যাত্রা হল শুরু
আফ্রিকা মহাদেশ যাবো! দেশের অশান্তি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে লাইবেরিয়ার শান্তি রক্ষা করতে যাত্রা করলাম কোরবানি ঈদের ঠিক আগের রাতে। যাত্রা পথ দুবাই-কেনিয়া-ঘানা-লাইবেরিয়া। পুরো সাড়ে ৬ হাজার মাইল পাড়ি দেব টানা। আফ্রিকা বলতে আমার চোখে ভাসে সিংহ, গণ্ডার, জিরাফ, হাতি এইসব। সাথে আছে ম্যালেরিয়া, কালা জ্বর, ছি ছি মাছি! দেশ ছাড়তে মন টানছিল না। জিয়া থুক্কু হজরত শাহজালাল (রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গেটে আমার তিন বছর বয়সী মেয়েটির কাছে কলিজাটা খুলে রেখে আসলাম বিমানে উঠবার গেটের কাছে। দেখলাম, শ্রেণী বিভাজন চলছে পুরদমে। শ্রমিক সম্প্রদায়কে আলাদা একটি লাইনে দাড় করিয়ে রেখেছে কিছু লোক। লাইনের সবার মুখ চোখ শুকনো। ঈদের আগের রাতে কে বিদেশ যেতে চায়! ‘এলিট’ গ্রুপের মাঝে নিজের জন্যে একটু জায়গা করে বসে পড়লাম। এমিরাতে করে যাবো দুবাই পর্যন্ত সেখান থেকে বিমান পরিবর্তন করতে হবে। আমার সাথে আর্মির একজন স্যারের যাবার কথা; উনাকে দেখিনি আগে, তাই ইতি উতি চাইছিলাম আর্মি ছাঁটের কাওকে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। আমার পাশের এক তন্বী তরুণী আমার এই এদিক ওদিক চাহুনির অন্য অর্থ করলো মনে হয়। কারন হটাত তার দিকে চোখ পরতেই দেখি, কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমাকে দেখছে সে! আমি একটা অপ্রস্তুত হাসি দিতেই সে হটাত ব্যস্ত হয়ে গেল তার মোবাইল নিয়ে। মুখে একটা অবজ্ঞার হাসি! আমি আস্তে ব্যগটা নিয়ে উঠে পড়লাম লাইনে দাঁড়াবার জন্যে। হটাত করেই কলেজ জীবনে ফিরে গেলাম মনে হয়। মেয়েদের সামনে গেলেই গলা শুকিয়ে যেত। শুকনো একটা ঢোঁক গিললাম। লাইনটা ধিরে ধিরে এগুচ্ছে বিমানের দিকে। এমিরাতের কেবিন ক্রুরা তাদের বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে আমাকে সাদরে গ্রহন করলো।
দুবাই, একটি আন্তর্জাতিক হাট!
কিঞ্চিৎ ভাবের মধ্যে ছিলাম, অভাবের দেশের লোকেদের তা মানায় না বোধ হয়; গায়ে একটা গরিব গরিব গন্ধ লেগে থাকে। আমার আশে পাশের শ্বেতাঙ্গ তরুণীদের দেখেও দেখছিনা টাইপ ভাব! তাতে কিবা এসে গেল যে তাদের উরু পর্যন্ত উন্মুক্ত করে হাটছে তারা! বাঙ্গালীর জন্যে যদিও ব্যপারটা অনেকটা হিমালয় দর্শনের মত। তার মানে এই নয় যে আমার চোখ এইরুপ তরুণী দেখে অভ্যস্ত নয়; সে ট্রেনিং নিয়ত কেবল অপারেটরদের উপহার সরূপ পেয়েই বড় হয়েছি! কিন্তু লাইভ কাভারেজ ব্যপারটার সাথে মানাতে একটু সময় লাগছিল, এই যা! আমার ছোট বেলার বন্ধু হটাত হুজুর হবার পরেও মেয়েদের সাথে ফিল্ডিং মারছিল একবার। চেপে ধরবার পরে মিন মিন করে নব্য হুজুর বলেছিলেন, প্রথম দর্শনে দোষ নেই! অকাট্য যুক্তি! যদিও বিধাতা কতটা সহমত হবেন জানিনা। দুবাই টার্মিনালে আমি মোটামুটি পথহারা নাবিকের মত এদিক ওদিক ছুটছি। কিন্তু কোনভাবেই ১৯ই গেট খুজে পাচ্ছিনা। তার উপর আবার চলার গতি মাঝে মাঝেই মন্থর হয়ে যাচ্ছিল ‘হিমালয়’ দের আনাগোনায়। ভাবটা বজায় রাখা ভীষণ এক যুদ্ধ বৈকি! এ যেন আন্তর্জাতিক হাট বসেছে, সাদা কাল বাদামি শ্যামলা, ৬ ফিট থেকে ৪ ফিট, কুর্তা থেকে কোট, বোরকা থেকে মিনি স্কার্ট, এলাহি কাণ্ডকারখানা। এক জরিপে বলেছে প্রতি সপ্তাহে এই বিমানবন্দর দিয়ে ৬০০০ ফ্লাইট বিশ্বের ২২০টি দেশ থেকে আসে এবং যায়! উইকি বলছে এটা বিশ্বের চতুর্থ ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক যাত্রীদের মিলন মেলা। এত ভিড়েও বাঙালি আলাদা করে চেনা যায়, বোচকা নিয়ে দৌড়া দৌড়ী দেখে। আমার বোচকা নেই, তবে আমিও মোটামুটি দৌড়ের উপরেই আছি। