পৃথিবীর সব দেশের এই সময়ের নারীর জন্য এক নীরব ঘাতক স্তন ক্যান্সার। এই গোপন ব্যধির শিকার হয়ে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছেন হাজার হাজার নারী। বিশ্বজুড়ে অক্টোবর মাসকে 'স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস' হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ হাজার ৭ শত ৮১ জন নারী স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হন। এই সংস্থার হিসাব মতে প্রতিবছর দেশে স্তন ক্যান্সার জনিত কারণে ৮ হাজার ৩ শত ৯৬ জন নারীর মৃত্যু ঘটে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সচেতনতা ও সময়মত চিকিত্সা বাঁচিয়ে তুলতে পারে রোগীকে এবং দিতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সারাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী স্তন ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করার পরও এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি দেখা যায় না। স্তন সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে অনীহা, নারীরা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগের উপসর্গ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানা এবং নিজেদের ও পরিবারের অবহেলার কারণে প্রতিরোধযোগ্য স্তন ক্যান্সার মরণঘাতী রূপ নেয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকগণ।
'জেগে উঠুন জেনে নিন' প্রতিপাদ্য নিয়ে এবছর প্রথম বারের মতো স্তন ক্যান্সার সংশ্লিষ্ট এগারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার ফোরামের ব্যানারে দিবসটি উদযাপন করছে। আয়োজকরা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সকলকে সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার আহবান জানান। এই এগারটি প্রতিষ্ঠান স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস উদযাপনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে। রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল বিনামূল্যে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করার কর্মসূচি পালন করছে। মিরপুর আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে ১ অক্টোবর থেকে মাসব্যাপী স্তন ক্যান্সার সচেতনতা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
বুধবার সকালে শাহবাগ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত শোভাযাত্রা আয়োজন করেছে ফোরাম। বিকেলে রবীন্দ্রসরবরে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাবেশ।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এবং ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বিভাগীয় প্রধান ডাঃ মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের নারীদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। পরিবারের নারী সদস্যদের মধ্যে (বিশেষত মায়ের দিকের নারী আত্মীয়ের) স্তন ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে, ইস্ট্রোজেন হরমোন (স্ত্রী হরমোন) বৃদ্ধি পেলে, ১২ বছর বয়সের আগে মাসিক শুরু হলে, মাসিক দেরিতে অর্থাৎ ৫০ বছর বয়সের পর বন্ধ হলে, ২০ বছরের আগে বিয়ে হলে, ৩০ বছরের পর প্রথম সন্তান জন্ম হলে, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে, নিঃসন্তান থাকলে, বিড়ি-সিগারেট, তামাক সেবন, কম শারীরিক পরিশ্রম, দীর্ঘদিন উচ্চরক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ থাকলে, বেশি মোটা হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায় ।
ঢাকা মেডিকলে কলেজের জেনারেল ও কলোরেক্টাল সার্জন অধ্যাপকডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল স্তন ক্যান্সারের লক্ষণের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সাধারণত ৩০ বছরের আগে এই রোগ কম হয়। বেশিরভাগ রোগী বুকে চাকা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। বুকে চাকা সেই সঙ্গে কিছু কিছু রোগী ব্যথার কথাও বলে থাকে। কখনও কখনও বুকে চাকা এবং বগলেও চাকা অনুভূত হয়। নিপল ডিসচার্জ এবং নিপল ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়াও এ রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু রোগী বুকে ফুলকপির মতো ঘা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে। অনেক সময় যে বুকে ব্যথা, সেদিকের হাত ফোলা নিয়েও আসতে পারে। এগুলো ছাড়া ব্রেস্ট ক্যান্সার দূরবর্তী কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে এমন উপসর্গ নিয়ে আসে; যেমন : হাড়ে ব্যথা, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও জন্ডিস ইত্যাদি।
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল আরো বলেন, স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায় মেমোগ্রাম বা স্তনের বিশেষ ধরনের এক্স-রে, স্তনের আলট্রাসনোগ্রাম ও চাকা বা টিউমার থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করলে এই রোগ ধরা পড়বে। ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিত্সায় সার্জারি করাই উত্তম। তাছাড়া কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি, হরমোন থেরাপি ইত্যাদি চিকিত্সা রয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শনাক্ত করার উপায়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ত্রিশ বছরের বেশি বয়স হলে নিজ নিজ ব্রেস্ট পরীক্ষা করতে হবে কোনো চাকা পাওয়া যায় কিনা। চাকা পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বয়স ৫০-এর উপরে হলে বছরে একবার মেমোগ্রাম করতে হবে। সন্দেহ হলে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
এই রোগ এড়ানোর উপায় সম্পর্কে ডা. গুলজার হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত রোগটির নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তাই এই রোগ এড়ানোর জন্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। ত্রিশ বছর বয়স থেকে নিজে নিজেই ব্রেস্ট পরীক্ষা করুন। রিস্ক ফ্যাক্টর মানে ফ্যামিলির কারো ব্রেস্ট ক্যান্সার থাকলে সে ক্ষেত্রে মেমোগ্রাফি করুন। ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে প্রথম সন্তান জন্ম দেয়ার চেষ্টা করুন। সন্তানকে বুকের দুধ পান করান। টাটকা শাক-সবজি ও ফল খান। সন্দেহ হলে ক্যান্সার সার্জনের শরণাপন্ন হন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা বাংলাদেশেই সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নিরূপণ হলে এবং চিকিত্সা করালে অনেকদিন সুস্থ থাকা যায়। সার্জারি করার সময় টিউমারটি বগলে লসিকা গ্রন্থিসহ অপসারণ করলে এই রোগ পুনরায় দেখা দেয়ার সম্ভাবনা খুব কম। অসম্পূর্ণভাবে টিউমার অপসারণ করলে এই রোগ আবার হতে পারে। তবে এই রোগের চিকিত্সা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব।
লিংক : প্রতিমুহূর্ত।কম
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১০:৫৯