আকাশলীনা]
আশ্বিন ১৪১৮ :: সেপ্টেম্বর ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০৩
----------------------------------------------------------------------------------
:: পাঠ-পূর্বক বিজ্ঞপ্তি ::
আকাশলীনা- এটি একটি ছোট পত্রিকা।
তবে, বন্ধুকে কাছে পাওয়া, বন্ধুর সঙ্গে থাকা; গান-সিনেমা-বই; আড্ডা আর গল্পে মজতেই আকাশলীনা-র জন্ম।
বন্ধুর কাছে মনের কথা বলার মূলমন্ত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও, এখন এটি মুক্ত প্রাণ আর স্বপ্নের সোপানের প্রত্যাশী।
প্রতি বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে মুদ্রণ কাগজে এটি প্রকাশিত হয়। বলা যেতে পারে, সাদাকালোয় প্রকাশিত ২৪ পৃষ্ঠার এটি এক রঙিন স্বপ্নের গল্প!
যে কোনো বিষয়ে, যে কেউই লিখতে পারেন এখানে।
লেখক-পাঠক আর বন্ধুতার মেলবন্ধন সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
এখানে মূল পত্রিকার বর্তমান সংখ্যাটি অনলাইন পাঠকদের জন্য সরবারাহ করা হয়েছে। ভালোলাগা-মন্দলাগা বিষয়ে যে কেউই মন্তব্য করতে পারেন।
পত্রিকাটির মুদ্রিত কপি নিয়মিত পেতে চাইলে; ফোন নম্বরসহ ডাক-ঠিকানা লিখে জানাতে পারেন। নতুন সংখ্যা প্রকাশের পরপরই পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়...
আমাদের সম্পাদনা পরিচিতি এবং সরাসরি যোগাযোগ করার ঠিকানা এই লেখার নিচে উল্লেখ আছে।
ধন্যবাদ।
-সম্পাদক।
----------------------------------------------------------------------------------
মূল পত্রিকা এখান থেকে শুরু-
----------------------------------------------------------------------------------
:: সম্পাদকীয় ::
বর্ষা ঋতুর অবসানে অপূর্ব শোভা মেলে দিয়ে আবির্ভূত হয় স্নিগ্ধ শরৎকাল। ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় জমে শিশির। বনে-উপবনে ফুটে ওঠে কতো বিচিত্র সুন্দর ফুল- শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনি, মাধবী! বিলে-ঝিলে হাওয়ায় দুলতে থাকে শাপলা। কাশফুল আর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব, নদীর জলেতে যেনো একাকার হয়ে যায়। এমন ঋতুতে নেচে ওঠে হৃদয়, রচিত হয় কবিতা, ভেসে আসে গান...
এদিকে শরৎ মানে শুভ্রতা, এই শুভ্রতার সবটুকুনই যেনো পূর্ণতা পায় শারদীয় দুর্গা পুজোর মধ্য দিয়ে। আকাশলীনা তাই এবারের সংখ্যা সেজেছে শরতের কাশফুল আর শারদীয় শুভ্রতায়।
তাই তো শরৎ ও পুজোর শুভেচ্ছা সকলকে...
আমাদের কথাসাহিত্যিক, জীবন্ত কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি এখন দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন।
কবি সরকার আমিন-এর কথার সূত্র ধরেই বলি- কিছু মানুষ আছেই এমন, যাঁরা জলে পড়ে গেলে মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন; আগুনে পড়লে পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হন। প্রবাদতুল্য এই সাহিত্যিকও, ক্যান্সারকে জয় করে আমাদের মাঝে জীবন জয়ের এক অপূর্ব কাহিনি নিয়েই ফিরে আসবেন- এই আমাদের বিশ্বাস। মানুষটার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা...
