(শতদ্রু একটি নদী আইডির ছেলেটি আমার খুব প্রিয় একজন ব্লগার। ওর আইডিয়াতেই ভাগ ভাগ করে লেখা গল্পটা একবারে প্রকাশ করলাম। আমার ব্লগ আমি নিজে ছাড়া খুব একটা পড়ে না কেও। তাই কারো কিছু যায় আসেনা হয়ত। আমি নিজের আনন্দে লিখি; নিজের জন্যে লিখি। আমার ব্লগ বাড়ি আমার বৃদ্ধ বয়েসের আস্তানা হবে আরকি। সবাইকে শুভেচ্ছা)
এক
আজ দুদিন হল আমি নিজের চিলেকোঠায় বন্দী। ব্যাপার কিছুই না; ফেল মেরেছি দুই সাবজেক্টে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে দেবে না নিশ্চিত। তবে আপাতত সেটা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কারণ সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি; এই হতচ্ছাড়া জীবন আর রাখব না। আমার কল্পনার ভুবন, আমার লেখার খাতা, ক্রিকেট ব্যাট, আম্মুর হাতের পায়েস, সব ছেড়ে আমি আজ প্রস্তুত অজানা ভুবনের যাত্রার জন্যে। পরীক্ষা ভালই হচ্ছিল। তবে ম্যাথের দিন যে কি হল।ম্যথের বদলে মাথায় ঢুকে গেল সে।
স্বর্ণলতা; আবছায়া সুন্দর; ভাবতেই শিহরণে লোমকূপ দাড়িয়ে যায়। আচ্ছন্ন করা এক অনুভুতি; হয়ত খুব পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল সে। হয়ত ওর দেহের ভেতর থেকে এক নিস্পাপ আত্মা আমার আত্মাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত শুনিয়েছিল আমাদের আগামী দীর্ঘ যাত্রার খুঁটিনাটি।আত্মা বিহীন শরীর আমার দুইটা ঘণ্টা বসে কলম চিবিয়েছে পরিক্ষার হলে। বন্ধু রনি যখন জিজ্ঞেস করল পরীক্ষার কথা আমি তখন ঘোরে।
# দোস্ত, আজকে আবার হইসে ঐরকম!
=কিরকম?
#স্বর্ণলতা!
=ধুর হালা! যে মাইয়া নাই তারে নিয়া এত ভাবস ক্যম্নে? আর কি ভাবস তুই ক তো?
আসলেই আমি জানতাম না; কেন আমার মনে হত স্বর্ণলতা রক্ত মাংসের একজন। চিলেকোঠার রুমটায় চোখ বন্ধ করে বসলেই; কাঁধে ওর নিশ্বাস টের পাতেম। লেখার খাতা খুলে বসতাম তখন। আব জাব লিখে ভরে ফেলতাম শুধু। ঘুমোতে যাবার সময় অনুভব করতাম আমার পাঁজরে কার নরম মুখ;উষ্ণ ভেজা নিঃশ্বাস আমার রোমকূপে। নিখুত ছন্দে আমার নিঃশ্বাস মিলে যেত ওর সাথে।
খুব কাছের কিছু বন্ধুকে কয়েকবার ওর কথা বলার চেষ্টা করেছি; লাভ হয়নি। শুধু হাসাহাসি করে ওরা। আম্মুকে আমার সব কথা বলে অভ্যাস ছোটবেলা থেকে। কিন্তু এই বিষয়টা আম্মুকেও বলতে পারছিনা। অবশ্য পরিক্ষার রেজাল্টটা আমাকে মাটিতে টেনে নামিয়েছে। আমি মোটামুটি ভাল ছাত্র ছিলাম। ফেলের অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। শুধু ফেল নয়, ফেল করে মার্কশীট টাও কাটাছেড়া করে ঠিক করতে চেষ্টা করেছি। ফার্মগেটের এক “মামা”র দোকানে বসে নকল মার্কশীট টাও বানিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। কেন যেন সেইটা আর জমা দেয়া হয়নি।
কাটাছেড়া মার্কশিট টা নিয়েই আব্বুর সামনে দাড়ালাম দুদিন আগে।
#দুই সাবজেক্টে ফেল করেছি
