টার্কিশ এয়ারলাইনের স্বর্ণকেশী কেবিন ক্রু গুলো বেশ আন্তরিক মনে হল। তবে ইকনমি ক্লাসের সীট গুলো ততটা আন্তরিক লাগলো না। তিন জনের সীটের মাঝখানে আমার বসার জায়গা হল। বাম পাশে সাব্বির স্যার আর ডান পাশে ডাঃ সুরাইয়া ম্যাডাম। সুরাইয়া ম্যাডাম আমাদের সাথেই দেশে ফিরছেন; মা’কে দাফন করবার আগে শেষবার দেখার জন্যে। আমি মোটামুটি স্যান্ডউইচ হয়ে বসে রইলাম।কিছুক্ষণ মুভি দেখার চেষ্টা করতে করতে খাবারের গাড়ি এসে হাজির! অনেক শুনেছি টার্কিশ খাবারের সুনাম! অল্পখনের মধ্যেই অবশ্য আশার মুখে ছাই পড়ল। একমাত্র চীজ কেকটা ছাড়া মুখে বিশেষ কিছু রুচল না। মুখ গোজ করে বসে রইলাম; এক স্বর্ণ কেশী শুধালো
-Any Juice?
-Apple?
-Finished sir!
-Orange?
-I’m afraid that is also finished sir!
আমি ভাবলাম, কি আছে কি এদের?
-What do you have?
-Tomato sir!
আমি কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললাম, OK That will do!
টমেটো জুস নামক যেই জিনিসটা ওরা দিলো সেইটা গলধকরনের জন্যে আমাকে বেশ কসরত করতে হল। ফেলতেও পারতেসিনা। সটান হয়ে থেকেই ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। আধো ঘুম আর আধো জাগরনে পাড় করলাম অনেকটা সময়। হটাত প্রভাত রবির কর আমাকে স্পর্শ করল। দিগন্তে জাগছে দিনমণি!
টার্কিশ এয়ারলাইনের একটা বিশেষ অফার আছে। ট্রান্সিট যাত্রীদের এরা ইস্তানবুল ঘুরিয়ে দেখায় অথবা একটি ৪ তারকা হোটেল দেয়; পুরাই ফ্রি! সুরাইয়া ম্যাডাম কে ঘুরতে বের হবার কথা বলাটা অন্যায় হবে, তাই সাব্বির স্যার কে বললাম। স্যার বলে, মাথা খারাপ হইসে, ৪ ডিগ্রীতে আবার ঘোরা ঘুরি কিসের! হোটেল গিয়া ঘুম!
আমি ভাবলাম কিসের কি বার বার তো আর ইস্তানবুল আসা হবে না!
-স্যার, আপনারা ঘুমান, আমি তাইলে ঘুইরা আসি!
ঠাণ্ডার কারনে কেও গাইডেড ট্যুরে আগ্রহী না থাকায় ডেস্ক থেকে ওরা বললও আরও কিছু যাত্রী হলে ওরা বাস ডাকবে। অতক্ষণ বিমানবন্দরে বসে থাকতে মন সায় দিচ্ছিল না। হাতব্যাগে একটা কালো পোলো টি-সার্ট ছিল। ফুলহাতা সার্টের উপর ওটা চাপালাম। মোটামুটি হিপহপ স্টাইলে বের হলাম।
কামাল আতার্তুক বিমানবন্দরের ঠিক নিচ থেকেই মেট্রো রেল ছাড়ে। ডলার ভাঙ্গিয়ে লিরা করলাম, টার্কিশ মুদ্রা। ১ ডলার = ১.৬৫ লিরা। মেট্রো রেলের টিকেট কাটবার সিস্টেম হচ্ছে ২ লিরা দিয়ে একটি কয়েন দেয়। একটা কয়েন দিয়ে যেকোনো স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছান যায়। সেটা যত দুরেই হোক না কেন!
উঠে তো পড়লাম, কিন্তু যাবো কই??
আমার কাছে না আছে কোন ম্যাপ, না কোনও গাইড বই। পাশে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দেখি মনোযোগ দিয়ে “Discover Istanbul” পড়তেছে।
-Hi there!
-Hey, hello kid!
আসে পাশে একটু তাকাইলাম, বুইড়া কিড কারে কয়!
আলাপে জানলাম, তিনি হচ্ছেন আমেরিকান টুরিস্ট। ইস্তানবুল সম্পর্কে রীতিমত পড়াশোনা করে বেড়াতে এসেছে। আমার অজ্ঞতায় বিমুগ্ধ হয়ে তিনি বললেন,
-No problem kid, just stick with me! I’ll take you where you need to go!
