টার্কিশ বিমান বন্দরে যখন পৌছালাম, তখন হাতঘড়ি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। আরো তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। সাব্বির স্যার দের হোটেলের ঠিকানা জানা থাকলেও হত। দীর্ঘ ঘোরা ঘুরির অবশ্যম্ভাবী ক্লান্তির সাথে যোগ হয়েছে ঘামের চিটচিটে অনুভূতি। একটা আয়েশি গোসল দিতে পারলে! তা এই বিমান বন্দরে সেই ব্যবস্থা আছে বৈকি। তবে তার জন্যে কিছু নগদ গচ্চা যাবে, যেটার পরিমাণ খুব একটা নগন্য নয়। পায়ের জুতাটা খুব ভারী লাগছিল; শেতাঙ্গদের মাঝে বসে জুতা খুলে ফেলাটা আবার আমার উপমহাদেশীয় মূল্যবোধের মধ্যে পড়েনা। বিষণ্ণ মনে সাব্বির স্যার দের আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হটাত আমার আসে পাশে পরিচিত কিচির মিচির বাড়তে লাগল; বাংলা, চাটগাইয়া, সিলেটী। আহা, এত মধুর! টার্কিশের বাংলাদেশ গামী একটিই বিমান আজ রাতে। এরা আমার সহযাত্রী। নিশ্চিন্ত মনে জুতা খুলে আসন গেড়ে বসলাম এইবার! আন্তরিকতার চূড়ান্ত ভাবে দু’তিন জনকে লক্ষ্য করে শুধলাম, ভাই, কইত্তে আইলেন!
আমরা জতি গত ভাবে বেশ বন্ধুবৎসল। অল্পক্ষণের ভেতরেই বেশ জম্পেশ একটা আড্ডা জমিয়ে ফেললাম। জামান ভাই স্পেনে হোটেল চালান। বউ বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরছেন। ডঃ এ সিদ্দিক খান প্রফেশনাল কায়দায় আলাপের শুরুতেই তার কার্ড হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি একটু হেঃ হেঃ করে বললাম, সরি, আমার টা শেষ হয়ে গেছে (নাইই তো শেষ হবে কিভাবে!)। জলি আপা দুই নেদা বাচ্চা নিয়ে একা একা দেশে যাচ্ছেন। পোশাকে পুরাই ইউরোপিয়ান মলি যাচ্ছে বাপি আর মা’র কাছে। বাপ-মা-বউ-শালী-আর ডজন খানেক আন্ডা বাচ্চা সহ মিজান ভাই হিমশিম! থাকেন লন্ডনে, যাচ্ছেনও লন্ডনে(সিলেটে)। আরও কয়েকজন ছিল আসে পাশে, নাম মনে পড়ছে না! আলাপ বেশ ভালই এগুচ্ছিল,দ্বন্দ্ব বাধল দেশের কথা ওঠায়।
কিছু টুকরো আলাপচারিতা তুলে ধরবার লোভ সামলাতে পারছিনা
-পুলাপাইন কিছু বুঝে না, হুদাই ফাল পারতাসে
-ধুর! It’s a political game!
-আমি নেটে দ্যাকচি, ঐখানে গাঞ্জাখুর গুলায় গ্যেসে।
-এইবার কিছু একটা হবে! দ্রোহের গান শুরু হয়েছে! ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই!
-ওমা, how cruel, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে দিয়ে ফাসির কথা বলাইতেসে; ইশ!
-রাজকার কি খালি জামাতি নাকি! আজীব।
-হে হে জামাতের যেই ট্যাকা আছে; সবটিরে শুয়াইয়া দিব!
-ভাইসাব, এই সব নাস্তিক গুলা নাকি হুজুর সাব রে ফাঁসি দিতে চায়; আল্লাহ্র গজব পরব!