ঠাস করে একটা চড় আশা করছিলাম; কিছুই হলনা! আমাকে কিছুই বলা হলনা। আব্বু আমার সাথে কোন কথা বলেনি দুদিন ধরে। আম্মুও কেমন যেন মুখ ফিরিয়ে রাখছে।
গতকালই হয়ত লাফিয়ে পড়তাম আমার চিলেকোঠার ছাদটা থেকে। বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলাম বাউন্ডারী ওয়ালটার উপর। পাশের বাসার একটা উৎসুক চোখ আমাকে দেখছিল। আমাকে সে প্রায়ই দেখে এই কাজটি করতে। তাই কোন ভাব বিকার হয়নি তার। চোখটা বন্ধ করতেই কাঁধে সেই নিঃশ্বাস। চমকে উঠে নেমে এলাম দ্রুত।আমার স্বর্ণলতা; রক্ত মাংসের স্বর্ণলতাকে ফেলে যেতে মন চাইছিল না।
তবে আজ সকালে উঠে আবার মনস্থির করে ফেললাম; যাব যখন ঠিক করেছি একবার; যেতেই হবে। তবে যেদিন স্বর্ণলতাকে চর্মচক্ষুতে দেখব; সেদিন বিকেলে; গোধূলি দেখতে দেখতে ঝাঁপ দেব।আপাতত মুলতুবী রইল মরবার প্রজেক্টে।
তা আব্বু তৃতীয় দিন থেকে স্বাভাবিক হল। আম্মু বোধহয় কিছু বুঝিয়েছে। আমাকে নিয়ে কলেজে দেখা করতে গেল; মাথা নিচু করে বসে থাকলাম প্রিন্সিপাল স্যরের রুমে। আমাকে বিশেষ বিবেচনায় দ্বিতীয় বর্ষে তোলা হল; কারণ বের হয়েছে আমি আসলে একটি সাবজেক্টে ফেল মেরেছি। কলেজের ঘাপলা হয়েছিল বলে আমার উপর এই দয়া বর্ষিত হল হয়ত।
তবে আমি আমার স্বাধীনতা হারালাম অনেকটাই। আমাকে কঠিন নজরদারিতে আনা হল। আমার ‘জ্ঞ্যান’ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভর্তি করা হল প্রাইভেট টিউটরের কাছে। সময়টা তখন অন্যরকম বাংলাদেশে। আইসিসি ট্রফি জিতে এসেছে সদ্য। আমরা একেকজন তখন বুলবুল, নান্নু, আকরাম, সাইফুল কিংবা শান্ত হবার স্বপ্ন দেখতাম। প্রচণ্ড নেশা হল ক্রিকেটে। ক্রিকেট আর পড়ালেখা। স্বর্ণলতা একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগল।
হটাত একদিন; একগাদা হিজিবিজি আবছা ফটোকপির নোটের পেছনে, গোটা গোটা অক্ষরে একজন প্রশ্ন একে দিল
“চারিদিকে অনেক শব্দ, একটু নিরবতা চাই; পাওয়া যাবে কি?”
দুই
আমি ভাবছি এ কেমন প্রশ্ন; কেও নিরবতা কেন চাইবে। আমার তো ভালই লাগে; চিরিদিকে কত ভাললাগা ধ্বনি।
আমি দোয়েলের ডাক নকল করতে পারি; আশে পাশের পিচ্চি মেয়ে গুলা ভাবে এইগুলা ওদের উদ্দেশ্যে দেয়া। অবশ্য ঝ্যমটা দিয়ে বারান্দা থেকে উঠে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন রি-একশন বা একশন নেয়নি বাবা চাচা ভাইদের দিয়ে। আমার বাসার পাশ দিয়ে সুর করে যে লোকটা “মুরগিইইইইইইইইই” বলে ওঠে; সেখানেও একটা মুর্ছনা আছে।আমি দু’একবার চেষ্টা করেছি; আসেনা ঠিক। সন্ধ্যে বেলা মাগরিবের আজানের পর বিটিভিতে কিছু সময়ের জন্যে হামদ নাত দেখাত। কি সুন্দর, মিষ্টি ধ্বনি! আমার প্রায় সবগুলো A টু Z মুখস্ত ছিল।
আমি লিখতে বসলাম। আব জাব লিখলাম, সাথে একটু ভাব নেবার জন্যে লিখলাম; জীবনের একটা সময়; যখন আমি একা থাকব; নীরবতাটুকু ঐ সময়ের জন্যে বরাদ্দ থাক। আমার সরব দুনিয়াই ভাল লাগে।
