১.
দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম ও ৯(নয়) মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা। শুধুমাত্র পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের নয়। হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশ। শত বছর আগে মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম সহ জানা অজানা শত সহস্র মানুষ আত্মহুতি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করে গেছেন। বাঙ্গালির জন্য এই স্বাধীন ভূখন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য শের-ই- বাংলা একে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী সহ আরো অনেক নেতা শত শত বছরের মুক্তি সংগ্রামে বিভিন্ন ভাবে তাদের অবদান রেখেছেন। সর্বশেষে বাঙ্গালির অবিশংবিদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই কারণে যে বঙ্গবন্ধুই বাঙ্গালিদের কে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশের স্থপতি বলা হয়। কারণ বঙ্গবন্ধুর মত আর কেউ কখনো এমন করে ভাবেনি বা ভাবতে পারেনি যে-বাঙ্গালির জন্য একটি স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাঙ্গালীদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি হবে। সেখানকার মানুষগুলি হবে অসাম্প্রদায়িক, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, সমাজতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্যের ভিত্তিতে বিকাশ ও বিস্তৃত হবে অর্থনীতি, গণতান্ত্রিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি ও কল্যানে নির্মিত হবে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
২.
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও চেতনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই চিন্তা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয় নাই। কলকাতার সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় বঙ্গবন্ধুকে একবার প্রশ্ন করে ছিলেন- “শেখ সাহেব, বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?” উত্তরে বঙ্গবন্ধ বললেন - সেই ১৯৪৭ সাল । আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎবসু (নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর ভাই)চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙ্গালির এক দেশ। বাঙ্গালিরা এক হলে কি না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত। দিল্লী থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসু । কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কেউ রাজি না তাদের প্রস্তাবে তারা হাল ছেড়ে দেয়। আমিও দেখি যে আর কোন উপায় নাই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মত পাকিস্তান মেনে নিই।কিন্ত আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা সেই স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোন সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলো যা কমিউওনাল ! বাংলাদেশ বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমি ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে । ভাষা ভিত্তিক আন্দোলকেই একটু একটু করে রুপ দেই দেশ ভিত্তিক আন্দোলন। পরে এমন একদিন আসে আমি আমার দলের লোকাদের জিজ্ঞাসা করি। আমাদের দেশের নাম কি হবে? কেউ বলে,পাক বাংলা, কেউ বেল পূর্ব বাংলা। আমি বলি না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দেই জয় বাংলা । ওরা তখন বিদ্রুপ করে বলে জয় বাংলা না ,জয় মা কালি। কি অপমান । সে অপমান সেদিন আমি হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বুঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতির জয় যা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে ।
৩.
বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ এই বিষয়গুলো যে ধীরে ধীরে ধারাবাহিক ভাবে এসেছে তার কিছু সংক্ষিপ্ত রুপ আলোচনা করব। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কিছু বলতে গেলে স্বাভাবিক ভাবে তার নিজের হাতের লেখা “অসমাপ্ত আত্মজীবনীর” কথা বলতে হবে। কারণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পূর্ণতা লাভ করেছে। যদিও তার স্বপ্ন ছিল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বাংলার গরিব দুঃখির ভাগ্য উন্নয়ন কিন্তু সেই অভিষ্ট লক্ষে পৌছানোর পূবে তাঁর জীবনের ইতি ঘটেছে। যাই হোক বলছিলাম অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত না হলে হয়তো আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক অজানা তথ্য থেকে বঞ্চিত হতাম। যদিও গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বর্ণীত আছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ । রাজনীতিতে হাতেখড়ি হোসেন শহিদ সোরাওয়ার্দীর হাতে ১৯৩৮ সালে থেকে । তারপর থেকে একে একে তার প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড ধারাবাহিক ভাবে বাংলার অবিসংবিদিত নেতা হিসেবে স্থায়ী ভাবে স্থান করে নিয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনের ভরাযুগ গোটা ভারত বর্ষে। বঙ্গবন্ধু সবে স্কুলে পড়ছেন। আর সেই বয়সেই স্বদেশীদের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতেন। নেতাজী সুভাস বসুর খুবভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তার একটি স্মৃতি কথায় তিনি বলেছেন- “ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমার মনে বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এই দেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে।” সেই থেকে বাংলার স্বাধীনতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় গেথে গিয়েছিল।