হিল গাঙর সুগ নাই
কন গাঙর মাদ নাই
লৌ নেই লৌ নেই লৌ নেই
(মৃত্তিকা চাকমা রচিত ‘গাঙর নাঙ লৌগাঙ’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি)
আজ বাঙালীরা বিপন্ন। ফারাক্কার মতো আরেকটি বিপর্যয় আসন্ন, কারণ টিপাইমুখ বাঁধ। পত্রিকার পাতা খুললেই দেশদরদীর প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদদের লেখার ছড়াছড়ি। সেমিনারও ফেনা তুলছেন সমানে একই সুরে । আর আমাদের মতো অর্বাচীনেরা যারা পত্রিকায় বা সেমিনারে জায়গা পাচ্ছে না তারা শাহবাগ, পল্টন কিংবা মুক্তাঙ্গনে মানব বন্ধন, প্রতিবাদ সভা করছি, প্রতিজ্ঞা করছি রক্ত দিয়ে হলেও বাঁধ নির্মাণ ঠেকাবো। বিএনপি-জামাত জোট মহাসমাবেশ করে দায়িত্ব নিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে গলা, তারাও বলেছে রক্ত দেবে। সরকারী দল বিরোধীতা করছে সাবধানে; এতটাই যে, পিনাক বাবুর ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ বক্তব্যের পরেও তারা সাবধানী। বাণিজ্যমন্ত্রকতো এও বলেছেন, টিপাই বাঁধ থেকে আমরা কোন সুবিধা পেতে পারি কিনা সেটাও দেখা দরকার।
সমস্যা এই অধমের। কোথাও যেতে পারছে না। কেবলি ভয় পায়, কুঁকড়ে যায় লজ্জায়, শাহবাগ বা মুক্তাঙ্গনে মানব বন্ধনে ফেস্টুন হাতে যদি তাকে দেখে ফেলে কোন পাহাড়ী বন্ধু- আব্রাহাম ত্রিপুরা, প্রগতি বোম বা সুচন্দ্রা চাকমা। যদি প্রশ্ন করে, তোমরাও তো বানিয়েছিলে কাপ্তাই? কি জবাব দেবে সে?
তাই ঠিক করেছি আগে ক্ষমা চেয়ে নিই পাহাড়ী বন্ধুদের কাছে। তারপর যাবো মিছিলে। ক্ষমা করো বন্ধুরা, আমাদের ক্ষমা করো……….
কাপ্তাই বাঁধ ও কর্ণফুলী বহুমূখী প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৫২ সালে। প্রাথমিকভাবে জল-বিদ্যুত, বন্যা নিয়ন্ত্রন, সেচ ও নেভিগেশন সুবিধা পাওয়া যাবে বলে ধরা হয় (এখন অবশ্য বাঙালীদের জন্য সেখানে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থাও করা হয়েছে)। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সালে। দু’টি হাইড্রো-পাওয়ার ইউনিট দিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে এর ইউনিট সংখ্যা পাঁচ যা থেকে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং যা বাংলাদেশের বর্তমান মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা মাত্র ৫ ভাগ।
বাঁধ নির্মানের কারণে রাঙামাটি জেলার ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জলমগ্ন হয়। পানিতে ডুবে যায় ২২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি যা পার্বত্য চট্রগ্রামের মোট আবাদি জমির শতকরা ৪০ ভাগ। ডুবে যায় রাঙামাটি শহর, চাকমা রাজার বাড়িসহ ১৮ হাজার ঘর। বাস্তুহারা হয় পাহাড়ে বসবাসকারী প্রায় এক লক্ষ্ আদিবাসী মানুষ।
কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পে সেসময়ের পাকিস্তান সরকারকে ‘সফ্ট লোন’ দেয় ইউএসএইড ।কিন্তু সেই উন্নয়ন সহযোগী (!) বা সরকার বাস্তুহারা মানুষদের জন্য কোন পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরনের ব্যবস্হা রাখেনি কিংবা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। কাগজপত্রের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ হাজার মানুষকে শুরুতে কাসালং ও চেঙরি নদীর উজানে লঙডু, বরকল, বাঘাইছড়ি থানায় পুনর্বাসিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে ১৯৬২ সালে বাঁধ নির্মান শেষ হলে এই এলাকাও পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যায় এবং