স্বর্ণলতা মাথার ভেতর আর আগের মত ঘোর জাগাত না। আমি আমার লেখার একজন পাঠক পেয়ে গেলাম। সত্যি বলছি; ওকে আমার মনে হয়েছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তবে মজার ব্যাপার হল; সামনাসামনি কথা খুব কমই হত। আমাদের ভেতর লেখা আদান প্রদান হত শুধু। সেগুলো সাহিত্য ছিল কিনা জানিনা। তবে চিঠি ছিল না অবশ্যই। আমার গল্পের বই পড়া জ্ঞ্যান পুরোই ঢেলে দিলাম। কখনও শাদা কাগজে; কখনও নোটের পিছে; কখনও প্র্যাক্টিকাল খাতার ছেড়া পাতায়! ওর সাথে স্বর্ণলতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ওকে লিখেছি আমার সব স্বপ্নের কথা। আমার সব ভাল লাগার কথা। আমার মনের অলিগলি লেখার অক্ষরে তুলে দিতাম শুধু।
ওর লেখা হাতে পাবার পর আমি শুধু চেয়ে থাকতাম কিছুক্ষন! মনে হত কোন এক শিল্পী ছবি একেছে; আমি এত সুন্দর লেখনী দেখিনি আগে কখনও। আর আমার হাতের লেখা পাশাপাশি ধরলে দুঃখে কান্না পেত! মনে হত সদ্য হাতেখড়ি হয়েছে আমার!
এমন একটা সময় আসল, আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম ওর লেখার। আমার পড়ালেখা আবার শিকয় উঠল। এতদিনে আমি আমার মনের মত একটা কাজ পেয়ে গেছি যে! পড়ার বই খুলে হা করে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘণ্টা। যথারীতি ফলাফল হাতে পেলাম! দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি, কিন্তু আমি প্রায় কিছুই পারিনা। তবে এইবার আর আগের মত মরতে ইচ্ছে হয় নি। আমার ভেতরে কেও একজন বলল; লেখাটা বন্ধ কর! নাহলে তুই শেষ! নিজের মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে লিখলাম আমার শেষ লেখা! আর লিখবনা তোমাকে! বিধাতা বোধ হয় মুচকি হেসেছিলেন।
পরের সময়টা বেশ কঠিন ছিল আমার জন্যে। অন্যদের চেয়ে অনেক পেছনে আমি। তাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ওকে না লিখে আমার মন পুরোই বিক্ষিপ্ত তখন। এদিকে নিজে থেকে বলেছি আর লিখব না। তা শেষ পর্যন্ত লজ্জ্যার মাথা খেয়ে আবার লিখে ফেললাম ওকে। কেমন একটা সুখ সুখ অনুভুতি হল। সবকিছু আবার আগের মতই; তবে পড়াশনায় এবার ভালই মন বসল। ধীরে ধীরে সব সাবজেক্ট গুলো আবার মাথায় ঢুকতে লাগল। ও অনেক ভাল ছাত্রী ছিল; পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। আমিও সিরিয়াস হয়ে গেলাম। শুধু বুঝতে পারলাম; আমাকে সারাজীবন লিখে যেতেই হবে ওকে। এ থেকে আমার মুক্তি নেই!
আমাদের মধ্যে ভালবাসার কোন গল্প হতনা। তবে দুজনেই দুজনকে খুব ভাল বন্ধু হিসেবে পছন্দ করতাম। ইন্টার পরীক্ষা শেষ হল। দেখা গেল আমার শেষ মুহূর্তের উপলব্ধি আমাকে একটি চলনসই ফলাফল দিয়েছে। আমরা দুজনেই ভর্তি হলাম ‘বুয়েট কোচিং’ এ। মাঝে মাঝে ওকে লিখি। ওর সাথে স্বর্ণলতার তুলনা করি। ক্রিকেট খেলি। ভালই চলছিল আমার জীবন। আস্তে আস্তে সম্পর্কটা একটা ভিত্তি পাচ্ছিল। আমি ওকে নাম দিলাম; আমার বিবেক!
হটাত একদিন একটা ফোন আসল;
“হ্যালো; একটু সময় হবে?”
