কিছুদিন আগে টেনিস তারকা মার্টিনা হিঙ্গিস স্বামী নির্যাতন করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। পান থেকে চুন খসলেই তিনি নাকি তার স্বামী হিথবোল্ট হুটিনকে মারধোর করেন। এ কাজে হিঙ্গিসের মা ও মায়ের বয়ফ্রেন্ড মাঝে মাঝে হিঙ্গিসকে সহযোগিতা করেন। সম্প্রতি হিঙ্গিসের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মৃত্যুভয়ে সুইজারল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন পেশায় শো-জাম্পার হুটিন।
খুব দজ্জাল টাইপের কোন মহিলার সাথে গোবেচারা টাইপের কোন পুরুষ মানুষের বিয়ে হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা বিরল নয়। তবে নিজের পুরুষত্ব নিয়ে অন্যদের মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে, এই আশংকায় অনেক পুরুষই তার স্ত্রীর দ্বারা নির্যাতিত হবার ঘটনা চেপে যান।
অনেক দিন আগের কথা। আমার মা-খালাদের মধ্যে সেজখালা ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী ও জেদি মহিলা। দুর্ভাগ্যক্রমে (অথবা সৌভাগ্যক্রমে) সেজখালু আব্দুর রহমান সাহেব ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। নেহাতই নিরীহ ও মিতবাক স্বভাবের মানুষ। ফলে তারা দু’জন ছিলেন সে যুগের হিঙ্গিস ও হুটিন। সেজখালা প্রায়ই সেজখালুকে মারধোর করে বাসা থেকে বের করে দিতেন। তার এই স্বভাবের কারণে আমার মা ও অন্য খালারা ভীষণ বিব্রত বোধ করতেন। তারা তাদের এই দজ্জাল বোনটিকে অনেক শাসন করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতেন না। রহমান সাহেবের ভায়রাদের মধ্যে আমার আব্বা ছিলেন উকিল মানুষ। তিনি রহমান সাহেবের দুর্দশা দেখে মনে মনে পুলকিত হলেও মুখ গম্ভীর করে বলতেন, ‘একটা মামলা ঠুকে দেবে নাকি, রহমান? তুমি যদি রাজী থাকো তো বল, কাগজপত্র তৈরি করি।’
সেজখালু আঁতকে উঠে বলতেন, ‘না না ভাইজান, এ কাজ করা যাবে না।’
একই শহরে থাকার কারণে সন্ধ্যের পরে এমন ঘটনা ঘটলে সেজখালু সটান চলে আসতেন আমাদের বাসায়। কাঁদতে কাঁদতে মাকে সব খুলে বলতেন। চোখ মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, ‘বুবু, আপনি একটা কিছু করেন। এভাবে তো আর পারা যায় না!’
মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘তা’ তুমি কেন তাকে কষে দু’টা চড় দিতে পারো না, বল তো? কেমন মরদ তুমি?’
সেজখালু ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বলতেন, ‘সর্বনাশ!’
