গর্ভস্থ শিশুর জীবন নাশ কোন্ অপরাধে ? বিশ্বে গর্ভপাতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। মায়ের জীবনহানির আশঙ্কা, অসুস্থ বা বড় ধরনের ত্রুটিযুক্ত গর্ভস্থ শিশু ও চিকিৎসাগত নানা সঙ্গত কারণে যেসব গর্ভপাত ঘটছে তা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যে গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য বা জীবন-হানির কোনো আশঙ্কা না থাকা সত্ত্বেও গর্ভস্থ সুস্থ শিশুর জীবন নাশ করা হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায়। এই অবিচারের সাফাই দেয়ার জন্য তারা ব্যবহার করছে "নারী তার নিজ দেহের মালিক"- শীর্ষক প্রতারণামূলক শ্লোগানটি। বিষয়টি কথিত পশ্চিমা সভ্যতার নৈতিক অধঃপতন ও যৌন অনাচারের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে কোনো পদ্ধতিতে গর্ভস্থ শিশুকে গর্ভের ভেতরেই মেরে ফেলা খুবই আমানবিক ও নৃশংস কাজ। এ কাজ মানুষের সহজাত প্রকৃতির বিরোধী। অথচ এই অমানবিক কাজ ক্রমেই বেড়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও কানাডার মত দেশগুলোতে। মাইকেল লিচফিল্ড এবং সুসান কেন্টিশ নামের দুই বৃটিশ গবেষক জানিয়েছেন, বৃটেনে গর্ভস্থ শিশুর জীবন নাশ বা গর্ভপাতের হার ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণে এইসব শিশুর মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য বিশেষ ধরনের অনেক চুল্লী বানানো হয়েছে। প্রতিবছর গর্ভপাতের শিকার হাজার হাজার শিশুর মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে এইসব চুল্লীতে।
গর্ভস্থ শিশু হত্যার নৃশংস চিত্র এখানেই শেষ নয়। পাশ্চাত্যের এক শ্রেনীর মুনাফালোভী মানুষ আজকাল বিপুল অর্থের লোভে গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করছে চিকিৎসা গবেষণায় তাদের ব্যবহার করার জন্য। কানাডীয় লেখক উইলিয়াম গার্ডনার লিখেছেন, "নিহত ভ্রুণ শিশুর কোষগুলো সুস্থ ও খুব তাজা বলে এসব কোষ চিকিৎসা গবেষণায় ব্যবহার করছে কেউ কেউ। গর্ভস্থ শিশু বা ভ্রুণ শিশুর মৃত্যুর পরপরই তার দেহের কোষ ও চামড়াগুলো সতেজ থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়। এইসব কোষ অন্যদের কোষের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।"
আরো দুঃখজনক খবর হল, আজকাল ইউরোপের চিকিৎসকরা ভ্রুণ শিশুর চর্বিকে সাজ-সজ্জার বা প্রসাধন সামগ্রীর উপাদান তৈরির মত বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন। গর্ভপাতের সমর্থক হিসেবে পরিচিত চিকিৎসক অধ্যাপক ক্রিস ব্যাগলি বলেছেন, "ভ্রুণ শিশুর চর্বি প্রসাধন শিল্পের জন্য খুবই জরুরি।" অত্যন্ত নির্দয় এই চিকিৎসক বেশ আস্ফালনের ভঙ্গীতে এও বলেছেন,
" আমি পূর্ণতা প্রাপ্ত ভ্রুণ শিশু নষ্ট করি। এইসব ভ্রুণ শিশুকে যখন অপেক্ষাকৃত ভালভাবে ব্যবহার করা সম্ভব তখন তাদেরকে জ্বলন্ত চুল্লীতে ফেলে দেয়া লজ্জাজনক। আমি এমনকি সাত মাসের ভ্রুণ শিশুকেও নির্দ্বিধায় হত্যা করি। এইসব শিশুর সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাকে এবং ওরা বেশি সময় বেঁচে থাকে। একদিন ভোরে আমি চারটি ভ্রুণ শিশু নষ্ট করি। ওদেরকে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল এবং সেগুলো খুব উচ্চ স্বরে কাঁদছিল। ওদেরকে চুলার আগুনে ফেলার ইচ্ছে আমার হচ্ছিল না। কারণ, ওদের গায়ে ছিল বেশ চর্বি, আর এসব প্রাণীজ চর্বিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যায়। "
নরহত্যার শাস্তি সম্পর্কে ভয়-ভাবনাহীন ওই কষাই ডাক্তারের নির্মম বক্তব্য শুনলেন। তার কথা থেকে স্পষ্ট, এই নিরপরাধ মানুষগুলোর জীবন কেবল এই 'অপরাধে' বিনাশ করা হয়েছে যে তারা ছিল ক্ষুদে মানব।
ভ্রুণ শিশুকে দ্রুত হিমায়িত করা আরো এক আমানবিক ও অনৈতিক পন্থা। এভাবে মেরে ফেলা ভ্রুণ শিশুর কোষ বেশি নিরাপদ বা সুস্থ বলে সেগুলো ব্যবহারের অজুহাত দেখানো হয়।
আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও তারা নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। মর্কিন লেখক জর্জ গ্রান্ট লিখেছেন, "আজ যুক্তরাষ্ট্রের বহু হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নব জাতক বা ভ্রুণ শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত রয়েছেন নামকরা চিকিৎসক ও গবেষকরা। তারা এসব কাজকে স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক রুটিনে পরিণত করেছেন। এইসব কাজ হিটলারের চিকিৎসকদের নৃশংস বা ঘৃণ্য অপারেশনের অভিযোগের সমতুল্য, অথচ আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলোর নৈতিকতার এত ব্যাপক অবক্ষয় হয়েছে যে তারা এইসব অপরাধ তুলে ধরছেন না।"
সভ্যতার দাবিদার পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভ্রুণ শিশু হত্যার এসব ঘটনা প্রত্যেক স্বাধীনচেতা ও বিবেকবান মানুষের মনে এ প্রশ্নের গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে যে, এইসব নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে কোন্ অপরাধে? এসব নৃশংসতা সে অন্ধকার যুগকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যখন মানুষ নিজ সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৬১ লক্ষ ভ্রুণ শিশু হত্যা করা হচ্ছে। একজন মার্কিন গবেষক গর্ভপাতের করুণ দৃশ্য রেকর্ড করেছেন গর্ভের ভেতরে ক্যামেরা বসিয়ে। তার এ ভিডিও চিত্রের নাম দেয়া হয়েছে "নীরব আর্তনাদ"। এই ফিল্মে দেখা গেছে তিন মাসের এক অসহায় ভ্রুণ শিশু কিভাবে যন্ত্রের হাত থেকে পালানোর হতাশাব্যাঞ্জক চেষ্টা করছে এবং গর্ভপাতকারী যন্ত্র কিভাবে একের পর এক ওই শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কেটে কেটে বের করে আনছে।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলো এইসব বিষয় প্রচার না করায় জর্জ গ্রান্ট মার্কিন গণমাধ্যমের বড় রকমের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, "যেসব ভ্রুণ শিশু গর্ভপাতের পরও বেঁচে যায় সেসব শিশুকে জীবন্ত অবস্থায় নৃশংস ও অদ্ভুত নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। এইসব ভ্রুণ শিশুকে প্রসাধন সামগ্রীর উপাদান থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরিসহ বিচিত্র কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বেচা-কেনা করা হয়। আর আমাদের গণমাধ্যম এইসব তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার কষ্ট স্বীকার করতে রাজি নয়।
গিয়ান্না জ্যাসেন এক ভাগ্যবান মার্কিন তরুণী যে গর্ভপাতের ব্যর্থ চেষ্টার পরও বেঁচে আছে। ১৪ বছরের এই বালিকা গর্ভপাতের ব্যর্থ চেষ্টার পরও বেঁচে যাওয়া মানব সন্তানদের আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে বলেছে, কানাডার আইন অনুযায়ী কোনো মেয়েকে তার কান ফোড়ানোর জন্য বাবা মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অথচ তারা বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়াই গর্ভপাত করতে পারে। জ্যাসেন আরো বলেছে, সে কানাডায় এসেছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে মায়ের গর্ভে রয়েছে জীবন এবং সে জীবন বিনষ্ট করার অধিকার কারো নেই।
পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মত কানাডার সংসদেও গর্ভপাতের স্বাধীনতার আইন পাশ হয়েছে। প্রতিদিন কানাডায় হত্যা করা হচ্ছে ২৭০টিরও বেশি ভ্রুণ শিশু এবং দেশটিতে এক বছরে এভাবে ঝরে যায় ৯৫ হাজার নিষ্পাপ প্রাণ। এইসব গর্ভপাতের শতকরা ২৫ ভাগই ঘটাচ্ছে কম বয়সী তরুণীরা। ভ্রুণ শিশুদের খুব কষ্ট দিয়ে গর্ভপাতের সময় হত্যা করা হয়।
কানাডার আইন অনুযায়ী জন্ম না নেয়া শিশুও উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের মালিক হতে পারে এবং ভ্রুণ শিশুর পক্ষ হয়ে আদালত মামলাও দায়ের করতে পারে। কিন্তু এই শিশুর যা নেই তা হল নিহত না হবার অধিকার। কারণ এ দেশের আদালতই মাকে অধিকার দিয়েছে নিজ শিশুকে হত্যা করার।
ইসলামের মানবিক আইন অনুযায়ী ভ্রুণ শিশু হত্যা করা নিষিদ্ধ বা হারাম। উপযুক্ত বা গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ও চিকিৎসকের সমর্থন ছাড়া ভ্রুণ শিশু নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য এবং একজন মানুষকে বাঁচানো সব মানুষকে বাঁচানোর সমতুল্য।
***সংগৃহিত***