তিন
এক অপরিচিতার কন্ঠে বিশেষ অনুনয়! সময়টা তখন ল্যান্ডফোনের। ইচ্ছে হলেই পরিচয় গোপন করে কথা বলা যায়।স্কুলে বিশেষ লাজুক ছিলাম বলে আমার কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না। আমার “বিবেক” আমার প্রথম মেয়ে বন্ধু; মানে রক্তমাংসের আরকি।
অনেকটা সময় অপরিচিতা নিয়ে গেল। আমি তার ফোন নাম্বার জানতাম না। আমার অনেক কিছুই তার জানা।বাসার সবাই দেশের বাড়ি গেল দাদার মৃত্যু বার্ষীকি পালন করতে। আমাকে রেখে গেল আমার পড়াশোনার কথা ভেবে; আর আমার পড়াশোনার সময় নিয়ে নিল সন্ধ্যে বেলার ফোন। কিছুদিন পর এমন হল, সন্ধ্যেবেলায় তার ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম। আমার “বিবেকের” কাছে বললাম এই বিশেষ “ফোন” বন্ধুর কথা। ও কিছু বলল না! হটাত একদিন বুয়েটের কোচিং ছেড়ে চলে গেল অন্য কোচিং এ পড়তে। কাওকে “মিস” করার অনুভুতিটাও পেলাম জীবনে প্রথম।
অচেনা মানুষেরা একটু অন্য রকম সুবিধা ভোগ করে। রহস্য রহস্য ব্যাপার স্যাপার। হয়ত অচেনা এক মেয়ের সাথে কথা বলছি, এটাই মুখ্য ছিল তখন। বেশ কিছু সময় ব্যায় করতাম অপরিচিতার পরিচয় খুজতে। আর আমার আশে পাশের মেয়েদের সাথে মেলাতে চাইতাম তাকে।বন্ধুদের সাহায্য নিতে গিয়ে আরও ঘোরাল হয়ে উঠত ব্যপারটা।
-ঐ মাইয়ায়াটা তোর দিকে আজকে পুরা ক্লাস চাইয়া ছিল; ঐটাই মনে হয় ফোন করে
-কস কি, সত্যি??
-হ, আল্লাহর কসম।
কয়দিনের গোয়েন্দাগিরির পর আবার আমার কাছে রিপোর্ট আসে
-নারে, এইটা না মনে হয়; ডাইন কোনার ঐ মাইয়ায়াটা মনে হয়!
-কস কি, সত্যি???
-হ, আল্লাহর কসম।
যাই হোক, সে আমাকে খুব কাছ থেকে আমার সব দেখত; আর ফোনে সেসব বলে আমাকে আরও বেশি কৌতূহলী করে তুলত।
-তুমি আজকে নীল টি-শার্ট পড়ে এসেছিলে!
-নাতো; নেভী ব্লু!
-হ্যা; ঐটাই হে হে! ভাল লাগছিল!
-হুম; নাম বললে না তো এখনও
-সুমনা
-ধুর; এই নামে কাওকে চিনি না আমি।
-হা হা হা
অর্থবিহিন বিভিন্ন কথা বার্তা। বয়েস আমার সতের তখন। মনের অলিগলি হাতড়ে নিজেকে বিশেষ কিছু প্রমান করতে চেষ্টা করতাম কথায়।যা নই; তাও। এখন বুঝি এটাকেই সবাই Flirting বলে।
-আমি কিন্তু ভাল গোয়েন্দা হতে পারতাম!
-তাই নাকি? কেন মনে হচ্ছে? আমার পরিচয় জেনে গেছ?
-নাহ; আমার Instinct খুব ভাল, মনে হচ্ছে তোমার বাসার আশে পাশে একটা রেল লাইন আছে।
-এই যাহ কিভাবে বুঝলা
-হে হে, আছে একটা ব্যাপার!!
