দ্বিতীয় পর্ব
লাইবেরিয়া "The country of the FREE"
গানায় বিমানটা নেমেছিল তেল নেবার জন্যে; তাই আমার আর নামা হল না। জলিল ভাইয়ের কল্যাণে, গানা দেশ টাকে বেশ দেখার ইচ্ছে তৈরি হয়েছিল। রানা স্যার বললেন, ইউ এন এর বিমানে লাইবেরিয়া থেকে এখানে বেড়াতে আসা যায়। আপাতত তাই ইচ্ছের রাশ টেনে রাখলাম; নির্বাসনের বহুত সময় সামনে, কিছু একটা জিনিস করবার মত রাখা গেল ভবিষ্যতের জন্যে। আমার পাশের সিটটা খালিই রইল, লাইবেরিয়ান তরুণী এক কোনায়, আর আমি জানালার পাশে। এখান থেকে আরও এক ঘণ্টার পথ। পথ চলতে চলতে আমি ক্লান্ত। পশ্চিমে যাচ্ছি বলে সময়ের আগে চলে আসছি বারবার, দেশ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম রাত ১০টায়, এখন দেশের সময় পরদিন রাত ৮টা। বিমানটা আকাশে উড়তেই তাই এলিয়ে গেলাম ঘুমে। ঘুম ভাঙ্গল ক্যপ্টেনের ঘোষণায়, অবশেষে আমরা পৌঁছেছি লাইবেরিয়ার আকাশে।
আকাশে কাল মেঘ, আমার দেশের বর্ষার মেঘ। মেঘের ভেতর থেকে বিমানটা বের হতেই দেখলাম, আটলান্টিকের তীরে সবুজ একটা ভুখন্ড। সবুজ আর নীলের অপরূপ কম্বিনেশন। হটাতই ভালো লেগে গেল, আমার বন্দিশালা, মুক্তদের দেশ(the country of the free), লাইবেরিয়াকে
বিমানবন্দরে নেমে মনে হল, এ আমি কোথায় চলে আসলাম। কোনভাবেই এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফেলা যায় না। ছোট একটা টার্মিনাল বিল্ডিং এ সবাই লাইন দিয়ে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ইমিগ্রেশন পাড় হয়ে ব্যাগ নিতে আসলাম। বুক ধুকপুক, সেই ঢাকায় শেষ দেখেছিলাম ব্যাগ গুলোকে, এতটা রাস্তা আমার সাথে আসতে পেরছেতো 'বাচ্চা' গুলো? অবশেষে এল তারা, জানে পানি এল, এদের ছাড়া আমি মোটামুটি অচল হয়ে যেতাম এই বিদেশে। বাইরে বের হয়ে দেখি, "কুকুর বেড়াল" বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এতটাই প্রকট যে আমাদের নিতে আসা গাড়ি পর্যন্ত পৌছতে কাঁক ভেজা হয়ে যেতে হবে। এদের ঋতু দুইটা। মে থেকে অক্টোবর ভেজা মৌসুম, নভেম্বর থেকে এপ্রিল শুকনো মৌসুম।লাইবেরিয়া পৃথিবীর অন্যতম "ভেজা" জায়গা। আমার আগের জন আমাকে এই ব্যপারে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন ভাগ্যিস! সবাই যখন না ভিজে গাড়ি পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে তৈরি, তখন আমার হাতে ছাতা দেখে রানা স্যার আকর্ণ হাসি দিলেন!"জা বেটা, তুই পাশ!" আমি আগে কখনও ছাতা হাতে এত গর্বিত বোধ করিনি
দেশি বিদেশ!
গাড়ি চলেছে ঘন বৃষ্টির মাঝে, আমার উৎসুক দৃষ্টি রাস্তার দুপাশে, সবুজ আর সবুজ। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটার আয়তন ৪৩ হাজার বর্গ মাইল। বাংলদেশ থেকে খুব বেশি ছোট নয়, কিন্তু আমাদের ১৬ কোটির বিপরীতে এদের আছে মাত্র ৩৭ লাখ লোক! স্বভাবতই রাস্তার আসে পাশে বসতি চোখে পড়ছিল কদাচিৎ। নাম না জানা বেশ কিছু গাছের মাঝে হটাত আম গাছ দেখে প্রায় আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের নিতে আসা কর্নেল সাদিক স্যার বললেন,"কত আম খাইবা! এদের এইখানে আম, আমড়া, আনারস, কমলা, কলা অফুরন্ত! সবচেয়ে বড় কথা, ফরমালিন জিনিসটা এরা এখনও চেনে নাই!" মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করলাম, যাক বাবা, কিছু না হলেও অন্তত ফল খেয়ে বাঁচতে পারব। আমার মেয়েটার জন্যে মায়া হল, বেচারার ফল খুব পছন্দ! কিন্তু আমাদের দেশের নির্দয় ব্যাবসায়িরা আমার মেয়েকে বঞ্চিত করছে সে আনন্দ থেকে। জেনেশুনে কে বিষ খাওয়াবে সন্তানকে? আমার মনে হয়, আমার দেশের ফল ব্যাবসায়িদের কোন সন্তান নেই; সেটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়! আবহাওয়া যেমন মনে হচ্ছে, তাতে চিটাগাঙের সাথে খুব বেশি পার্থক্য খুজে পাচ্ছিলাম না। আনমনা হয়ে গেলাম! অবশেষে আসলাম আমার বন্দিশালার সামনে, যেখানে একবছর কাঁটাতে হবে।
বি-ফার্স্ট রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় আমার নিবাস, বি মানে বাংলাদেশ, বিদেশে আমার দেশ! মনটা ভালো হয়ে গেল হটাত করেই। আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন মেজর সাব্বির স্যার, উনার সাথেই থাকব। রুমটা আমার কল্পনার তুলনায় অনেক গুনে ভালো। ফ্রেশ হবার জন্যে বাথরুমে ঢুকতেই, নিচের রেস্টুরেন্টের গানের আওয়াজ ভেসে এল, "ও আমার দেশের মাটি, তোমার পড়ে ঠেকাই মাথা.।.।।।" চোখটা একটু ভিজে উঠল কি!
চলবে.।.।.।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ ভোর ৫:২২