সবার ভালো হোক- আমাদের সঙ্গে থাকুন... []
----------------------------------------------------------------------------------
:: শরতের গদ্য ::
এ আমার শরৎবেলা
মিজানুর রহমন মিজান
এসেছে শরৎ, তাইতো হিমেল পরশ লেগেছে ঘাসের পরে। সত্যিই তাই- ভোরবেলায় খালি পায়ে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটলেই টের পাওয়া যায়, শরীরটা কেমন শিরশির অনুভূতি জাগিয়ে মেতে উঠছে।
কদিন আগেও আকাশজুড়ে ছিলো শ্রাবণের মেঘে ঢাকা। সারাদিনই টানা বৃষ্টিপাত। কিন্তু এখন, এই আকাশে সেই কালো মেঘের ঘনোঘটা নেই। নেই ঝমঝম বৃষ্টির দাপট। চেয়েই দেখো না- আকাশটা কেমন কাশফুলের মতো পবিত্র। রাতে ধবল জোছনার তো কোনো তুলনাই চলে না... হ্যাঁ, এটাই শরতের শোভা। রকমারি রূপের বৈচিত্র্য।
শরৎকে বলি আমরা ঋতুর রাণী। অন্যান্য ঋতুর মতো, শরতেরও রয়েছে আলাদা কিছু নজরবাড়া রূপ। এ সময়টায় নানা রূপে-বর্ণে সেজে ওঠে নির্জন সবুজ প্রকৃতি।
শরত মানে কাশফুল- এটা যেনো একে অপরের পরিপক্ক। নদীর দুপাড়ে, শুভ্র কাশের সভা দেখে, কতো পথিকই যে থমকে যায়; এ হিসাবটা সব সংখ্যাই অতিক্রম করবে। নদীতে, নৌকার মাঝিরা গেয়ে ওঠেন ভাটির টানে মাটির গান। শাদা বক আর মাছরাঙা মেতে ওঠে আপন খেলায়। শরতের শিউলি ও হাসনাহেনার সৌরভকে যখন, বিকেলের হিমেল বাতাস ছিনিয়ে নেয় আরো দূর-বহুদূর... হৃদয়ের গহীন কোণ তখন মাতোয়ারা শুভ্র-স্বপ্নীল ঘোরে।
খালে-বিলে টইটম্বুর জলের স্নিগ্ধতা। শাপলা-শালুক দোল খায় আপন খেয়ালে। দুষ্টুর দল উলঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়ে জলকেলি-মগ্নতায়। অনেকেই পাতিহাঁসের মতো ডুব দিয়ে তুলে আনে শালুক। কেউ-বা বসে যায় শাপলার মালা গাঁথতে।
শরতের আকাশ যেনো দুধে ধোয়া বিশাল থালা! শূন্যতার মেঘগুলো শিমুল তুলোর মতো নরম পালক মেলে, তিরতির করে বয়ে যায় আকাশের ঠিকানা ছাড়িয়ে...
প্রকৃতির এই অপরূপ বৈচিত্র্যের ভিড়ে, শরতের ভিন্ন ভয়ানক রূপও দেখেছি আমরা! গত কয়েক বছর ধরে, দেশের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলগুলো ডুবে থাকে শরতের একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত। এই বন্যায় প্লাবিত মানুষগুলোর সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগে আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
আমাদের হদয়টা যেনো শরতের আকাশের মতো মেঘমুক্ত, জোছনার মতো কোমল হয়ে উঠুক। []
::
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
----------------------------------------------------------------------------------
:: কবিতা-১ ::
করমজলে বিস্রস্ত দুপুর
এ. কে. আজাদ
নিথর-নীরব বনভূমি যেনো সবুজের অপার সৌন্দর্যখানি
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন।
একটার পর একটা নদীর জলের ঢেউ কেটে যতোই এগোচ্ছি
বদলে যাচ্ছে দিনের দীপক দুপুর।
করমজল পর্যটন কেন্দ্রে বসলো
ঢাকা ও খুলনার কবিদের কবিতার আড্ডা-
হলো কবি ও কবিতার মিলনমেলা।
স্তব্ধতা এখানে হন্তারক
আর আছে কিছু হৃদয় দোলানো দৃশ্যাবলী,
যেনো চিত্রশিল্পীর তুলির ডগার টানে
মনে হয় খাতার পাতায় খসড়া আদল।
বনবালা যেনো ব্রীড়াবনত ভঙ্গিতে করে খেলা;
বন-মোরগের ডাক শুনি,
হেতাল ও গরাণের বনে চিত্রা হরিণের পদচারণা
আড়ালে থাকেন বসে চিরকালীন
সেই বনের মামা এবং বানর; কালচে জলের ঢেউ
গোলপাতা ভরা পাল তোলা নৌকা, দেখি দক্ষিণ সাগর-
যারা বুকে জেগে থাকে নোনা পানির জোয়ার-ভাটা
তারই ফাঁক-ফোকরে, নদীজল বিধৌত গাছের গোড়ালি
নগ্ন পা জোড়া চারিদিকে ছড়ানো শিকড়-বাকড়
অবিরাম বয়ে যায় নদী-খাল-গাঙ-ভরানি...