১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে বাংলার দুই নেতা এ.কে ফজলুল হক ও হোসেন শহিদ সোরাওয়ার্দীর সাথে। পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে যোগাযোগ এবং গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে নেমে গেলেন এবং পুরো কলকাতায় ও পূর্ব বঙ্গে খুব পরিচিত হয়ে উঠেন ছাত্র নেতা ও মুসলিম লীগের তরুন নেতা হিসেবে। পর্যায়ক্রমে ভারতবর্ষ ভাগ হল। সৃষ্টি হল মুসলমানের আবাসভূমি পাকিস্তান। কিন্তু এই পাকিস্তান বাঙ্গালিদের জন্য তৈরি হল না । বঙ্গবন্ধু বুঝলেন পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঙ্গালিদের মুক্তি প্রয়োজন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তিনি চলে এলেন ঢাকায়। তখন তার বয়স ২৭ (সাতাশ)। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। নেমে পড়লেন “নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ” গঠন করা নিয়ে।মুজিবের আলোচনা চলল তখনকার ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নাঈম উদ্দিন, মোল্লা জামাল উদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ আরো অনেকের সাথে। সভা ডাকলেন ফজলুল হক হলে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। সভায় সিধান্ত হলো একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করা হবে যার নাম হবে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ”। আহবায়ক করা হল নাঈম উদ্দিন কে । একমাত্র অলি আহাদ রাজি হলেন না এই সংগঠনের সাথে থাকতে। তার অভিযোগ ছিল সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধু অলি আহাদকে অনেক করে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, নামে কিছু আসে যায় না, আদর্শ ও চেতনা যদি ঠিক থাকে তবে নামে পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবেনা। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি সেই মানুষিক অবস্থা থেকে জনগন ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।” বঙ্গবন্ধুর যুক্তি সম সাময়িক ও যথার্থ ছিল। এবং দুই বছরের মধ্যেই আমরা দেখি সংগঠনটি থেকে পাকিস্তান নামক শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৫০, মোগলটুলিতে সংগঠনের অফিস করা হল। সাইবোর্ডে নাম দেওয়া হল “মুসলিম লীগ ওয়ার্কস ক্যাম্প” নামে । এই মোগলটুলির অফিসই পরে প্রগতিশীল মুসলিম লীগ/ আওয়ামী লীগের প্রাণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
৪.
১৯৪৮ সাল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ঢাকার নবাব নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমিন সহ এদেশীয় দোষরগণ পল্টন ময়দানে ও কার্জন হলে ঘোষণা দেন- উর্দ্দ উর্দ্দই হবে পাকিস্তানের এক মাএ রাষ্ট্রভাষা। সেই সময় শেখ মুজিবের তারুন্যদীপ্ত কন্ঠে প্রতিবাদী সোচ্চার না - না । সেই সাথে হাজার কন্ঠ মিলিয়ে প্রতিধ্বনিত হল না - না - না । রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হল ভাষা সংগ্রাম কমিটি। সেই ভাষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে সারা বাংলায় দূর্বার গণ আন্দোলন গড়ে উঠল।তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফ্রেবুয়ারী বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলার একমাত্র ভাষা বাংলা । সেই ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ের এখানে সমাপ্তি ঘটে ঠিকই। কিন্তু ৫২ র ২১ই ফেব্রুয়ারী ঘটনার ভেতর দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ও মুসলিম লীগ সরকার সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষের অনেকখানি মহমুক্তি ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগ সরকার যে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বার্থে নয় একথাটি সাধারণ জনগন ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। সেই সময়কার পূর্ব বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদন শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের গনবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে জনগনকে আরো সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট হন। যার কারণে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বঙ্গে মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুবি হয় এবং বাঙ্গালিদের নির্বাচনী জোট “যুক্তফ্রন্ট” ও পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার সরকার গঠন করে। অতঃপর ১৯৫৬ এর সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সুতরাং ভাষা সংগ্রামের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অর্থাৎ বাঙ্গালিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্নকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিল।
৫.