-বাংলা পরীক্ষার সময় অঙ্কের কথা বলা যাবে না, ভালো কথা, দেখেন বাংলা পরীক্ষায় পাশ করে কিনা!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে সবারই কিছু না কিছু বলার আছে। সবাই বিজ্ঞের মত সব জেনে বসে আছে। ১৬ কোটি জ্ঞ্যানীর গরিব দেশ, অধিক সন্ন্যাসিতে গাঁজনটা আসলেই নষ্ট হয়ে গেছে। বিমানবন্দরের এই ওয়েটিং রুমটাই যেন আমার পুরো দেশ। এটাই আমাদের আসল রূপ।
আমি উঠে পড়লাম পেট পূজার লক্ষ্যে। টার্কিশ কিছু মুদ্রা এখনও আছে মানিব্যাগে। ফুড কাউন্টারে সব গুলো ঢেলে দিয়ে সুন্দরী টার্কিশ রমণীকে ফিল্মি কায়দায় বললাম, That’s all I have, what you have for me! সাথে ফ্রি হিসেবে আমার বত্রিশ দন্তের হাসি!
তা হাসির বদলে হাসি আর পয়সার বদলে কিং সাইজের বার্গার পেলাম। সাথে উপরি হিসেবে পেলাম একটা কোন আইসক্রিম। পেট পুড়ে খেয়ে এইবার চক্কর লাগালাম ডিউটি ফ্রি শপে কিছু মিছু কেনার আশায়। টার্কিশ বিমানবন্দরের এই ডিউটি ফ্রি শপে সব ব্র্যান্ডের জিনিস। দাম আকাশ ছোঁয়া। টার্কিশ ডিলাইট নামক কিছু হালুয়া টাইপ মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে। মিষ্টির প্যাকেটের উপর ফ্রি স্যাম্পল রাখা। মানে খেয়ে পছন্দ করে কেনা যায়। সাদা, হলুদ, সবুজ, লাল সব রকমের স্যাম্পল চেখে দেখলাম। হটাত দেখি সাব্বির স্যার আর সুরাইয়া ম্যাডাম বিশাল বাজারের ব্যাগ নিয়ে আমার পাশেই ফ্রি স্যাম্পল খাচ্ছেন। আমি স্যারদের চমকে দিয়ে বললাম, যা একটা মিস করলেন! সুরাইয়া ম্যাডাম হেসে দিয়ে বললেন; চলেন ছবি দেখান!
ইস্তানবুলের ব্লু মস্ক, হাজিয়া সোফিয়া আর টপকাপি জাদুঘর ছাড়াও আরও কিছু ছবি তুলেছিলাম!
টার্কিশ এয়ারলাইনের বাংলাদেশ গামী এই বিমানটায় ওঠার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই বিমানে কোনও মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা নেই! এরা জানে বাঙালি কখনও এইসব ব্যপার নিয়ে অফিসিয়াল আপত্তি জানাবে না। তবে প্রায় ফাঁকা বিমানে তিন সিটের দুইটা দখল করে বসলাম। এবং দেশী স্টাইলে জুতা মুজা খুলে শুয়ে দিলাম ঘুম। স্বর্ণ কেশীরা কয়েকবার অদ্ভুত ভাবে চাইল বটে, ধুর! কি এসে যায়; তোরা টিভি দিলি না ক্যান প্লেনের ভেতরে!!
সকাল হতে চোখ কচলে জানাল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবলাম ভুল দেখছি। চোখটা আবার ডলে তাকালাম, নাতো সত্যি সত্যি আমি এভারেস্ট দেখছি! ইস্তানবুল থেকে বাংলাদেশে আসার রুট টা নেপালের আসে পাশে হবার কথা নয়। তবে নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায়না। আমার দুর্বল ক্যমেরা দিয়ে এভারেস্ট পাকড়াও করতে চাইলাম। আসে না।
অবশ্য আমার জীবনের এভারেস্ট তখন অপেক্ষায় আছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। মায়ের কোল আলো করে আছে আমার নবজাতক! বাংলার মাটিতে পা রেখেই আবার হারলাম আমি; হয়তবা এভারেস্টের চুড়াতেই।
অতঃপর মোমবাতি হাতে কোনও সন্ধায়, বিশ্বাসী মন নিয়ে! সুতীব্র চিৎকার!
ফেরা-১ , ফেরা ২
চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:৪৮