কোরবানী ঈদের ঠিক আগের রাতে মনের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে চেপে বসেছিলাম বিমানে। এমনিতেই আমি খুব ঘরকুনো। আমাকে সন্ধ্যার পরে বাসার বাইরে বের করা বেশ কষ্ট সাধ্য কাজ। তবে মনের এই বিরোধিতার সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণ ছিল। আমাদের তিন জনের কাছে আল্লাহ্ আরেকজনকে পাঠাবেন বলে ঠিক করেছেন। তার জন্মের মুহুর্তটি আমাকে পুরো জীবনের জন্যে হারাতে হবে। আমার কাছে এই কষ্টটিই তীব্র হয়ে উঠছিল প্রতি ক্ষণে। আসার পর থেকেই তাই চেষ্টা করছিলাম ছুটির জন্যে। জানতাম হবে না, ইউ এন তিন মাসের আগে ছুটি দেয় না। ২৪ ডিসেম্বর মোবাইলে যখন প্রথম কান্নার আওয়াজ পেলাম, সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল। একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত, কল্পনায় দেখা, শব্দ গুলো যদি ছবি হত!
ছুটি পেলাম ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ। যাত্রা পথ লাইবেরিয়া-ঘানা-ইস্তানবুল-ঢাকা। ঘানা পর্যন্ত ইউ এন এর বিমানে যাবো। বোয়িং ৭৩৭। রাশিয়ান একটা এয়ার লাইনের বিমান। গুরি গুরি বৃষ্টির দিনে আমি আর সাব্বির স্যার শুরু করলাম আমাদের দেশে ফেরার অভিযান।
ঘানা (স্থানীয়রা উচ্চারণ করে গানা) দেশ টা আফ্রিকার অন্য দেশ গুলি থেকে আলাদা। সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটিতে। সুন্দর বাড়িঘর আর রাস্তা ঘাট। আকাশ থেকে অনেকটা এইরকম দেখতে!
আকরা হচ্ছে গানার রাজধানী। গানার মুদ্রার নাম ছিডি (cedi)। ডলারের বিপরীতে ওদের ছিডির মুল্যমান হচ্ছে ১ দশমিক ৯। গানা বেশ খরুচে জায়গা। এই খানে আমাদের ৯ ঘণ্টার বিরতি। ট্যাক্সি ভাড়া অবশ্য খুব বেশি না। শহরের যেকোনো প্রান্তে ১২ ছিডি দিয়ে চলে যাওয়া যায়। বাড়ি ঘর গুলো ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি; টালির ছাদ। আবহাওয়া অনেকটা আমার দেশের মতই!
ট্যাক্সি ড্রাইভার আমদের হোটেলে নিয়ে গেল। আমরা শহরের ভেতরে একটা সস্তা হোটেলে উঠলাম। সস্তা মানে ২৫ ডলার আরকি! হোটেলের রুমে একটা টিভিতে আঞ্চলিক একটা নাটক হচ্ছে। সাব্বির স্যারকে দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে সেইটা দেখতেছেন। এদিকে পেটের ভেতরে মোচর দিচ্ছে।
-স্যার, খাইতে যাবেন না!
-দাড়া ব্যাটা, মজার নাটক হইতেসে!
-ভাষা বুঝেন?
-আরে বেটা ইংলিশ তো!
আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারলাম আসলে ওরা ইংলিশেই কথা বলছে! আফ্রিকানদের ইংলিশ অনেকটা আমাদের চট্টগ্রামের বাংলার মত আরকি! এই ইংলিশই ওদের অফিসিয়াল ভাষা।
-কাহিনী কি স্যার!
-আরে গ্রামের মোড়লের মেয়েরে নায়ক ভালবাসে, এইজন্যে কালো জাদু করে ওরে ভস্ম করে দিবে!
আমি ভাবলাম, আর কিছুক্ষনের মধ্যে খিদায় আমিই ভস্ম হয়ে যাবো।
আফ্রিকানরা এখনও কালো জাদুর উপরে বিশ্বাস রাখে। ওরা সিংহ ভয় না পেলেও ডাইনি বুড়ি বেশ ভয় পায়। ওদের সংস্কৃতির একটা অংশ জুড়ে কুসংস্কার। যেগুলোর বলি হয় বাচ্চা, তরুণী আর যুবতী মেয়েরা।
আমার তিন মাসের নির্বাসনের মাঝেই একটা বাচ্চার মৃতদেহ পাওয়া গিএছিল; ১০ মাস বয়সের। ইউ এন এর নাম দিয়েছে রিচুয়াল কিলিং, যেটার কোন বিচার হয় না!
আক্রা বিমানবন্দর টা বেশি একটা বড় নয়। তারপর আবার চলছে মেরামতির কাজ। ডিউটি ফ্রি শপে ঘোরাঘুরি করলাম কিছুক্ষণ কিছু কেনার ধান্দায়। টিনটিন ভর্তি এই র্যাক টা বেশ আকর্ষণ করছিল! তবে দাম দেখে আকর্ষণের গোঁড়ায় পানি ঢাললাম।
বাকি জিনিসেরও আকাশ ছোয়া দাম। কিছু মিছু কেনার আশা বাদ দিয়ে টার্কিশ এয়ারলাইনের ইস্তানবুল গামী বিমানের অপেক্ষায় নষ্ট এসির সামনে বসে ঘামতে থাকলাম। আক্রা থেকে আবিদজান হয়ে ইস্তানবুল। ইস্তানবুলে পৌছাব সকাল ৯ টায়। গানায় এই সময়ে বেশ একটা অস্বস্তিকর গরম পরে।
নিজে নিজেই গজর গজর করলাম, ইস, এত গরম! কখন যে প্লেনে ঢুকব! আল্লাহ্ বোধহয় ঠিক করলেন গরমের হাত থেকে এই বেচারাকে মুক্তি দেয়া হোক। তাই ইস্তানবুলে ৪ ডিগ্রী বৃষ্টি সমেত আমার জন্যে অপেক্ষায় রইল। প্লেনে চেপে বসার পর কাপ্তান সাহেব এই সুসংবাদটি আমাকে দিলেন। আমার পড়নে একটি ফুলফাতা সার্ট শুধু! বাকি জামা কাপড় সমেত ব্যাগটা ঢাকার আগে পাব না। ইস্তানবুলে ১২ ঘণ্টার বিরতি; ঠাণ্ডার ভয়ে আমার গরম লেগে গেল আবার!
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:০০