১৯৪৯ সাল, টাঙ্গাইলের একটি উপনির্বাচনে তখনকার ছাত্র নেতা শামছুল হকের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিক দল “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।”( এই রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগ গঠনের পটভূমি ছিল )। নতুন দল “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের”সভাপতি হলেন মাওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক - শামছুল হক আর শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্নসম্পাদক। তখনও বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে জেল থেকে মুক্তি পেলে জেল গেটেই আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ বলে স্লোগান উঠল। এই সময়টিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার থেকে চাপ আসে, বঙ্গবন্ধুর বাবা চাইলেন বঙ্গবন্ধু যেন বিলেত গিয়ে ব্যারিষ্টারি করেন। কিন্ত বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন না। এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন-“ আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিছিলাম, এখন দেখি তার উল্টো হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার । জনগন আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবুও মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দূর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়াছে, বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচি। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের । পূর্ব বাংলায় কিছুই নেই। আব্বাকে সকল কিছু বললাম। আব্বা বললেন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েচে। তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। আমি আব্বাকে বললাম, আপনি তো আমাদের জন্য জমি জমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ী চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া চলতে পারেনা। আব্বা আমাকে আর কিছুই বললেন না। রেনু বলল, এভাবে আর কত কাল চলবে? আমি বুঝতে পারলাম যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেনু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেনু খুব কষ্ট বোধ করল কিন্তু কিছু বলতো না।”
পঞ্চাশের দশকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বাঙ্গালিদে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা সহ নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা যেন মূল লক্ষ হয়ে উঠে। পাকিস্তান থেকে বাঙ্গালিদের বের করে এনে বাঙ্গালি জাতীয়তায় পূর্ব বাংলায় একটি আলাদা দেশ প্রতিষ্ঠা করাই যেন বঙ্গবন্ধুর ব্রতি হয়ে উঠে। সংসার জীবনে সফল একজন সংসারি হয়ে উঠা হল না, শুধুমাত্র এই রাজনৈতিক জীবনের জন্য। পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন বাঙ্গালির মুক্তির জন্য।
৬.
সুতারাং ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠনের মধ্য দিয়েই পূব বঙ্গের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসনের বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ দাবিতে প্রকাশ হয় ১৯৬৬ সালে এসে ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে। যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ গঠিত হল। ১৯৬৬ সালে ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার ইডেন হোটেলে।কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান ৬- দফাকে দলের প্রধান মেনিফোস্টো হিসাবে গ্রহন করার সিধান্ত গ্রহন করেন। পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্ত্ব শাসনকেই আওয়ামী লীগের প্রধান নীতি বলে বিবেচনা করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ অনুমোদিত ৬-দফা ফমূলাটি নিম্নরুপ :-
১। দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সত্যিকার ধারনার ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ করে, সরকার হবে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির, আর সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ হবে সার্ব ভৌমত্ত্বের অধিকারী।
২। ফেডারেল সরকার মাত্র দুটি বিষয় পরিচালনা করবেন।এ দুটি বিষয় হল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। আর অন্য সকল বিষয় ফেডারেশনের ইউনিট গুলো হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৩। ক) দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন করা যেতে পারে। অথবা
খ) গোটা দেশের জন্য একটি মাত্র মুদ্রা রাখা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রা নীতি গ্রহন করতে হবে।
৪। ফেডারেশনের ইউটিনগুলির হাতে করারোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে এরকম কোন ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় চাহিদা মেটানো জন্য প্রদেশ গুলির করের এ
কটা অংশ পাবে। প্রদেশের সকল করের উপর একটি নির্ধারিত হারে লেবি থেকে একটা সর্বমোট সুসংহত তহবিল গড়ে উঠবে।
৫।ক) দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুইটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব থাকবে।
খ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
গ) ফেডারেল সরকারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন দুই অঞ্চল কতৃক সমান হারে অথাব নির্ধারনযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কতৃক মিটানো হবে।
ঘ) দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্ত ভাবে অবাধে চলাচল করবে।
ঙ)শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশণের ইউনিট সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খুলতে বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে।