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট কেনিয়া এয়ারলাইনে। কারও কাছে জানতে চাইলেই বলে, ঐতো সামনে! সামনে আর শেষ হয় না! হটাত করে কাল চামড়াদের আনাগোনা আসে পাশে বাড়তে শুরু করতেই বুঝলাম, ঠিক পথেই এগুচ্ছি। কেনিয়া এয়ারলাইনের কাউন্টারে এক ইন্ডিয়ান নিবিড় মনে কান চুল্কাচ্ছিল। আমি বললাম, এক্সকুজ মি! সে বলল, কেয়া ভাইয়া, কিধার যানা হেয়! আমি বললাম I have a connecting flight from dubai to Kenya, can you please check. বেচারা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হল, সেটা কান চুলকানোয় বাধা পড়ায় নাকি আমার হিন্দি না বলায়, ঠিক বুঝলাম না। হটাত পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কোথায় ছিলা সোনা এতক্ষন”।
এত আদুরে ডাক এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কে ডাকল?! পেছন ফিরে দেখি মুচকি মুচকি হাসছেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। আমার বৈমানিক রিফ্লেক্সের তড়িৎ সিদ্ধান্তের ক্ষমতাবলে ০.৩ সেকেন্ডের মাঝে হিসেব কষে বের করে ফেললাম, ইনিই হচ্ছেন কর্নেল রানা স্যার, স্যারের মাথার চুলগুলো আধাপাকা (অনেকটা আমার মত) কাঁধে একটা ল্যাপটপের ব্যাগ, পায়ে ক্যানভাসের জুতো, ওজন ৭০-৮০। ১ সেকেন্ড পুরো হবার আগেই উচ্চ স্বরে কিঞ্চিৎ হাসি মিশ্রিত গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলাম, “স্লামালাইকুম স্যার”
আমাদের এই পরিচয় পর্বের ফাঁকে এক পাকিস্তানী ভদ্রলোক তার সেমি ফুটবল টীম পরিবার নিয়ে তর্ক যুদ্ধে নেমেছে ইন্ডিয়ানটার সাথে। রণাঙ্গন পুরাই উত্তপ্ত, বেচারা ফ্লাইট মিস করেছে কাজেই সে একটু চুপসে আছে, ইন্ডিয়ানটার তেজ বাড়ছেই। ৬ টি বাচ্চা আর দুটি তরুণী তাকে ঘিরে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত নয়নে সে ঝগড়া দেখছে। আমরা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, হটাত ইন্ডিয়ান টার নজর আমাদের উপর পড়ল, “আপ লগ আজাইএ”। বেটা ইংলিশ কয়না, আমাদের চেহারায় হিন্দি ছবি এবং সিরিয়ালের ছাপ পড়েছে বোধ করি! আমাদের বোর্ডিং পাশ দিয়ে বলল বিমান একঘণ্টা লেট হবে অথবা বেশীও হইতে পারে। লে হালুয়া, এত দেখি বাংলাদেশের টাইমটেবিল হয়ে গেল! যাইহোক এই ফাঁকে দুবাই টার্মিনালটা একটু ঘুরে ফিরে দেখলাম। একটা ছোট ঝর্নার দুপাশে বসে আছে অনেকে। বেশিরভাগ আফ্রিকান কাল চামড়া। আফ্রিকানদের পোশাকে একটু ভিন্নতা আছে, বেশিরভাগ আলখেল্লা টাইপ একটা কাপর পড়ে, মাথায় আবার একটা চাঁদর পেঁচানো থাকে অনেকের। তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাকে বাংলায় যাকে বলে বুক চেতিয়ে দাঁড়ান। শারীরিক ভাষায় প্রকাশ পায় একধরনের আদিম একরোখা মনোভাব। ছেলে গুলো সবার চুল ছোট করে ছাটা, আর মেয়েগুলর চুল হয় ঝাঁকরা নয়ত কয়েকশ ছোট বেণী বাধা মাথা জুড়ে! অধিকাংশই আমাদের বিচারে বিশালদেহী। আমার ঠিক পাশেই প্রায় ছফুট লম্বা এক তরুণী ঝুকে কথা বলছিল একজনের সাথে, আমাকে বাধ্য হয়েই আবার ভাব ধরতে হল; গভীর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল টিপতে লাগলাম, যদিও সেটা গ্রামীণ নেটওয়ার্ক ধরার ব্যর্থ চেস্তাও করছিল না! রানা স্যার, শুধু মুচকি হাসছিলেন, “প্রথম আসছ, তাইনা”। আমি কান লাল করে উত্তর দিলাম, “জি, স্যার”
কিলিমাঞ্জারো!