আসলে কথা বলার সময় আমি ট্রেনের শব্দ শুনেছিলাম একদিন, সেটাকেই Instinct বলে চালিয়ে দিলাম। তবে আমি আমার “বিবেকের” কাছে স্বচ্ছ ছিলাম সবসময়। ওর কাছে নিজেকে বড় করার কোন প্রয়াস ছিল না কখনও। মানুষ তার পুরো জীবনে বিভিন্ন রকম “অন্য আরেকজন” হয়ে বেচে থাকে। ওর কাছে আমি “আমি” হয়ে উঠতাম। এ যেন আমার বিভিন্ন সত্তা; ফোনের আমি আর লেখার আমি
পড়াশোনার আমি আবার চাঙ্গে উঠে গেল।
ভালই চলছিল সব; আমার কল্পনা বিলাসী মনের উর্বর ভুমিতে রচিত হচ্ছিল নিত্য নতুন ফ্যান্টাসি। রক্তমাংসের স্বর্ণলতার স্বপ্নটায় নতুন নতুন “ফিচার’ যোগ হচ্ছিল এবং অবধারিত ভাবেই মনে হয়, অপরিচিতার আলাপচারিতায় একদিন অন্যধরনের কথা উঠল।
-কাওকে ভাললাগার ব্যপারে তোমার কি মত বলত?
-ভাল লাগা? মানে ভালবাসার কথা বলতেস?
-হ্যা; ঐটাই হে হে
-হুম, চিন্তার বিষয়!
আমার বলিউড লদ্ধ জ্ঞ্যান বলছে, ভালবাসা হচ্ছে একটা “বিশেষ” ব্যাপার।আর পরিবার লদ্ধ জ্ঞ্যান বলছে ব্যপারটা অনেকটাই “নিষিদ্ধ” জোনের।আর আমার মন বলছে; I don’t have a damn clue!!
যেহেতু আমি বিশাল ভাব নিতাম অপরিচিতার সাথে যে আমি বিশাল “চিন্তুক” আমাকে এমন একটা উত্তর দিতেই হত যেটা শুনে সে অভিভূত হয়ে যাবে।
-আমার মনে হয় “ভালবাসা” ব্যপারটা পরিবর্তনশীল সুচক; যেটা পরিচয় আর সময়ের সমানুপাতিক!
পরিচয় কথাটার উপর বেশি জোর দিলাম; কারণ আমার কৌতূহলের সমাপ্তির পথ ঐটাই!
কিছুক্ষন চুপ থেকে অপরিচিতা বলল; দেখা করতে চাই তোমার সাথে।
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাব নেয়া এক ব্যাপার আর সেই ভাবের সামনা সামনি হওয়া এক নয়!তবে অপরিচিতার পরিচয় জানার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বিশাল একটা লেখা লিখলাম আমার “বিবেকের” কাছে। কিন্তু অজানা কারনে অপরিচিতার সাথে দেখা করার কথা এড়িয়ে গেলাম।
আমি ভালবাসা জানিনি তখনও; আমি প্রেম জানিনি তখনও
নিছক কৌতূহল মেটাতেই দেখা করলাম অপরিচিতার সাথে।
আমাকে বলল ও,
“আমি তোমাকে ভালবাসি"
চার
“আমি তোমাকে ভালবাসি”
অপরিচিতার দ্বিধাহীন উচ্চারণ
একেই বোধ হয় বিনামেঘে বজ্রপাত বলে! এত সরাসরি প্রস্তাব আসবে ভাবিনি, আমি সেটার জন্যে প্রস্তুতও ছিলাম না। পরিচিতার পরিচয় নিয়ে আগ্রহী ছিলাম অবশ্যই; কিন্তু এই প্রস্তাব আমার কল্পনাবিলাসী মনের জন্যেও একটু অতিকল্পনা মনে হল। ভালবাসা নিয়ে পড়ে ফেলা হুমায়ুন আহমেদ, সুনীল, সমরেশের বইয়ের পাতায় ফিরে চলেছিল আমার মস্তিষ্ক খুব দ্রুত বেগে। ওগুলো পড়বার সময় “প্রেম” অনুভব করেছিলাম কল্পলোকের চরিত্রের সাথে। কিছু বই শেষ করে চোখের পানি ফেলে মুখ চুন করে ঘুরেছি বেশ কিছুদিন। কিন্তু, এখন, এই বাস্তব মুহূর্তে আমার সামনে এক নারী; ভালবাসার আবেদন নিয়ে নয়; ভালবাসে জানিয়ে।
আমার মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় খেলে যাচ্ছে।চোখ বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। এই প্রথম মনে হল; কল্পনায় আমি স্বর্ণলতাকে যেভাবে চেয়েছি; বাস্তবে তাকে গ্রহণ করতে আমি তৈরি নই। প্রেম ব্যপারটাই তালগোল পাকিয়ে মাথায় জট লাগিয়ে দিল।
কিন্তু “আমি তোমাকে ভালবাসি” সম্ভবত একমাত্র বাক্য, যেটা কোন প্রশ্ন নয়; কিন্তু উত্তর আশা করে।
কি উত্তর দেব আমি? ভ্যবাচ্যকা খেয়ে বললাম,
-ওহ আচ্ছা
-ওহ আচ্ছা?? সেটার মানে কি হ্যা?