কিসের সর্বনাশ, কার সর্বনাশ-আমরা ভাই বোনরা ছোট ছিলাম বলে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। সেজখালু সে রাতে আর বাসায় ফিরতেন না। রাতে খাওয়া দাওয়া করে আমাদের বাসায় থেকে যেতেন। পরদিন সকালে নাস্তার পর মা তাকে রিক্সায় তুলে সেজখালার কাছে দিয়ে আসতেন। সেখানে সেজখালাকে মা তর্জন গর্জন সহকারে দু’চারটা চড় থাপড় দিলেও তার কোন ভাবান্তর হতো না। মা চলে গেলে সেজখালুর কপাল আরও খারাপ আছে-এমন একটা দাঁত কিড়মিড় করা প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি মায়ের হাতে চড় থাপড় খেয়ে ভেজা বেড়ালের মতো অপেক্ষা করতেন। এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে।
আমরা ভাই বোন ছিলাম হাফ ডজন, আর সেজখালার ছেলেমেয়ে ছিল পৌনে এক ডজন। আমাদের একটা আর ওদের দুটো মারা যাবার পরের হিসাব এটা। আব্বা ওকালতি পেশার সূত্রে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন। কিন্তু সেজখালু আয়কর অফিসে চাকরি করেও ঘুষ খেতে জানতেন না বলে তার সংসারে অভাব অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। খালা-খালুর মধ্যে খিটিমিটি লাগার সেটাই ছিল সম্ভবতঃ প্রধান কারণ। নিয়মিত বিরতিতে জন্ম নেওয়া নয়টি ছেলেমেয়ের ওপর আমার দজ্জাল খালার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমার এই খালাতো ভাই বোনরা বাসায় প্রতিদিন একে অন্যের সাথে হাতাহাতি মারামারি করতো। ধ্বস্তাধস্তি, গালাগালি, ভাংচুর ইত্যাদি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেজখালা তাদের সামলাতে না পেরে উনুনের লাকড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধোর করতেন। রান্নাঘর থেকে হাঁড়ি পাতিল, খুন্তি, বেলনা এসব ছুঁড়ে তাদের দমন করার চেষ্টা করতেন। রাস্তার পাশে বাসা হওয়ায় রান্নাবান্নার এসব সাজসরঞ্জাম দরজা বা জানালা গলে প্রায়ই রাস্তায় গিয়ে পড়তো। খালু বাসায় থাকলে তিনিই সেসব কুড়িয়ে নিয়ে আসতেন। আর তিনি না থাকলে প্রতিবেশী বা পথচারীরা কুড়িয়ে এনে দিয়ে যেত।
সেজখালার বাসায় এমন ভয়াবহ অবস্থার কারণে আমরা পারতপক্ষে সে বাসায় খুব একটা যেতাম না। তবে সেজখালা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে মাসে অন্ততঃ একবার হলেও আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন। তখন খালাতো ভাই বোনরা এক বেলার মধ্যে আমাদের বাসার সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে যেত।
একবার সেজখালার বড় মেয়ে আতিয়া পাড়ার এক বেকার ছেলের সাথে পালিয়ে গেল। সেজখালা মেয়ের এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য তার জন্মদাতাকে দায়ী করে মহা হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। তিনি সেজখালুকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে বাসা থেকে বের করে দিলেন। স্ত্রীর টানা হেঁচড়ায় জামার সব ক’টা বোতাম খুইয়ে সেজখালু চোখ মুছতে মুছতে আমাদের বাসায় এসে যথারীতি মাকে তার হেনস্থার কথা খুলে বললেন এবং রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মা তার জামায় নতুন বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শোন রহমান, আজ অফিস থেকে তুমি সোজা এখানে চলে আসবে। এক সপ্তাহ তুমি এখান থেকে অফিস করবে। একদম বাসায় যাবে না, ঠিক আছে? দেখি, তোমার বদমাশ বউটা সোজা হয় কী না!’
সেজ খালু মাথা নেড়ে বললেন, ‘জী আচ্ছা, বুবু। আমি এক সপ্তাহ যাবো না।’
আব্বা মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘একটা মামলা ঠুকে দিলে হতো না?’
মা রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি আবার আগুনের মধ্যে পাটখড়ি দিয়ো না তো! রহমান যদি সাত দিন না যায় তো ও শয়তানী বাপ বাপ করে সোজা হয়ে যাবে।’
‘আরে বাবা, আমি কী বলছি আগে ভালো করে শোন।’ আব্বা তার পেশাগত কৌশল খাটিয়ে প্রসঙ্গটা দক্ষতার সাথে পাল্টে দিয়ে বললেন, ‘আমি বলছি, যে হারামজাদা আতিয়াকে নিয়ে পালিয়েছে, তাকে তার বাপসহ আসামী করে একটা মামলা দিতে।’
মা বললেন, ‘না, ওসব মামলা মোকদ্দমায় যাওয়ার দরকার নাই। আদা খাবে যে, ঝাল বুঝবে সে। রহমান, তুমি সাত দিন তোমার বাসায় যাবে না, ঠিক আছে?’