দেখি থোকা থোকা সূর্যমুখী অর্কিড
এ যেনো অনাবিল সবুজ ক্রান্তীয় নিসর্গ আমার। []
::
পাবলাসাহা পাড়া, দৌলতপুর, খুলনা ৯২০২
:: কবিতা-০২ ::
আমার জন্মের কোনো ইতিহাস নেই
জিপসি রুদ্র
আমার জন্মের কোনো ইতিহাস, আমি কার ঔরসজাত
তার সঠিক কোনো তথ্য আমার মা-এর কাছে নেই
টুনটুনিবালার কাছে শুনেছি-
মুয়াজ্জিনের গগনবিধারী ডাকের সময় আমার জন্ম
মুয়াজ্জিনের গগনবিধারী ডাক এখন আমার কাছে আতংক।
এ পাড়ায় আমার অসংখ্য তরুণ-মাঝবয়সী বাপেদের আগমন
এদের মাঝে কেউ একজন আমার বাবা
আমি যখন ও-গলিতে যাই, সবাই আমাকে জারজ বলে
অথচ ওদের অনেকেই আমার এ পাড়ায় আসে
আমার মা-র স্তন চোষে
স্ফীত লিঙ্গের ধবল কষাঘাতে আমার মা-র জরায়ু জর্জরিত হয়
এদেরই কারো বীর্যের সংমিশ্রণে আমার জন্ম।
প্রতিদিন কুকুরের ডাকে আমার ঘুম ভাঙে
মুয়াজ্জিনের ডাকে আঁতকে ওঠি
বাপেদের পদচারনায় মুখরিত হয় আমার মা-র ঘর
আর-
মানুষের কাছে শুনি আমার জন্মের কোনো ইতিহাস নেই।
::
[email protected]
----------------------------------------------------------------------------------
:: গল্প ::
পোড়া চোখ
নাসির আহমেদ
শ্রাবণ পকেটে হাত চালিয়ে দেখে, বিশ টাকার একটা নোট। অতএব রিকশায় উঠা যাচ্ছে না। ফটোকপি করা প্রয়োজন। বারো টাকা খরচ হয়ে যাবে তাতেই, থাকবে তখন আট টাকা। পায়ে হাঁটাকেই শ্রেয় জ্ঞান মনে করছে শ্রাবণ।
খান জাহান আলী সড়ক ধরে হাঁটতে থাকে সে। অর্থের অভাব এর আগে এভাবে কখনোই অনুভব করেনি।
ভাবছে, একটা সিগারেট ধরবে। এবারের বাজেটে সিগারেটের দামও বেড়ে গেছে; তারমনে সস্তা সিগারেটও এখন দামি হয়ে গেছে। তাই সর্বনিম্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটেই অগ্নিসংযোগ করতে বাধ্য হয়।
প্রচণ্ড গরম পড়ছে। এক পশলা বৃষ্টি হলে বেশ হতো।
নিঃশব্দে পথ চলছে শ্রাবণ। প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলের সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। একটা শিশুর চার হাত-পা ঠিক যিশুর মতো বোর্ডের সঙ্গে বেঁধে রাখা! শিশুটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন শিক্ষিকা কি যেনো বলাবলি করছেন।
শ্রাবণের দেখেই ধারনা হয়, শিশুটার বয়স আটের বেশি নয়। নিজের অজান্তেই, হয়তো ভেতরের কৌতূহল থেকেই ওদের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শিক্ষিকা ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এনে বললেন, ‘আপনি কিছু বলবেন?’