-হুম, না ঠিক তা না!
-মানে কি? না?
-না, ঠিক তাও না!
-মানে কি তাহলে?
-মানে হচ্ছে, আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছিনা আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা!
কিছু বিচ্ছিরি নিরবতা কোচিং সেন্টারের করিডোরটায়। অপরিচিতা, যে কিছুক্ষণ আগে একটা পরিচয় পেয়েছে; আরও নতুন পরিচয়ের জন্যে দাড়িয়ে আমার সামনে। আমি মাথা নিচু করে আছি। আর সামনে দাঁড়িয়ে ও কাঁদছে।
-অন্য কাওকে ভালোবাসো?
-না
-ও আচ্ছা
-না, আসলে আমি ঠিক জানিনা; ভালোবাসার অনুভূতিটা কেমন হয়।
-সময় নেও!
-কত সময় নেব?
-যতদিন লাগে, একবছর, দুই বছর!
-তারপর?
-তারপর উত্তর দিও!
আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমার মাথার ভেতর কেবল “বিবেক” ঘুরছে। ওকে লিখতে হবে। ঠিক, ভুল, ভাল, খারাপ সব আমাদের মাথার ভেতর তৈরি হয়। আমার মনে হয় যিনি আমাদের বানিয়েছেন, তিনি মাথার ভেতর এই ব্যাসিক পার্থক্য করার “Logical Algorithm” সেট করে দিয়েছেন। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল অপেক্ষায় রাখার এই প্রস্তাবটি ঠিক নয়, ঠিক হচ্ছেনা। কোথাও গণ্ডগোল আছে।
-২ বছর পর যদি মনে হয় ভালোবাসিনা?
-তখন চলে যাব।
-সেটা কি ঠিক হবে?
-সত্যি করে বলতো, তুমি কি অন্য কাওকে ভালোবাসোনা?
-না, ভালোবাসিনা; তবে আমার বন্ধু “বিবেকের” সাথে সব শেয়ার করি।
-কি শেয়ার কর?
-ভাল লাগা, খারাপ লাগা, স্বপ্ন, সত্যি হাবিজাবি সব কিছু। আমার আত্মিক জগতের একক হচ্ছে ও। ওকে মিস করি যখন, তখন লিখতে বসি। যখন মিস করিনা তখনও লিখতে বসি। ওর রিকশার পেছনে সাইকেল চালিয়ে চলে যাই বহুদুর। ওর “মহামানব” হবের স্বপ্নের সাথে তাল মেলাতে আমারও ইচ্ছে করে “মহামানব” হতে।ও পাশে থাকলে অকারনে হাসি। ওর লেখা পড়ে অকারনে হাসি। ওর ফোন এলে অকারনে হাসি। ওর হাত ধরে যেদিন লোকাল বাসে টেনে তুলেছিলাম, আনন্দময় এক অনুভুতি ছড়িয়ে পরেছিল। একি স্কুলে পড়তাম আমারা, জানো? স্কুলে কেন পরিচয় হয়নি এই নিয়ে আফসোস আছে একটা।ও যখন হাসে তখন মনে হয় কি যেন একটা ওলটপালট হয়ে গেল মাথার ভেতরে। ও কখনও মিথ্যে বলেনা; আমিও ওকে চাইলেও কোন মিথ্যে বলতে পারিনি। তোমার সাথে ভাব নেবার জন্যে আমি বানিয়ে বলেছি অনেক কিছু; ওর সামনে দাঁড়ালে আমার আমার ভাব গুলো উবে কই যেন হারিয়ে যায়। ভালবাসা নিয়ে কথা বলতেও সাহস পাইনি কখনও। যদি ও ভুল বোঝে; যদি আমার “বিবেক” হারিয়ে যায়! আমি ওকে ভালোবাসিনা; আমি ওকে হারাতে চাই না!