‘জী বুবু। সাত দিন যাবো না।’
কিন্তু কিসের সাত দিন? অফিস শেষে সেজখালু সুড় সুড় করে সোজা নিজের বাসায় ফিরে গেলেন। সম্ভবতঃ স্ত্রীর হাতে অধিকতর লাঞ্ছনার ভয়ে তিনি বিদ্রোহ করার সাহস পেলেন না। সন্ধ্যের পর আব্বা খোঁজ খবর নিয়ে বাসায় এসে মাকে বললেন, ‘শোন, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর। তোমার ভগ্নিপতি রহমান মহাবীর আলেকজান্ডারের মতো অত্যন্ত সাহসের সাথে নিজ বাসায় অবস্থান করছে। তোমার চিন্তা করার কোন কারণ নাই। স্ত্রীর ভয়ে গৃহত্যাগ করবে, তোমার ভগ্নিপতি এত দুর্বল পুরুষ নয়। কী বুঝলে?’
মা কপালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। তারপর বিড় বিড় করে বললেন, ‘এমন কোমর ভাঙ্গা পুরুষ মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।’
আব্বা পোশাক পাল্টে এসে মায়ের কাছে বসে বললেন, ‘রহমান তার জন্মের দু’বছর পর থেকেই এতিম। বাপ-মা হারিয়ে মামা-মামীর সংসারে লাঞ্ছনা গঞ্জনার মধ্যে মানুষ হয়েছে। ওর কোমর শক্ত হবে কোত্থেকে? ওর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করো না। একপালা ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাবের সংসারে সে এমনিতেই হাবুডুবু খাচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি করেও সে এক পয়সা ঘুষ খায় না। ওর সততাকে সম্মান করা উচিৎ।’
নব্বই সালে চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরে সেজখালুর ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বুড়ো বয়সেও সেজখালার ভয়ে তিনি সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতেন। সেজখালা বাতের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লেও স্বামী নির্যাতনের সময় সম্ভবতঃ সেই ব্যথার কথা ভুলে যেতেন। বড় হবার পর ছেলেমেয়েরা বিয়ে শাদী ও পেশাগত কারণে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। এক ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে সেজখালার হালকা পাতলা সংসার। কিন্তু সেই সংসারেও শান্তি নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেজখালার হম্বি তম্বিতে সবাই অস্থির। বাজার থেকে আনা মাছের পেট নরম-অতএব এক্ষুনি মাছ বদলে আনো, এবারের চালে কাঁকর বেশি-বুড়ো হয়ে কী কানা হয়ে গেছো?, কলের মুখ দিয়ে পানি পড়া কমে গেছে-এক্ষুনি মিস্ত্রী ডাকো- সেজখালার এমন নন-স্টপ বকবকানিতে সেজখালু বুড়ো বয়সেও পুতুল নাচের মতো নাচতে থাকেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন, ২০০৩ সালে সেজখালু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেজখালার সব হম্বি তম্বি উবে গিয়ে মুখ শুকিয়ে গেল।
নার্সদের ওপর ভরসা না করে তিনি নিজেই বাতের অসহ্য যন্ত্রণা উপেক্ষা করে দিন রাত খালুর সেবা যত্ন করতে লাগলেন। কিন্তু ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা এবং খালার নির্ঘুম সেবা যত্ন সত্ত্বেও খালুকে বাঁচানো গেল না। খালুর শেষ সময়ে আমরা আত্মীয়স্বজন অনেকেই তার পাশে ছিলাম। তিনি মারা গেছেন শুনে সেজখালা ফিট হয়ে পড়ে গেলেন। তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালের বিছানায় নেওয়া হল। পাক্কা ছাব্বিশ ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফিরলে প্রথম যে কথাটি তিনি বললেন, তা’ হল, ‘আতিয়ার বাপ কোথায়?’
এই ছাব্বিশ ঘণ্টায় আতিয়ার বাপের দাফন কাফন সব হয়ে গেছে। অত্যন্ত বেদনার্ত ভাষায় সে কথা খালাকে বলা হল। শুনে খালা আবার ফিট হয়ে গেলেন।
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৪৬