১
হালকা হাওয়ায় কেঁপে উঠলো রশিদ উদ্দিনের সামনে রাখা ছোট কুপিটা। নিতান্তই ছোট। কতটুকুই বা আলো দেয়? এই তো, তার সামনে উপবিষ্ট ক্ষুরধার ও কৌতূহলী চক্ষুধারীদের কেউ না কেউ নিয়ে আসছে বোধহয়। দূর-দূরান্তর থেকেই তো ওরা আসে। আশ-পাশ থেকেও আসে। উত্তেজনা নাই ওদের চোখে। কৌতূহলী। কিন্তু উত্তেজনার বালাই নাই সেখানে। ধীর-স্থির। সুষম। নিমগ্ন। নিবিষ্ট। কেন্দ্রীভূত।
আবার বাতাস। নিভে যাবে নাকি কুপির ছোট্ট আগুনটা? বেচারা কুপি। চারদিকের এই হ্যাজাকের আলোয় তোমার মূল্য কেউ বুঝে না। ‘ঐ দেখ মেন্টেলে তৈল ঝরে কেমন সুন্দর পরিপাটি আয়না গড়া চতুর্ধারে’। কিন্তু কুপির আলো কেউ বুঝে না। কেউ বুঝে না। কি রহস্য ওতে! কি রহস্য! খালি তাচ্ছিল্যজ্ঞান। অকেজো। অনাবশ্যক। কিন্তু ঐ সামনের মাটির ঘরটার পেছনের কঞ্চির বেড়াটা পার হইলেই জাপটে ধরা অন্ধকারে তুমিই একমাত্র সম্বল।
১৯৩২ সালের এক রাত্রিতে হাওর-বাওর-বিল-ঝিলের দেশ নেত্রকোনার বাহির চাপড়া গ্রামের এক মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে পৌষের মৃদু হাওয়ার বিপক্ষে একটা কুপির আপ্রাণ টিকে থাকার প্রচেষ্টাখানি বিনম্র দৃষ্টিতে দেখলেন সাধু রশিদ উদ্দিন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন।
“গুরু, শুরু করেন তাইলে...”। আচমকা সম্বিত ফিরে পেলেন সাধক। ‘আইজকেই...হ, আইজকেই সে আইসবে’। জানেন সাধু। মানব, প্রকৃতি, মানবদেহ, সৃষ্টি রহস্য, গুরু সাধন, আত্মা-পরমাত্মা। হ্যাঁ, এইসব চর্চার এক আখড়া তো তাঁর এই নিতান্ত সাধারণ গৃহ। অনেক ভাব-শিষ্য তাঁর। আধ্যাত্মিক চর্চা। কবি গান। জারি গান। আবার অত্র অঞ্চলের সুফি সাধকদের গান-জলসা-জিকিরও হয় তার এই স্বগৃহে। কত ভক্ত! কত অনুরাগী! কত শিষ্য! আজকেও আসবে আরেকজন – জানেন তিনি। তাঁরও হঠাৎ মনে পরে পুখুরিয়া গ্রামের টকনা মিস্ত্রির কথা। একটু একটু করে একতারা বাজাতে যেতেন তিনি। শুরু করেন বাউল গান শেখা। সেই ছোট বেলায়। পনের কি ষোল! ‘আইজকেই একজন আইসবে......ষোল বছরের ওতি আইজকেই আইসবে’। বড় রহস্য এই জগতখানার! ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া/এত যত্নে গড়াইয়াছে সাঁই’। মৃদু স্বরে শিষ্যদের দিকে দৃষ্টিপাত করে উচ্চারণ করলেন,
আগে তিমির নাসিয়া
কটাক্ষ স্বরূপে দেখনারে চাহিয়া।
তীর ধ্যানে আছে তোমার স্বয়ং ভগবান
তিথি সু থাকিলে তারে খুঁজরে পাষাণ।
তারপর বললেন,
মানুষ ধর, মানুষ ভজ
শুন বলিরে পাগল মন।
মানুষের ভিতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন।
ছোট্ট নিভু-নিভু কুপিটার দিকে আবার শীতল কিন্তু বিনম্র একপলক ফেলে বলতে থাকলেন,
ওগো স্রষ্টা, জাতি ভ্রষ্টা, তুমি হইলা নষ্টের মূল
নাহি তোমার জাতি ধর্ম, নাহি তোমার কূলা কূল।
তুমি হিন্দু কিংবা হও মুসলমান
নাই তোমার মান অপমান,
সবার কাছে সমতুল।
তুমি স্বর্গ তুমি নরক
ইহাতে আর নাই যে পরক
নাই তোমার সুরত সুরত
আশাতে ফুটাইছ ফুল।
এবার আর থামলেন না। বলেই চললেন,
অন-রে অন-রে দেখ সবে চিন্তা করে
প্রভু সাঁই পরোয়ার কি খেলা খেলায়।
বসিয়া নিরালা ঘরে কার্য করে ধীরে ধীরে।
বিচিত্র কৌশল করে মানুষ বানায়।