-ওকে বলেছ এইসব?
-ধুর; এইসব বললে ওকে আর লিখতে পারব না কখনও!
-কেন এমন মনে হচ্ছে? তুমি ওকে ভালবাস, তাই না?
-এই যাহ!এইটাকে ভালবাসা বলে নাকি? It’s a friendship that I don’t want to ruin by giving it a name!
-তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন?
আমি নিজেই কি জানি; আমার সতের কি আঠার বছরের অভিজ্ঞতায় এই প্রস্তাব থেকে মুখ ফেরাবার সাহস থাকার কথা নয়।
আমার সমস্যা কি? কোথায় ভুল হচ্ছে? কিছু বলা উচিৎ এই মেয়েটাকে। কঠিন কিছু। যাতে আমার দিকে আর মুখ ফিরে না চায়! আমি যেই অনুভুতির ব্যপারে নিশ্চিত নই, সেটার জন্যে কিভাবে কাওকে আটকে রাখব?
-আমি তোমাকে ভালবাসিনা, দুই বছর পরে বলার দরকার নেই, এখনি বলে দিচ্ছি; আমি তোমাকে ভালবাসিনা; I don’t love you!
আমি জানি, এতটা কঠিন বাক্য ওর প্রাপ্য ছিল না।ওর কোন দোষ নেই; আমিই দায়ী সব কিছুর জন্যে। অপরিচিতার সাথে পরিচিত হবার লোভ আজ আমাকে এমন এক মোড়ে এনে ফেলল; যেখানে আমার বয়স হটাত অনেক বেড়ে গেল। সময়টা তখন সন্ধ্যে; আমি করিডোরে দাড়িয়ে। আমার সামনে থেকে পরিচিতা উল্টো ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি পেছনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। অনেক দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল ও কাঁদছে।
আমি হটাত করেই বুঝে ফেললাম ভালোবাসা ব্যাপারটা। আমি জেনে গেলাম আমি পাগলের মত ভালবাসি আমার “বিবেক” কে। কিন্তু ওকে আমি কখনই বলতে পারবনা। আমাকে সারাজীবন এইটা বুকের মধ্যে চেপে ওর “ভাল বন্ধু” হয়ে কাটাতে হবে। অপরিচিতাকে আমি যেভাবে ফিরিয়ে দিলাম; হয়ত “বিবেক”ও আমাকে সেই ভাবেই ফিরিয়ে দেবে।
পরদিন সন্ধ্যা; আমার বন্ধুরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল অপরিচিতার পরিচয় জানার। কিন্তু আমার শুকনো মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে আর জিজ্ঞেস করছিল না। তবে রনি ওর কৌতূহলের কাছে হার মানল। ওর নাম বলতেই;
-আমি কইসিলাম না, ঐটা!
-আমি আগেই বুঝবার পারছিলাম!
-আমার মনে হইতেছিল, তোরে কই নাই আরকি!
-তোর দিকে যেমনে চাইয়া থাকত; আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।
চারদিক থেকে ওদের উচ্ছসিত উক্তি আমার মধ্যে কোন প্রভাব ফেলছিল না দেখে কামরুল জিজ্ঞেস করল
-কিরে, দেখসস বুঝলাম, পছন্দ হয় নাই?
হটাত করেই ওদের সবাইকে আমার শিশু মনে হচ্ছিল। আমার মনের ভেতর যেটা চলছিল সেটা ওরা কেও বুঝতে পারবে বলে মনে হচ্ছিল না। আমি কোন উত্তর দিলাম না। আসলে উত্তর দেবার মত কিছু ছিলই না।
অপরিচিতাকে ফিরিয়ে দিয়েছি; ভালবাসা খুজে পেয়েছি! আর একটা অপ্রতিরোধ্য ভয় আমাকে জেঁকে বসেছে; সব হারাবার ভয়!
আরেকটি সত্য উপলব্ধি করলাম
ভালবাসা একটি যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার স্যাপার; বুকের মধ্যে কারণ ছাড়াই ব্যাথা হয়।
আমার চোখের কোনে জল;
বাহিরে তখন অনেক মেঘ করেছে!