আমেরিকানদের যদিও আমি দুচোখে দেখতে পারিনা, এই বুড়োর মহানুভবতায় আমি এই শীতের মাঝেও উষ্ণ অনুভব করলাম। রেল বদল করে ট্রাম এ ওঠালেন আমাকে। মোটকথা আমাকে প্রায় বগলদাবা করে পৌছে দিলেন “ব্লু মস্ক” বা সুলতান আহমেদ মসজিদের সামনে। যাত্রাপথে আমাকে যথাসম্ভব বিজ্ঞ করে তুললেন ইস্তানবুল সম্পর্কে। আমি বাধ্য ছাত্রের মত মাথা কাঁত করে সব গিললাম।
তিনটি দর্শনীয় বস্তু একটি জায়গায়; টপকাপি প্যালেস বা জাদুঘর, হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘর আর নীল মসজিদ।
বুড়ো বললেন, টপকাপি জাদুঘর থেকে শুরু কর কিড! আমি বললাম, আপনি আসছেন না? বুড়ো হেসে বললেন, আমার এখন হোটেলে যেতে হবে। আজ ঘোরার প্ল্যান নেই!
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বুড়োর চলে যাওয়া দেখলাম। আমার দেশের মানুষ কি নিজের কাজ ফেলে একটা ভিনদেশী ‘কিড”কে এইভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দিত?
যেখানে নামলাম সেখানে হাতের ডানে ছিল বিশাল ব্লু মস্ক আর বায়ে ছিল হাজিয়া সোফিয়া। কিন্তু বুড়ো আমাকে বলেছে টপকাপিতে আগে যেতে, কারণ সেখানে এমন কিছু আছে যেটা দেখতে পাওয়া নাকি একজন মুসলিমের জন্যে বিশেষ তাৎপর্যপুর্ন।
কিন্তু প্যালেসে ঢোকার রাস্তা খুজে না পেয়ে এক টার্কিশ কে জিজ্ঞেস করলাম।
-How to get to the Topkapi Palace?
খেয়াল করিনি যে তার হাতে একগাদা বই, এবং সে আসলে একজন ফেরিওয়ালা।
-My friend, buy one book, its all there
-Thanks, but no thanks, please show me the entrance!
-My friend, good pictures, good maps, Only 40 Lira!
-I don’t need a guide book, sorry; where is the entrance?
-Ok Ok, give me 20! You are my first customer!
আমি একটু বিরক্তির ভঙ্গিতে তাকালাম!
-OK 10 lira and I’ll give you another book for free!
প্রান খুলে একটু হেসে নিয়ে বললাম, ভাই আমার বইটা দরকার নাই। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! বেচারা গজ গজ করতে করতে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিল!
টপকাপি জাদুঘর
এই প্রাসাদটি ৪০০ বছর ধরে (১৪৫৬-১৮৫৬ খ্রিঃ) অটোম্যান সুলতানদের বাসভবন ছিল। ১৪৫৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন সুলতান মাহমুদ। ১৯২১ সালে যখন অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, তখন এটাকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। এর ভেতরে এক সময় ৪০০০ লোক একসাথে থাকতেন!
টপকাপি প্যলেসের সদর দরজার সামনে দাঁড়ালাম। এটার নাম হচ্ছে বাব-আল হুমায়ুন। সুলতান এই দরজা দিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন বলে এটিকে ‘সুলতানের দরজা”(The Gate of Sultan) বলা হয়।
বাব-উস-সেলাম বা মধ্য ফটক। অসাধারণ কারুকার্য!
ভেতরে ঢোকার পর সবুজের সমারহ আর টার্কিশ স্থাপত্য শিল্পের নিপুনতায় মুগ্ধ হলাম।
শীতের বাতাস আর গুরি গুরি বৃষ্টি হাত, মুখ, নাক আর কানে সুচের মত বিঁধছিল। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে হেঁটে চললাম, ভেতরে যেতেই হবে। মুসা (আঃ) এর লাঠি, দাউদ (আঃ) এর তরবারী, ইব্রাহিম (আঃ) এর খাবার পাত্র, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাবহারের জিনিসপত্র, তার পায়ের ছাপ, তার দাড়ি, পড়নের জামা, কাবার দরজার চাবি, এইগুলা দেখতে পাবো ভাবতেই উত্তেজনায় শীতটা বেশ কমে আসছিল।
এই দরজাটার ওপাশেই নবী রাসুলদের ব্যাবহারের জিনিসপত্র।
ভেতরে ছবি তোলার পায়তারা করতেই একটা ঝাড়ি খাইলাম। আপসে ক্যামেরা গুটিয়ে গেগ্রাসে গিলতে লাগলাম ঐতিহাসিক এই সব জিনিসপত্র। পুরো পৃথিবীর অমুল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন জমা এই মিউজিয়ামে। পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে ৩ ঘণ্টার উপরে লাগল।
মুসা (আঃ) এর লাঠিটা দেখে আশাহত হলাম। নেহায়েত একটা বাঁশের কঞ্চির মত। এইটা দিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি সাগর দু’ভাগ করেছিলেন।
ছবি তুলতে পাড়ি নাই; তাই গুগল মামার কাছ থেকে ধার নিলাম
চার খলিফার তরবারি এক জায়গায় রাখা।
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) (৬৩২-৬৩৪ খ্রিঃ)
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিঃ)