কেনিয়া এয়ারলাইনের বিমানটাতে বেশ চাপাচাপি, অনেকটা আমাদের ফার্মগেট রুটের লোকাল বাসের সীট গুলার মত চাপা। ঢাকা থেকে এমিরাতের যে বিমানে এসেছিলাম তার ক্রুগুলো ক্লোজ আপ হাসি ধরে রেখেছিল পুরোটা সময়। এই বিমানে দেখি উলটা। মনে হয় করল্লার রস খেয়ে এসেছে মিনিট দুয়েক আগে। আফ্রিকানদের কুসংস্কারের বিশ্বাস তাদের বিমানেও আছে, ১৩ নম্বর সিটটি এদের বিমানে নেই! কেবিন ক্রুরা তাদের রুটিন ভাষণ শোনাল, সাথে যোগ করলো, কম্বল খানি নিজের মনে করিয়া যাতে না নিয়া যাই! এই বিমানে আফ্রিকান ভাষায় কি যেন সব অনুষ্ঠান চালাইতেসে, কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম! একটু পর হাল ছেড়ে চোখ বন্ধ করলাম একটু ঘুমের আশায়। কিন্তু সটান হয়ে ঘুম কি আর আসে? আধ ঘুমের অবসান হল হটাত করেই যখন সূর্যের প্রথম রশ্মি স্পর্শ করলো আমাকে, ৩০০০০ ফিট উচ্চতা থেকে আফ্রিকার সূর্যোদয় দেখলাম সাথে দেখতে পেলাম অপরুপ এক দৃশ্য! দিগন্তে জেগে আছে বরফ মোড়া কিলিমাঞ্জারো। প্রায় বিশ হাজার ফুট উঁচু। এটি আফ্রিকার সর্বচ্চো, আসে পাশে আর কোন উঁচু পাহাড় নেই। সোহাইলি ভাষায় কিলিমাঞ্জারো অর্থ হচ্ছে “উজ্জ্বল পাহাড়”। আমার মোবাইলের দুর্বল ক্যমেরায় ধরবার চেষ্টা করলাম। কাজ না হওয়ায়, ব্যর্থ প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে দুচোখে গিলতে লাগলাম যতক্ষণ দেখা যায়। আমার পাশে এক আফ্রিকান বসেছে, ওকে জিজ্ঞেস করলাম ,কিলিমাঞ্জারো দেখেছ? সে বলল, What is that???!!
বেশ কিছুক্ষণ ধরে নাইরোবির আকাশে চক্কর দিচ্ছে আমাদের বিমানটা। উচ্চতা বেশি নয়; আমি উতসুক চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি, হাতি জিরাফ দু একটা যদি চোখে পড়ে! কোথায় কি? খালি ঘর বাড়ি, আর ফাঁকা মাঠ। গাছপালাও নাই বেশি। পরে জানতে পারলাম, আফ্রিকায় বন্য জন্তু শুধু পার্কেই দেখা মেলে। মেরে সাফ করে ফেলেছে বেশির ভাগ। বইয়ের আফ্রিকার সাথে অনেক তফাত। ল্যান্ড করবার পড়ে করল্লা খাওয়া কেবিন ক্রু গুলা গেটে দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানাল, পাশে স্তূপ হয়ে আছে উদ্ধার করা কম্বল!
চলবে.।.।.।.।।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১২:৫৭