পাঁচ
২৪ ডিসেম্বর ২০১২। আটলান্টিকের নীল পানি আছড়ে পড়ছে সোনা রাঙা বালিতে। ডুবতে থাকা সূর্যের রশ্মি দূর দিগন্তের কাছে নীল আটলান্টিককে কেমন অপার্থিব করে তুলছিল। দুরন্ত কিছু আফ্রিকান শিশু ঝাপিয়ে পড়ছে দানব সম ঢেও উপেক্ষা করে। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে, বিষুব রেখার একদম কাছাকাছি বসে আছি আমি।সাড়ে ছয় হাজার মাইল দূরে আমার প্রিয়তম স্ত্রী প্রহর গুনছে একা, আজ কোন একসময় জন্ম নেবে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। বিষণ্ণ মনে অপেক্ষা; উৎকণ্ঠা; আনন্দ সব মিলে মিশে একাকার। সব কিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে ওকে একা ছেড়ে আসার অপরাধবোধ। কথা দিয়েছিলাম পাশ ছেড়ে যাব না কখনও।
২৪ জুলাই ২০০৯ কিছুটা অন্যরকম ছিল। অপারেশন থিয়েটার এর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আশে পাশে সব প্রিয় মুখের মাঝেও কেমন একা লাগছিল নিজেকে। দৃষ্টি আঁটকে ছিল দরজায়; অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা, আনন্দ ছিল। স্রষ্টার নাম জপে যাচ্ছিলাম অবিরাম। একসময় দরজার ওপাশ থেকে তোয়ালে মোড়ানো একটা পুতুল নিয়ে আসলেন একজন।আমি বিস্মিত; একটি মানব শিশু এখন থেকে নাকি আমার হল! আমি কোলে নিলাম; পুতুলটা ভেংচে দিল আমাকে! আমার অপেক্ষা তবু ফুরোয় নি; কখন আসবে ও? ওর হাত ধরিনি কতক্ষন!
১৭ জুন ২০০০। মুখোমুখি দুজনে। হাত ধরে বসে আছি রমনা পার্কের ভেতরের রেস্তোরাটায়। অনেক্ষন হল কেও কোন কথা বলিনি আমরা। মনের ভেতর ঝড় বইছে। আজ আমাদের শেষ দেখা, আজ বিদায়ের দিন। ১৯ জুন থেকে আমার প্রশিক্ষন শুরু বি এম এ তে। আকাশে বোধ হয় অনেক মেঘ ছিল, টেবিলে বোধ হয় একটা কদম ফুল ছিল। হাত ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করেনি তখনও; এখনও করেনা।
১১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ একটা ফোন এসেছিল। আমার "বিবেক" আমাকে ফোন দিয়েছিল; কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার পর;
-তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
-- হ্যা, বাসিতো!.।.।.।।তুমি??
-আমিও!!
হাজার মাইলের পথের শুরু হয় একটি পা ফেলার পরেই; জীবনের গল্প গুলোও এগিয়ে চলে ছোট ছোট পদক্ষেপে। জীবনে কোন হারজিত নেই; শুধুই অভিজ্ঞতা আছে। আমার 'বিবেকের' সাথে পার করা প্রতিটি দিন একেকটি নতুন এডভেঞ্চার! কখনও সেখানে আনন্দ আছে; কখনও বিষণ্ণতা আছে। সব কিছু মিলিয়েই আমাদের যাত্রা। মাঝে মাঝে আমাদের সাথে এসে যোগ হয় অনেকে, অনেকে হারিয়ে যায়। অনেকে দুঃখ ভাগ করে নিতে চায়; অনেকে সুখ ভাগ করে নিতে চায়। আমি আর ও; আমরা হাত ধরে পার করি সব; আমরা আলিঙ্গনে পিছু ঠেলি সব!
আমার প্রতিদিন শুরু হয় ওকে ভালবেসে।
সত্যি বলছি, এটা প্রেমের গল্প নয়।
পুনশ্চঃ অপরিচিতার বিয়ে হয়ে যায় আমেরিকা প্রবাসী এক জনের সাথে। ওর ভালবাসার প্রতিদান আমি দিতে পারিনি; তবে ওর কাছে আমরা ঋণী; আমার ভালবাসার কথা সেই পৌঁছে দিয়েছিল 'বিবেকের' কাছে! যেখানেই থাক; ভাল থেক তুমি! স্রষ্টা তোমার জীবন ভরে দিক সুখে!
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৫ দুপুর ২:৪৩