ঠিক এই সময়, বাঁশঝাড়ে ছাওয়া আর আম-জলপাই-হরতকির জঙ্গল চিরে বের হওয়া সরু পথ ধরে ধনুকের ছিলার মতন টান-টান শরীর আর স্পষ্টবাদিতার ঔজ্জ্বল্যে জ্বলজ্বল করতে থাকা এক অবয়ব চোখে পড়লো সাধক রশিদ উদ্দিনের। ঐ আন্ধারে সেই অবয়বখানির উপস্থিতি কতই না স্পষ্ট সাধুর মানসপটে! দিব্যি দেখা যাচ্ছে সেই ধীর-একাগ্র চলন! কাঁধের উপর সেই পুটলিখানিও দিব্যি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এক মৃদু হাসির দ্যোতনা সাধুর মুখমণ্ডল জুড়ে। ‘সে আইসছে...আবদুল করিম আইসছে’।
২
বাউল গানের কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিমের আবির্ভাব ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে। সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। প্রেরণা ছিলেন স্ত্রী আফতাবুন্নেসা - আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসার কথা বলেছেন। লিখেছে প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান। করেছেন সুরারোপ। প্রকাশিত হয়েছে ছয়টি গানের বই। বইগুলো হলো - আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং দোলমেলা। সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধেও চুপ ছিলেন না তিনি।
হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িকতা। যেই সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বে রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের জন্য এই ভূমি কতবারই না রক্তাক্ত হয়েছে! তাই হয়তো তিনি বলছেন...
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম।
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম।
বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম
কে হবে মেম্বার,
কে বা সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
করি যে ভাবনা
সেই দিন আর পাব নাহ
ছিল বাসনা সুখি হইতাম
দিন হইতে দিন
আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….।
ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন...যখন বলছেন,
বাংলার দালাল রাজাকার, করেছিল কি ব্যবহার
তাহাদের কথা আমার আজো মনে পড়ে
বাংলার দুর্দিনে এই দালাল রাজাকারে
ইসলামের দোহাই দিয়া শত্র’কে সমর্থন করে।
(কালনীর কূলে/ গান: ১৩৭)
তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। এছাড়াও ২০০০ সালে কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক পান। তারপরও যেটা হয়, জীবনের একটি বড় অংশই তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে দারিদ্রতার সাথে।
হ্যাঁ, কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সাম্প্রতিককালে এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেন ইট-কাঠের খাঁচা প্রসূত আমাদের এই তারুণ্যের মাঝে। যেই তারুণ্য এখন অনেক কিছুই বুঝতে চায়! খুঁজতে চায় মাটির ঘরের আত্মার সন্ধান।
মায়া
বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলবাগানে
নানান রঙের ফুল
ফুলের গন্ধে মন আনন্দে
ভ্রমর হয় আকুল
বন্ধুর বাড়ির ফুলের বন
বাড়ির পূর্বধারে
সেথায় বসে বাজায় বাঁশী
মন নিল তার সুরে
মন নিল তার বাঁশীর তানে
রূপে নিল আঁখী
তাইতো পাগল আব্দুল করিম
আশায় চেয়ে থাকে।
গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে গাড়ি চলে না
চড়িয়া মানব গাড়ি, যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি, উপায়বুদ্ধি মিলে না।
আব্দুল করিম ভাবছে এবার, কণ্ডেম গাড়ি কী করবো আর
সামনে ভীষম অন্ধকার, করতেছি তাই ভাবনা।।
আমি কূল হারা কলঙ্কিনী
তারপর আরও বলছেন,
ভব সাগরের নাইয়া ...