‘জ্বি না।’
শ্রাবণ শিক্ষিকার এই বিরক্ততার ভাব এড়াতে কিংবা আর কোনো প্রশ্নবাণে না জড়াতে সামনে পা বাড়ায়। ফের পা চালাতে গিয়ে ওর ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করে- এ শিক্ষিকার সঙ্গে রূপার বেশ মিল আছে।
রূপা যখন ওকে ভালোবাসতো, তখন শ্রাবণের ব্যবসা রমরমা। তবে সত্যিই রূপা ওকে ভালোবাসতো কিনা; সে চলে যাবার পর, এ ব্যাপারে ওর ভেতর বরাবরই একটা প্রশ্ন জেগে ওঠেছে। আজ রূপার কথা ফের মনে হতেই, প্রশ্নটার একটা যুক্তি দাঁড় করাতে চেষ্টা করে সে- না, রূপা ওকে কখনোই সত্যিকারে ভালোবাসেনি। বাসলে, এভাবে সে অন্যের হয়ে যেতে পারে না! তিন বছরের সম্পর্কে, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই যখন সে বললো, ‘কাল আমার গায়ে হলুদ। মেয়েদের ব্যাপার, তোমার আসার দরকার নেই! তুমি বরং পরদিন বিয়েতেই এসো।’
শ্রাবণের মাথা ঘুরে ওঠেছিলো। এ কী!
রূপা এমনিতে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। শ্রাবণের হতভম্বটাকে সে আমলে নেয়নি। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে চললো, ‘অনেক ভেবে দেখেছি, ওই মানুষটা প্যারিসে ডাক্তারি করছে। আমি যদি সে ডাক্তারের স্ত্রী হতে চাই, তাহলে তো তাঁকে বিয়ে না করে উপায়ও নেই! তাছাড়া, এটা তো নিশ্চয় সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে কাজে দেবে আমার। তুমি ব্যবসায়ী মানুষ; আজ আছো ঠিক, তবে কাল যে লালবাতি জ্বলে ওঠবে না- এর তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন? হ্যাঁ, এ সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে তোমার অবস্থান থেকে দেখেছি, তুমি আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারো। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলো তো, স্বার্থপর কে নয়? নিজের আরো একটু ভালো, নিজেকে আরো একটু ওপরে কে দেখতে চায় না?’
এরপর আর কিসের প্রশ্ন, কিংবা কেমন করেই বা জোর-জবরদোস্তি চলে? রূপার এই রীতিমতো প্রতারণা শ্রাবণ মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কিছু তো করারও নেই। কেউ জেনে-বুঝে যখন প্রতারণায় নামে, তখন তাকে বোঝানোর অর্থ থাকে না। শ্রাবণ এসব ভাগ্যের পরিহাস ভেবে মেনে নিয়েছে।
পথ চলতে গিয়ে, আরো কিছু দূর এগোতেই ছেলেবেলার বন্ধু দিদারুলের সামনে পড়ে গেলো শ্রাবণ।
আসলে, ভাবনার স্রোতে এমন করে ভেসেছিলো শ্রাবণ; পথ চলছিলো ঠিকই, কিন্তু সামনের সবকিছু ওর চোখে দৃশ্যমান হলেও, মগজে কিছুই প্রতিক্রিয়া তৈরি করছিলো না। যে কারণে দিদারুল যখন ঠিক ঠিক ওর সামনে হামলে পড়লো, একেবারে চমকেই ওঠেছিলো বেচারা। চোখ বড় করে বলে, ‘আরে দোস্ত, তুই!’