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রাঃ) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিঃ)
চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) (৬৫৬-৬৬১ খ্রিঃ)
চমকে গেলাম আলী (রাঃ) এর তরবারি দেখে, এই জিনিস কোনও মানুষ এক হাতে উঠিয়ে যুদ্ধ করেছে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। পরে জানলাম এইটা আলী (রাঃ) এর সেই বিখ্যাত জুলফিকার তরবারি নয়। এটা উনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন।
ভেতরে একজন ক্বারি বসে কোরআন তেলায়াত করছেন! এই তেলায়েত নাকি কখনও বন্ধ হয়না, সত্যি মিথ্যা জানিনা। বেশ একটা উত্তেজনার মধ্যে পার হল সময়টা
হাজিয়া সোফিয়া
প্যালেস থেকে বেশ কয়েকটা বের হবার রাস্তা আছে। আমি পেছনের একটা রাস্তা দিয়ে বের হলাম। পাথর বাধানো পথ, যেটি গিয়ে থেমেছে প্রধান সড়কে। সেখান থেকে বাঁয়ে ঘুরে বেশ কিছুদুর হেঁটে পৌছালাম হাজিয়া সোফিয়ার সামনে। এইটা ৩৬০ খ্রিঃ থেকে ১৪৫৩ খ্রিঃ পর্যন্ত একটা চার্চ ছিল। ১৪৫৩ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত এইটাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। ১৯৩১ এ এইটাকে জাদুঘর বলে ঘোষণা করা হয় সেকুলারাইজেশনের নামে। আসলে তখন টার্কিরা চাইতেছিল কিভাবে ইউরোপে ঢুকবে। যেটা এখনও ওদের কাছে অধরাই রয়ে গেল! আমার কাছেও এর ভেতরটা অধরাই রয়ে গেল, কারণ ওদের নাকি আজ বন্ধ! বাইরে থেকেই ছবি তুললাম।
সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মস্ক
এই মসজিদটির গায়ে কোথাও নীল রঙের ছিটে ফোঁটাও দেখলাম না। আমেরিকান বুড়োটা বলেছিল, কোনও এক সময় মসজিদের ভেতরে নীল রঙের টাইলস ছিল, সেই থেকে এর এই নাম।
ছবি তুললাম বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে
এই মসজিদের নির্মাণ কৌশল দুই শতাব্দির মিলনে তৈরি। বইজেন্টাইনদের চার্চ আর অটোম্যান দের মসজিদ এই দুইএর সংমিশ্রণে তৈরি এই মসজিদটি দেখলে যে কারও মুখ থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ বের হবে। বড় গম্বুজের আসে পাশে আরও আঁটটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। দুপাশে রয়েছে ছয়টি মিনার।
ঢোকার মুখে দেখলাম দরশনার্থিদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা।
মসজিদের ভেতরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা যেতে পারে।
মসজিদ প্রাঙ্গনের ছবি। এই ছবিটা উইকি থেকে ধার করা!
এখানে ১০০০০ মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে।
তবে মাথা ঘুরে গেল ভেতরে ঢোকার পর। এত সুন্দর কারুকাজ, ছবি তুললাম, কিন্তু আমার দুর্বল ক্যমেরা সেই সৌন্দর্যের সিকিভাগও ধরতে পারলনা।
মসজিদ থেকে বের হয়ে ট্রামের খোঁজ লাগালাম। রাস্তার পাশে হেঁটে যাওয়া একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,
-Can you please show me the way to the Station.
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-I no English!
-What?
-English no!
আমি একটু ভ্যবাচেকা খেয়ে বুঝলাম সময় এসেছে “টারজান ইংলিশের”।
কিছুক্ষনের “টারজান” আলাপচারিতায় তাকে আমার নাম এবং গন্তব্য বোঝাতে সক্ষম হলাম। সে আর্মেনিয়ার। এখানে হীরার দোকান আছে। কিম্ভুত অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আমাদের আলাপচারিতা এগিয়ে চলল। রাস্তার পাশে মোটাসোটা কিছু বিড়াল ঘুরঘুর করছে। সেটা দেখিয়ে বললাম
-Cat, মিয়াউ, very FAT!
শুনে সে তো হেসে লুটোপুটি!
সে গরুর ডাক টাক ডেকে অঙ্গভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিল, এইসব হইতেসে অতিরিক্ত মাংস ভক্ষনের ফল! অবশ্য অনেক কষ্টেও তাকে বোঝাতে পারলাম না সস্তা বাজারটা কোন
জায়গায়, তাই কিছু মিছু এইবারও কেনা হলনা।
আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক আমাকে ট্রামে উঠিয়ে ফিরলেন। গন্তব্য বিমানবন্দর। পা দুটো প্রায় অবশ, ঠাণ্ডা আর পরিশ্রমে। তবে মনটা বেশ ফুরফুরে। অবশ্য বিমানবন্দরে বসে থাকতে হবে আরো ৩-৪ ঘণ্টা। ষ্টেশনে নেমে দেখি এক টার্কিশ মহিলা গিটার বাজিয়ে গান করছে! দাঁড়িয়ে থেকে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। অজানা সুরে মনটা হারালো।
দেশে তখন দ্রোহের গান চলছে।
চলবে...
ফেরা-১
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:২৩