এ মানুষগুলো দ্বিতীয়বারের মতো উদ্বাস্তু হয়। উন্নয়ন অর্থনীতির ভাষায় “এনভাইরনমেন্টাল রিফিউজি” হয়ে যায়। দাতা সংস্থার পরামর্শকদের যুক্তি ছিলো, যেহেতু পাহাড়ীরা জুম চাষের প্রয়োজনে ৫/৭ বছর পর পর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে অভিবাসন করে তাই যাযাবর এ মানুষগুলোর জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সরকারী প্রশাসন বলেছে, প্রকল্পে নাকি অর্থের অপ্রতুলতা ছিলো। কিন্তু একলক্ষ মানুষের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে একই সময়ে রাজধানীবাসীকে আলোকিত করতে কাজ চলেছে ১৩২ কেভি ঢাকা-চট্রগাম বিদ্যৃৎ সন্চালন লাইন ।
শুরু হয় আবাস আর জীবিকার সন্ধানে সব হারানো এ মানুষগুলোর হেঁটে চলা।তাদের ভাষায় ‘বড়া পাড়াঙ’ বা মহা প্রয়ান। হাটতে হাটতে কেউ গিয়েছে ভারতের ত্রিপুরা, কেউ আসাম, কেউ মিজোরাম আবার কেউবা সূদুর অরুণাচল প্রদেশ। আর এক দলের গন্তব্য হয়েছে বর্মা, যে যেখানে পেরেছে। বিভিন্ন সূত্র মতে, উদ্বাস্তু এ জনগোষ্টীর প্রায় ৪০ হাজার ভারতে এবং ২০ হাজার মানুষ মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি দেয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা সেখানে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ মানুষগুলোর তৃতীয় প্রজন্ম এখন নতুন করে সংকটাপন্ন। ১৯৯৫ সালে অল অরুনাচল প্রদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের বয়কটের ডাক দেয় এবং তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্দোলন শুরু করে। রাজ্য প্রশাসনও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে উদ্বাস্তু এ মানুষগুলোর রেশন, স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয়, তাদের স্কুলগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় নির্বিচারে। ১৯৯৬ সালে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চাকমা রিফিউজি পিটিশনের মাধ্যমে উদ্বাস্তু মানুষগুলোর নাগরিকত্বের আবেদন করলে সুপ্রীম কোর্ট অব ইন্ডিয়া কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু অল অরুনাচল প্রদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আন্দোলন এবং প্রশাসনের অনিহার কারণে বিষয়টির আজো মীমাংসা হয়নি। অরুণাচল ছাড়া অন্যত্র যারা গিয়েছে তারাও এখনো রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন।
পাঠক, সবারই জানা এই ইতিহাসের শুরু করেছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। কিন্তু এই একটি বিষয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কোন সরকারই নীতি বদলায়নি। আপনারা জানেন- ক্ষমতার হস্তান্তর হয়, গোত্রান্তর হয়, কিন্তু তার মূল এজেন্ডা আধিপত্যের কোন পরিবর্তন হয় না, কেবল অবস্তান্তর ঘটে। তাই ঘটেছে এখানেও। দুনিয়ার অন্যতম সামরিক অধ্যূষিত এলাকা পার্বত্য চট্রগামের পাহাড়ে পাহাড়ে বাংলাদেশের আধিপত্যবাদী শাসকরা বসিয়েছে জলপাই ছাউনী।
গৃহহারা অসহায় মানুষগুলো আরো গভীরে, আরো আড়ালে গিয়েও যখন শুধু মৃত্যুই দেখেছে তখন বাঁচার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে, লজ্জা পেতে পারি এমন কিনা কর্ম বাকি রেখেছি আমরা? খুন , গনহত্যা, ধর্ষণ………………
তাই পাঠক, চলুন ক্ষমা চেয়ে নিই, তারপর যাই মিছিলে।
…….পাহাড়ী নদীর সুখ নাই
কোন নদীর রা নাই
রক্ত নাই রক্ত নাই রক্ত নাই
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ২:৫৭