মিছা গৌরব করোরে পরার ধন লইয়া।
একদিন তোমায় যাইতে হবে এই সমস্ত থুইয়া।।
পরার ঘরে বসত করো, পরার অধীন হইয়া
আপনি মরিয়া যাইবায় এইভব ছাড়িয়া।।
কী ধন লইয়া আইলায় ভবে, কী ধন যাইবায় লইয়া
ভবে আইয়া ভুলিয়া রইলায় ভবের মায়া পাইয়া।।
বাউল আব্দুল করিম বলে, মনেতে ভাবিয়া
মন্ত্র না জানিয়া ঠেকলাম, কালসাপিনী ছুঁইয়া।।
(কালনীর কূলে/ গান: ৪০)
ভেবে অবাক হয়েছিলাম, কি অদ্ভুত সমাজ সচেতনও ছিলেন তিনি!
শোনেন বন্ধুগণ, করা ভালো জন্ম নিয়ন্ত্রণ
ভবিষ্যত উজ্জ্বল হইবে করিলে নিয়ম পালন।
জনসংখ্যা বাড়িতেছে, জমি কিন্তু বাড়ে না
ভবিষ্যত কি হইবে করো না বিবেচনা
ভালোমন্দ যে বুঝে না, পাছে পাবে জ্বালাতন।।
বিচার করে দেখো সবাই যে চলে হিসাব ছাড়া
অধিক সন্তান জন্মাইয়া হয়েছে দিশেহারা
শিক্ষা-দীক্ষা খাওয়া পরা, চলে না ভরণপোষণ।।
(কালনীর কূলে/ গান: ১৩০)
৩
সেই মানুষটার তিরোধান আজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ শনিবার সকাল ৭: ৫৮ মিনিটে সিলেটের নুরজাহান ক্লিনিকে। পরমের সান্নিধ্যে। মায়ার জালে বান্ধা এই দুনিয়া ছেড়ে কোথায় গেলেন? তিনিই তো সংশয় সহকারে গেয়েছিলেন,
স্বর্গ আর নরক
করি নাই পরখ
আছে বলেই শুধু শুনেছি।।
দয়া নাই যেখানে
কে যাবে সেখানে?
স্বর্গের মহিমা
শুনেছি তাই
সেখানে আছে বুঝি
খেমটাওয়ালী বাঈ
...করে সুরাপান
হয়তো সস্তা নইলে
বিনামূল্যে পান
এখন খাইলে পরে
দোষ কেন ধরে
তাইতো ফাঁপড়ে পড়েছি।
এই সকল সুখ
নরকেতে পাই না
তাইতো সেখানে
কেউ যেতে চায় না
অসুবিধা বাদে
আর কিছু দেখি না
নরকেই গরম খুব।
এত স্পষ্টভাবে সংশয় প্রকাশ! শুনে দেখি একটু তাঁর কণ্ঠে....
৪
কেউ বলে দুনিয়া দোজখ, কেউ বলে রঙের বাজার
কোনো কিছু বলতে চায় না, যে বুঝেছে সারাসার।
বুঝলে কি, বুঝবে কি ওরে ও মন ধুন্ধা/এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ২:০২