বই পড়েছি।
ম্লান হয়ে যাওয়া শফিকের চোখ উজ্জ্বল হয় প্রথমবারের মত। তোমার প্রিয় বই কি?
শার্লক হোমস। আমি অনেকবার পড়েছি। আপনার প্রিয় বই কি?
সঞ্চয়িতা, কবিতার বই।
ওহ কবিতা তেমন ভাল লাগে না, বুঝি ই না আসলে। কিছু কবিতায়
আজেবাজে কথা লেখা থাকে।
শফিক আবার আহত হয়। সে টুকটাক গদ্য লেখার চেষ্টা করে, পদ্য শ্রদ্ধা করে। নিন্দুকেরা অহেতুক তাকে কবি বলে পঁচানি দেয়।
তুমি ঘুরতে পছন্দ কর? কোথায় কোথায় ঘুরেছ?
আমার ঘুরতে খুবই ভাল লাগে। ঘোরাঘুরির ব্যাপারে আব্বুর কোন নিষেধ নাই। আব্বু-আম্মুর সাথে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, সিলেট, কুয়াকাটা গিয়েছি। ঈদের ছুটিতে দাদাবাড়ি যেতে অনেক আনন্দ হয়, কাজিনদের সাথে ব্যাপক মজা করি।
দারুন। আমার ইচ্ছা কি জান পৃথিবীর সুন্দরতম সব জায়গা ঘুরব। বছরে একটা করে লম্বা ট্যুর দিব।
আচ্ছা এগুলো জিজ্ঞেস করছেন কেন? এগুলোই কি বেসিক?
শফিক ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর প্যাঁচায়া লাভ নাই। অল্প কথায় খুলে বলা মঙ্গলজনক।
হু, এসব নিয়েই আমার জীবন। তুমি ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছ একটা শৃঙ্খলের মধ্যে, নামাজ-রোযা কর নিয়মিত, কঠিন পর্দা মেনে চলাফেরা কর। এখন তুমি যদি ও ইডেনে পড়তেছ, আগে ছিলে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রী। আর আমি ধর্ম বিষয়ে বিরাট ফাঁকিবাজ। শুধু জুমার নামাজ পড়ি, রোযা রাখতে কষ্ট লাগে।
কোমল হাসি হাসি আয়েশার চেহারায় হঠাত করে কাঠিন্য চলে আসে। রাগান্বিত মুখে লালচে আভা।
আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন না? এমন ছেলেকে আমি কখনোই বিয়ে করব না। আমি যাকে বিয়ে করব তাকে অবশ্যই নামাজ পড়তে হবে, অন্য কিছুতে ছাড় দেয়া যায়, নামাজে না।
শফিক কিঞ্চিত ভয় পেয়ে চুপসে যায়। জবাব দেয় না।
আর আপনি কেন আজকে দেখা করতে আসলেন? আমি সুন্দরী কিনা দেখার জন্য আসছেন? আপনি তো জানতেন আমি কোথায় পড়াশুনা করেছি। আমার ফ্যামিলি প্রচন্ড ধার্মিক আর আপনার মত ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আমাদের স্ট্যাটাসে মিলবে না। সব জেনে শুনে কেন আসছেন?
শফিক আবার ম্যাটাডোর কলম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক কষ্টে সে সেই চোখজোড়ার মুখোমুখি হয়। আজকে না আসলে নিশ্চয়ই এই সুযোগ জীবনে আসত না।
আয়েশা আমি সত্যি করে বলি, আমি আসতে চাই নাই। বাবা কথা দিয়ে ফেলেছিল আমরা আসব। মা এক আত্মীয়ের বাসায় তোমাকে দেখে পছন্দ করেছিল, এর আগে সে কখনো আমার বিয়ের কথা ভাবে নাই। হ্যাঁ আমি জানতাম তোমার ফ্যামিলির ব্যাপারে, ইডেনে পড় সেটা জানি, আগে কোথায় পড়তে এই চিন্তা আমার মাথায় অনেক অনেক পরে আসছে। তখন আমি ঠিক করেছি সামনা সামনি কথা বলে ঠিক করব। আমি দুইজনের লাইফস্টাইল অনেস্টলি আলোচনা করতে চেয়েছি। কতটুকু কম্প্রোমাইজ করা যায় সেটা বুঝতে এসেছি।
আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতেসি না। আপনি এত বিব্রত বোধ করতেসেন কেন? সরাসরি বলে দিলেই পারেন, তোমার সাথে আমার ম্যাচ হবে না, বিয়ে সম্ভব না।
শফিক এবার আরো বিব্রতবোধ করে। কি জবাব দেবে সে জানে না। এমন হওয়ার কোন কারন নাই।
কারন কারন আমার তোমাকে ভাল লেগেছে। তোমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে। এখানে প্রকৃতির কোন রহস্য আছে মনে হয়। আমি স্ট্রেইট বলতে চেয়েছিলাম, তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আয়েশার লালচে মুখ আরো রক্তিম হয়ে ওঠে। সে আচমকা উঠে দাঁড়ায়।
আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।
কেন?