৬। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতার পথ ধরে ২১ দফা কর্মসূচির সপক্ষে ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ডের নির্বাচন ’৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙ্গালির স্বাধিকারের দাবি হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য ছয় দফায় কার্যক্রম পাকিস্তান রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে বাঙ্গালির জাতি রাষ্ট্রের আকাঙ্খাকেই সুনির্দিষ্ট রুপ দেওয়া হয়। এই ছয় দফার কারণেই বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জড়িয়ে গ্রেফতার ও কারাগারে প্রেরন করেন। কিন্তু থেমে থাকেনি আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে এসে তীব্র গনআন্দোলনের মুখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঠিক সেই সময়ে এক গন সংবর্ধনায় তোফায়েল আহম্মেদের ঘোষণায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাদিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাংলার এককছত্র নেতা। আর মাত্র দু-বছরের মধ্যে ছয় দফা রুপান্তরিত হয়ে যায় এক দফায়। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে ছয় দফার সমর্থনে বাঙ্গালি জাতির বাংলাদেশের পক্ষে গণ রায় ঘোষণা করে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। কিন্তু নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও ইয়াহিয়া- ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তর কররেত অস্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধুকে আপোষের পরামর্শ দেয়া হয় কিন্তু বঙ্গবন্ধু আপোষ করে নাই। তারপরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। এরই মধ্যে ৩রা জানুয়ারী ১৯৭১ সালে রমনা রেসকোর্সে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যেদের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আবারো ছয় দফার ওয়াদার কথা বাঙ্গালিদের স্বরণ করিয়ে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ই মার্চ সালে রেসকোর্স ময়দানে স্মরণাতীত কালের বৃহতম জন সভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। এই স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাঙ্গালির স্বাধীকারের কিংবা স্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতির কথা বলে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন “ ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলে। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাহ্ আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
চূড়ান্তে ভাবে এই স্বাধীনতা ঘোষাণার পূর্বে বঙ্গবন্ধু কিছু পূর্ব পরিকল্পনা করে রেখেছিল। যেমন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধির সাথে টেলিফোনে বাংলাদেশর স্বাধীনতা বিষয়ে ভারতের সহযোগীতা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে কিংবা বঙ্গবন্ধু যদি নাও থাকে। তাহলে কে কি করবে বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা এবং তিনি আরো বলেন বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে কবিগুরুর -“ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি-গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করো।” পাকিস্তানের সাথে বাঙ্গালিদের যে সশস্র সংগ্রাম শুরু হবে সেটা বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকে আবাস পেয়েছিলেন। বেশ কয়েক বার কর্ণেল ওসমানী ও কর্ণেল রব, শেখ মনি, তোফায়েল আহম্মেদ এবং তাজউদ্দিন আহম্মেদের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে তাদেরকে বিভিন্ন রণকৌশলের উপদেশ দিয়েছিলেন।
যাই হোক ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণা এবং ২৫ই মার্চের দিবাগত রাতে ১২টা ১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআরের ওয়ারলেছে স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর পরিকল্পনার একটি অংশ। পর্যাক্রমিক ভাবে বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন দেশে রুপান্তরের জন্য যা যা করার প্রয়োজন সব কিছুই সুনিপুন ভাবে এগিয়ে এনেছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতে কি ভাবে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হবে তার পরিকল্পনা তিনি দিয়েছিলেন। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালিরা বিজয়ের পতাকা উড়াল বাংলাদেশ । বিশ্ব জানতে পারল রক্তস্নাত একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের কথা । লাল-সবুজ পতাকার কোলে জন্ম নিল একটি দেশ- দেশটির নাম বাংলাদেশ।
৭.
টুঙ্গিপাড়ার যুবক শেখ মুজিবুর রহমান যে দিন থেকে রাজনীতি শুরু করেন সে দিন থেকেই বাঙ্গালি ও বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উন্মোচন হয়েছিল এবং উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের চিন্তা।
শেষ করছি রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে যে- “আজ আশা করে আছি, পরিত্রান কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দরিদ্র লাঞ্চিত কুটিরের মধ্যে ; অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈবাবাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শুনাবে, এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই” । যদিও রবীন্দ্রনাথ উক্ত উক্তিটি করেছিলেন বৃটিশ শাসকদের ভারত সম্রাজ্য ত্যাগের উদ্দেশ্যে কিন্তু তাঁর এই উক্তিটি এক দম মিলে গেল বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানীদের দেশ ত্যাগের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-পূর্ব দিগন্তের সেই মহান পুরুষ আর কেউ নয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সহায়ক গ্রন্থ সমুহঃ-
১। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কথা - ওয়াজেদ তালুকদার।
২। বঙ্গবন্ধু ও বাঙ্গালির স্বপ্ন- নূহ-উল- আলম লেলিন।
৩। বঙ্গবন্ধু কি ভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন- মুনতাসীর মামুন।
৪। বাঙ্গালির ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ -মোনায়েম সরকার।
৬। যায় যায় দিন- ২৬ শে মার্চ, ২০১৩ইং।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:১৫