বাইরের আবহাওয়াটা সেইরকম। ক’দিনের হাড় ঝলসানো রোদের পর আজ ভোর থেকে মেঘের আনাগোনা। পরম আকাঙ্খিত বৃষ্টি শুরু হল এইমাত্র। মন জুড়ানো হাওয়ার তীর কেটে ছোট্ট টিলা আর চা-বাগানের পাশ দিয়ে ছুটছে পারাবাত। এমন রোমান্টিক পরিবেশ ট্রেনের কামরার মানুষগুলোর মাঝে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মুখোমুখি বসে আছে চার যুবক। তাদের আড্ডার বিষয়বস্তুতে রোমান্টিকতার ছিটেফোটা নেই। পুরো কামরায় আক্ষরিক অর্থে তেমন কোন নারী নেই। তীব্র নারী সংকটেই তাদের এই দুর্দশা। বেহাল আলাপচারিতা চলছে অনেকটা এরকম –
রেশাদঃ তোরে আগেই বলছিলাম ঐ মহিলার চরিত্র খারাপ। এই জন্যে ওর অটিস্টিক বাচ্চা হৈসে।
আসিফঃ তোর মাথায় কোনো ঘিলু আছে নাকি নাই? চরিত্র ভাল-খারাপের সাথে বাচ্চার অটিজমের সম্পর্ক কি? এটা যে-কোনো ফ্যামিলিতে হতে পারে। (সে চরমভাবে আহত কথাটা শুনে)
রেশাদঃ আরে এইটা হল পাপের ফল। সে পাপ করছে, দুনিয়ায় আল্লাহ তার শাস্তি দিছে। কিরে জিহাদ ঠিক কইছি না?
জিহাদঃ কি? হুম হুম। (জিহাদ একটু তন্দ্রার মধ্যে আছে। ঝিকঝিক শব্দে সে কথা ঠিকমত শোনেনি। কিন্তু আল্লাহ, পাপ, শাস্তি এসব শব্দ শুনে নিশ্চিন্তে সায় দিয়েছে)
সাকিবঃ ঐ গাধা, কথা ভালমত না শুনে হুম-হাম করিস ক্যান? তুই বুঝছস কি নিয়ে কথা হৈতেসে?
জিহাদঃ ক্যান? কি হৈসে?
এভাবেই আড্ডা আর ট্রেন চলতে থাকে সমান্তরালে। আড্ডার বিষয়বস্তু কোনো মহিলা না, অটিজম ও না। আসল বিষয় নাস্তিকতা কিংবা আস্তিকতা। আদি-রস, নারীরূপ এসব নিয়ে আলাপ করার সেই দিন আর নাই। যুবসমাজে নাস্তিকতা এখন সবচেয়ে হিট আইটেম।
একজন নাস্তিক হিসেবে দিন দিন গর্বে রেশাদের বুক ফুলে উঠছে। শুধু বুক নয়, গালদুটো ফুলে ঢোল হয়েছে, ভুড়ি হয়েছে মাশাল্লাহ। আজকাল খালি গায়ে তাকে অন্যকিছু ভেবে ভ্রম হয়।
জিহাদ আল্লাহর একজন খাঁটি বান্দা। রাতে একটা হিন্দী সিনেমা দেখে, ক্লিন শেইভ করে সে ঘুমিয়েছে। সিলেটে পৌছতে পৌছতে তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি উঠে যাবে বলে আশা করা যায়। ইদানীং জিহাদের অন্যতম কাজ ইউটিউব থেকে ওয়াজ ডাউনলোড করে শোনা। আর তার প্রিয় গায়ক আজারবাইজানে জন্মগ্রহন করা সামী ইউসুফ।
আসিফকে দেখলে মনে হয় একটা কাকতাড়ুয়া। চাপা-চুপা ভেঙ্গে একাকার। মানুষ হিসেবে সে ভেজাল। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে বিশ্বাস করে কিন্তু নামাজ-রোজার ধার ধারে না। রোগশোকে প্রায়ই আক্রান্ত হয়, তখন মনেপ্রাণে আল্লা আল্লা করে।
সাকিব আছে ঘোরের মধ্যে। এই দেখা যায় সে নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলছে, আবার দেখা যায় আস্তিকদের পক্ষে বলছে। এমনিতে সে খুব কম কথা বলে। দোদুল্যমান অবস্থায় তার দিনকাল বেশ ভাল যাচ্ছে। ক’বছর যাবত সাকিব দাঁড়ি রাখছে, কারন তার ছাত্রী বলেছে দাঁড়ি রাখলে তাকে সুন্দর দেখায়।
আসিফঃ রেশাদ, তুই কি আগে বানর ছিলি? তারপর ক্রমে বিবর্তন হতে হতে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিস।
জিহাদঃ ডারউইনের এই মতবাদে বিশ্বাস করিস?
রেশাদঃ আসলে ব্যাপারটা ঠিক বানর নয়। তবে আগেরকালের মানুষের যে নমুনা পাওয়া গেছে তাতে এটা প্রমানিত মানুষের আকার অন্যরকম ছিল। তারপর বিবর্তন কিছু হয়েছে।
আসিফঃ কিন্তু আজো কিছু বানর রয়ে গেছে। আফসুস তারা কেন মানুষ হইলো না।
রেশাদঃ তুই তো ব্যাটা লুল। কোন মেয়ে দেখলেই আপু আপু করে লুলাতে থাকিস।
আসিফঃ আর তুই খুব ভাল পুলা। ফেইসবুকে মেয়েদের পারসোনাল ছবিতে গিয়ে কমেন্টাস।
রেশাদঃ ব্যাটা, ঐ মেয়ে আমার ফ্রেন্ড।
আসিফঃ আর উনি আমার বড় আপু।
জিহাদঃ লুল মানে কি বাচ্চা ছেলে? মুখ দিয়ে লোল পড়ে? (নিষ্পাপ জিজ্ঞাসা)
ব্লগীয় পরিমন্ডলে জিহাদ নাদান পাব্লিক। তাকে লুল বুঝাতে রেশাদের বারটা বেজে যায়। প্রাক্টিকাল বোঝানোর জন্য ট্রেন থামে কোন এক অজপাড়াগায়ে। বেনী দুলিয়ে কয়েকটি কলেজ পড়ুয়া তরুনী হেটে যায় রেললাইনের পাশ দিয়ে। তৃষ্ণার্ত নয়নে চার যুবক চেয়ে থাকে যতক্ষন শূন্যে মিলিয়ে না যায়।
জিহাদ প্রথমে বলে, “শেষেরটা সোন্দর আছে।”
আসিফঃ হুম, শেষের মেয়েটা সুন্দর।
রেশাদঃ হ, ভালই। (দীর্ঘশ্বাস)
সাকিবঃ খিক খিক।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করে।
-------------------------------------------------