‘হ্যাঁ, অন্ধের মতোই পথ চলছিস যেনো- দেখতে পাস না?’
শ্রাবণ হাসে। বলে, ‘ফরাজী পাড়ার দিকে যাচ্ছি। তা তুই দেশে ফিরেছিস কবে?’
‘এই শুক্রবারে। তোর বাসার সবাই? ব্যবসা কেমন চলছে?’
দিদারুলের এমন প্রশ্নে, ‘ভালোই।’ এই বলা ছাড়া আর কিছু ভেবেও পাচ্ছে না শ্রাবণ। তাৎক্ষণিকভাবে মানুষকে কেমন করে খারাপ সংবাদ দিতে হয়, তা আজও রপ্ত করতে পারেনি ও। ফের হাসিমুখ করে বলে, ‘আমার খবর বাদ দে, তোর খবর বল?’
‘আমারই বা আর খবর! বিদেশে পড়ে থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা কামাই। সামর্থের মধ্যে থেকে যা পারি, দেশে টাকা দিয়ে ভাই-বোনদের স্বপ্ন-শখ-ইচ্ছে, সবই পূরণ করতে চেয়েছি। ব্যবসা, জায়গা-জমিন সবকিছুই ওদের নামে করে, আজ আমি শূন্য-শূন্য, মহাশূন্য। বুড়ো বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? ওঁরা তো অশিক্ষিত, এসব কূট-কৌশলের কী-বা বোঝে? আবর এ নিয়েও উচ্চ-বাচ্চও করা যাচ্ছে না আর দশজন জানবার ভয়ে। সত্যি, মানুষ কী বিচিত্র!’
‘আসলেই!’
ওরা কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো। ফটোকপির দোকান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দোকানের সামনেই এক বৃদ্ধ আর তাঁর সঙ্গে এক তরুণীকে রিকশা থেকে নামতে দেখলো দুজনে। বৃদ্ধ লোকটার দুচোখে ব্যান্ডেজ; সে সঙ্গে তরুণীর হাতে এক্স-রে রিপোর্ট ও ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনের খাম। এখানে কি এঁরা ওষুধ কিনতে এলেন?
কেনো যেনো হঠাৎ করেই শ্রাবণের মনে হয়, চোখে দেখতে না পারলে মন্দ নয়! করুণা-অনুভূতির এক ভিন্নমাত্রা যোগ হবে মানুষের ভেতর। দিদারুলকে সে বলে, ‘দোস্ত, ওই বুড়ো লোকটাকে দেখ।’
‘দেখলাম। সঙ্গের সুন্দরী মেয়েটার কথা বলছিস?’
‘আরে দূর! না, মানে... চল, অন্ধ হয়ে যাই! অন্তত তোর-আমার, আমাদের সমস্যার ব্যাপারটা ভেবে দেখ...’