আমাদের বেসিকে মিলবে না।
আয়েশা দৃঢ় ভাবে হেঁটে দরজার ওপাশে চলে যায়।
পরের কয়েকটা দিন শফিকের ঘোরের মধ্যে কাটে। খাবারে রুচি নাই, গানে প্রাণ নাই, কাজে জোস নাই। কোন এক জোড়া চোখের মাঝে কিছু একটা হারিয়ে এসেছে। এলোমেলো এই অবস্থা দীর্ঘায়িত করলে বড়সড় ক্ষতির সম্ভাবনা। শফিক সিদ্ধান্ত নেয় এর সমাধান করার।
অনেক দিন ধরে তার কাছে আয়েশার মোবাইল নম্বর ছিল। দেখা হবার আগে বা পরে কখনো ফোন দেয় নাই। আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে শফিক একদিন রাতে আয়েশাকে ফোন দেয়।
দুইবার ফোন রিং করলেও কেউ ধরে না। আধা ঘন্টা বাদে মরিয়া শফিক আবার চেষ্টা করে।
হ্যালো।
আমি শফিক বলছিলাম।
কোন শফিক?
ইয়ে মানে আমি শফিকুর রহমান। তুমি কি আয়েশা। আমি তোমাদের বাসায় এসেছিলাম।
ও বুঝতে পারছি। আপনি? ক্যানো ফোন করেছেন?
আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিল…
ইনিয়ে বিনিয়ে অবশেষে আয়েশাকে রাজী করানো গেল দেখা করার জন্য। বৃহস্পতিবার দুপুর একটায়, লোকেশন কাঁটাবনের শর্মাহাউস।
এবার বলেন, কেন আসতে বলেছেন?
শফিক কথা বলে না, সে মুগ্ধ নয়নে বোরখা দেখে। আরব দেশীয় এই পোশাকের সৌন্দর্য সারাজীবনে সে খেয়াল করেনি। আয়েশার পোশাকটা সম্পূর্ন কাজ করা, অদ্ভুত সুন্দর।
তোমার বোরখাটা খুব সুন্দর।
জ্বী সেটা আমি জানি। আমার বড় মামা সৌদি আরব থেকে আমার জন্য পাঠিয়েছেন।
তোমাদের আর কে কে সৌদি থাকেন?
আমাদের পুরো ফ্যামিলি হুজুর। আপনি সব জেনে শুনে কেন দেখা করতে বললেন আজকে আবার? আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তাইনা?
নাহ, আমি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি কে কতটুকু ছাড় দিতে পারব
সেটা আলোচনার জন্য।
আয়েশা শফিকের করুন মুখ দেখে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে মুখ যথাসম্ভব কঠোর করে বলে,
দেখেন, আমার আব্বু-আম্মু আপনার ফ্যামিলিকে পছন্দ করেন, তাছাড়া আপনি শুনেছি ভাল ছেলে। তাই আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু নামাজের ব্যাপারে কোন ছাড় দিতে পারব না। আপনার গান-বাদ্য-বাজনা, মুভি, কবিতা, ঘোরাঘুরি কোন কিছুতে আমার না নাই, শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।
শফিক কিছুক্ষণ চুপ থাকে, সুন্দরী মেয়েদের সামনে কিছুতে ব্রেইন কাজ করে না। তবু বিকল মস্তিষ্কের কণাগুলোকে অনেক কষ্টে একীভূত করে সে বলে, তোমাকে বিয়ে করার জন্য যদি আমি সবকিছু মেনে নেই, পরে আমার মত চলি তাহলে কি ভাল হবে! কাউকে কোনকিছু জোর করা কি ঠিক বলো?
না ঠিক না। তখন আমি আপনাকে সাইজ করব।
দেখ, আমি কোন মেয়ের সাথে প্রেম পীরিতি কিছু করি নাই, ১০০% নিষ্পাপ একটা ছেলে, ঘুষ খাই না, নেশা করি না, গাজা-সিগারেট কোনকিছু জীবনে টাচ করি নাই, আমি কি খুব খারাপ? আমাকে তোমার জোরাজুরি করা উচিত না। তোমার লাইফ স্টাইলে আমার কোন আপত্তি নাই, আমাদের নিজেদের বেসিক ঠিক থাকবে, তার পরে আমরা এক হব।
এই পর্যায়ে আয়েশা হাসি থামিয়ে রাখতে পারে না। সে মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে।
মিষ্টি হাসি দেখে শফিক ভরসা পায়।
একটা বেসিক প্রশ্ন করব?
আয়েশা গম্ভীর হয়ে বলে, আবার কি বেসিক বাকী আছে?
তুমি কি জান মুক্তিযুদ্ধ কি? তুমি রাজাকারদের কি চোখে দেখ?
আয়েশার মুখ কালো হয়ে যায়। সে খুব মন খারাপ করে। সে চুপ করে থাকে।
শফিক বুঝতে পারে এই বেসিকে ও গন্ডগোল। নাহ এখানে কিছুতেই সে ছাড় দিতে পারবে না।
আয়েশা আস্তে আস্তে বলে, তুমি কি মনে কর ধর্ম কর্ম করলেই সে রাজাকার? আমি মাদ্রাসায় পড়তে পারি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানি, মুক্তিযুদ্ধের বই পড়েছি। যারা এই দেশের নিরীহ মানুষগুলিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে তারা মুসলমান জাতির কলংক। আমি তাদেরকে মনে প্রাণে ঘৃনা করি, সারাজীবন করব।
শফিক এবার জানে পানি পায়, যাক তার ভবিষ্যত প্রজন্ম আশংকা মুক্ত। আর কোন বাঁধা নাই।
---------------------------------------------২৫-৯-১২