শ্রাবণ কি বলতে চাইছে, তার কোনো মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না দিদারুল। সে কথার মোড় ঘুরিয়ে বলে, ‘দোস্ত, এখন থেকে দেশেই আছি। সময়-সুযোগ করে তোর অফিসে যাবো, তখন জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আজ তো অনেক কথাই হলো, চলি।’
দিদারুল চলে যেতে চাইলে, শ্রাবণ হাত নাড়ে।
ওর ব্যবসায়িক অফিসে যেতে চায় দিদারুল! দেনার দায়ে পার্টনারকে তো সেই কবেই সব লিখে দিয়েছে। শ্রাবণের কেবলই মনে হয়, এক রূপা যেদিন ওকে ছেড়ে চলে গেছে; তারপর থেকে সবকিছুই হারাতে বসেছে সে। জীবন, যুদ্ধে, সবখানেই পরাজয় এসে বরণ করে নিয়েছে ওকে। ...এসব কথা সে দিদারুলকে কোনোভাবেই বলতে পারছে না। কি হবে? দিদারুল নিজেই তো ওর সংসারে উপক্ষিত; ভাই-বোনদের জন্য নিজের রক্তকে ঘাম বানিয়ে ঝরিয়েছে; আজ সেই ভাই-বোনরাই ওকে চেনে না।
শ্রাবণ ভাবে, ওই বৃদ্ধ লোকটাকে দেখিয়ে অন্ধ হয়ে যেতে বলেছিলো সে- দিদারুলকে যা বোঝাতে চেয়েছে সে, তাও পারেনি সম্ভবত।
এই মাত্র ফটোকপি করিয়ে নেওয়া কাগজগুলোকে, হাতের মধ্যে রেখেই ভাঁজ করে নেয় ও। তারপর সোজা রাস্তা পার হয়ে, মার্কেটের সিডির দোকানে ঢুকে পড়ে। দোকানিকে বলে, ‘ভাই, পোড়া চোখ কেনো তুই বন্ধ থাকিস না, কেনো তুই বন্ধ থাকিস না- নার্গিস পারভিনের গাওয়া এই গানটার অ্যালবামটা আছে?’
দোকানি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণের দিকে।
লোকটার এভাবে তাকিয়ে থাকার কোনো মানে খুঁজে পায় না শ্রাবণ। এই গান কি কেউ জীবনে কোনোদিন শোনেনি? নাকি লোকটা জানেই না, এমন একটা গান যে বাজারে আছে?
লোকটাকে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে দেখে, শ্রাবণ পিছিয়ে আসে। অ্যালবামটা পাওয়া যায়নি। ভালোই হয়েছে; পেলে, কিনবার মতো পয়শাও তো নেই ওর পকেটে।
কিছুক্ষণ একা একাই দাঁড়িয়ে থেকে, ফের রাস্তায় নামে শ্রাবণ... সিডি কিনে গানটা শুনতে পারবে না, তো কি হয়েছে? আপন মনে গানটা বাজিয়ে দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি তো নেই! তাই সে গাইছে- পোড়া চোখ কেনো তুই বন্ধ থাকিস না, কেনো তুই বন্ধ থাকিস না...
ওদিকে পাশের দোকান থেকে ভেসে আসছে, শিলা কি জাওয়ানি-র সুর! []
::
বানরগাতী, খুলনা ৯১০০
----------------------------------------------------------------------------------
আকাশলীনা]
আশ্বিন ১৪১৮ :: সেপ্টেম্বর ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০৩
কৃতজ্ঞতা :: হিমেল অনার্য
সম্পাদক :: নোমান ভূঁইয়া
[email protected]
সহযোগী ::
জাহীদ ইকবাল, সাবরিনা আহমেদ, শফিক হাসান, মাহবুব আলম
মাসউদ আহমাদ, সাফায়েত হোসাইন, মেহেদী ফেরদৌস
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও পষ্ঠাসজ্জা :: রঙছুট
শব্দ বিন্যাস ও সমন্বয় :: সৈয়দা সুধন্যা
সার্বিক ব্যবস্থাপক :: সাইফুল আমিন
যোগাযোগ ::
+88 018 18731377
[email protected]
http://www.facebook.com/akashlina.mag
মূল্য :: ১০ টাকা
সম্পাদক ও প্রকাশক
নোমান ভূঁইয়া কর্তৃক সার্কুলার রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত;
এবং হাতিরপুল, ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৫ থেকে মুদ্রিত।
================================================
দ্রষ্টব্য : মূল কাগজে প্রকাশিত সকল লেখা ব্লগে প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে, আমরা দুঃখিত। -সম্পাদক।
আকাশলীনা] ১৫ :: ভিন্ন আয়োজনে অন্য সাময়িকী
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন