somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ পাঁচ লাখের টোপ

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুদিন আগের কথা। আমার সেলফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো। নারী কণ্ঠে একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কী আবুহেনা সাহেব বলছেন?’
‘জি বলছি। আপনি কে বলছেন?’
‘সেটা আপনার জানার দরকার নাই। আমি কী বলছি, শুধু সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।’

আমি ঢাকার মৌচাকে ঢিল নামের পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করি বলে পাঠক পাঠিকাদের কাছ থেকে ফোন ও এসএমএস পাই। ঐ পত্রিকায় লেখকের কন্ট্যাক্ট নম্বর ছাপা হয় বলে লেখক ও পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগের পথ খোলা থাকে। পাঠক পাঠিকারা তাদের অনুভূতি লেখকের সাথে শেয়ার করেন। বর্তমানে কী লিখছি তা’ জিজ্ঞেস করেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্যাদিও বিনিময় হয়। কিন্তু এরকম ভাষায় কেউ কখনো কথা বলেন না। মনে মনে একটু রাগ হলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, ‘ঠিক আছে। বলুন, কী বলতে চান।’
‘ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা আপনার একটা ছবি আছে আমার কাছে। ছবিটি ফটোশপ করে আমার সঙ্গে আপনার সহবাসরত অবস্থার একটা ছবি তৈরি করা হয়েছে। এ কাজে যে মেধা ও শ্রম ব্যয় হয়েছে, তার দাম পাঁচ লাখ টাকা। এই টাকাটা কবে কখন কোথায় দিতে হবে, তা’ আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ পর আপনাকে জানানো হবে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা জোগাড় করে রাখবেন। ঠিক আছে?’

কথা শেষ করে মেয়েটি সংযোগ কেটে দিল। আমি রিং ব্যাক করে কথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম ফোন বন্ধ। আমার স্ত্রীকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘তা’ এত লোক থাকতে তোমার পেছনে কেন লেগেছে মেয়েটি?’
আমি বললাম, ‘সেটা তো জানি না। লেখকদের অনেক টাকা পয়সা থাকে এরকম ভুল ধারনা থেকে হয়তো সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে।’
আমার স্ত্রীর কপালে চিন্তার ছাপ পড়লেও এ নিয়ে আর কিছু বললেন না। সারাদিনে কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনটি খোলা পেলাম না। আমার সাধারণ জ্ঞানে মনে হলো এটা পুরোপুরি ধাপ্পাবাজি। ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের কূট কৌশল। ফেসবুক, টুইটার বা ব্লগে তো বহু নারী পুরুষের ছবি থাকে। এ রকম হলে তো অনেকেই ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে বিপদে পড়তো। সামাজিক যোগাযোগের এসব ভার্চুয়াল মাধ্যম বন্ধ হবার উপক্রম হতো। কিন্তু পরে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম এটা হতেও পারে। কারণ আজ থেকে দশ বারো বছর আগেই ফটোশপ করে চিত্রনায়িকা মৌসুমির কণ্ঠলগ্ন অবস্থায় আমার এক বিটকেল বন্ধুর ছবি তো আমি স্বচক্ষেই দেখেছি। এটা কীভাবে সম্ভব হলো জিজ্ঞেস করায় আমার সেই রোমিও বন্ধু বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে অট্টহাসি দিয়ে বলেছিল, ‘এটা কোন ব্যাপার হলো? তুই যেদিন নাবালক থেকে সাবালক হবি, সেদিন সব বুঝতে পারবি।’

আমার একটা ফেসবুক আইডি আছে, যেখানে আমার বিচরণ খুবই কম। তবে বিভিন্ন ব্লগে নিয়মিত ব্লগিং করি। অসুস্থতার কারণে চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার পর ২০১০ সাল থেকে প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় লেখালেখি করি। কিন্তু ফেসবুক বা ব্লগে কোথাও আমার যুবক বয়সের কোন ছবি নাই। যা আছে, তা’ হলো রোগা ভোগা চেহারার কেশবিরল মাথার প্রায় ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধের ছবি। আমার একমাত্র প্রকাশিত উপন্যাস ‘স্বপ্ন বাসর’-এও কোন ছবি নাই। তো আমার ফেসবুক বা ব্লগের সেই বুড়ো চেহারার ছবিকে ফটোশপ করে কীভাবে একজন নারীর সাথে সঙ্গমরত অবস্থার দৃশ্য তৈরি করা সম্ভব, এটা ভাবতে ভাবতে আমার মাথার বাঁকি চুলগুলোও পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। প্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় সেটা আমি বুঝতে পারলাম না।
আমার ছোট ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স পড়ে। ভার্চুয়াল মিডিয়ায় আমার লেখালেখির প্রযুক্তিগত দিকটি সে দেখাশোনা করে। তাকে কিছুটা রাখ ঢাক করে ব্যাপারটা বলার পর সে হেসে উড়িয়ে দিল। বললো, ‘এবার ফোন এলে তুমি আমাকে দিও। আমি কথা বলবো।’

আমি কিন্তু মোটেই ভীতু লোক নই। তারপরেও থানায় একটা জিডি করার কথা মনে হলো। কিন্তু পুলিশ ভাইদের সেবার মান নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকায় সে পথে আর গেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই লড়বো। এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপারে ছেলেকে জড়াতে মন সায় দিল না।

এক সপ্তাহ পর ঠিকই আবার ফোন এলো। আমি বললাম, ‘টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। কোথায় কীভাবে দিতে হবে বলুন।’
আমার কথায় মেয়েটি একটু থমকে গেল। তারপর বললো, ‘এত তাড়াতাড়ি টাকার জোগাড় হয়ে গেল?’
আমি বললাম, ‘দেখুন, আমি নিজে একজন সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ। আমার শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী আছে। আমার মাথায় চুল না থাকায় সবাই আমাকে চাঁন্দিছিলা হেনা নামে চেনে। এক সপ্তাহ তো অনেক বেশি সময়। এক দিনে পাঁচ লক্ষ টাকা জোগাড় করা আমার কাছে বাঁ হাতের খেল।’
মেয়েটি রেগে গেল। সে চিৎকার করে বললো, ‘আপনি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন? আমি কিন্তু এই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘আপনি তাই করুন। ছবিটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিন। আমার স্ত্রী ছবিটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সে তার স্বামীর বুড়ো বয়সের ভীমরতিও দেখতে পাবে আর আমার পাঁচ লাখ টাকাও বেঁচে যাবে।’
মেয়েটি রাগে তালকানা হয়ে গেল। শুদ্ধ ভাষা ছেড়ে সে সম্ভবত বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় আমাকে গালি গালাজ করা শুরু করে দিল। বললো, ‘মোর লগে মশকরা করেন? মশকরার দাম কিন্তু আপনারে দেতে অইবে।’
আমি আন্দাজ করে বললাম, ‘আপনি বরিশালের কোথায় থাকেন? না, না, ভয় করবেন না। আমি পুলিশে খবর দেব না।’
আমার প্রশ্নের পর ফোন কেটে গেল। মেয়েটির সাথে আর একটু কথা বলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা’ আর হলো না।

কয়েকদিন পর আমি নিজেই তাকে ফোন দিলাম। মেয়েটি ফোন ধরার পর এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যেন আমাকে সে চেনেই না। জানতে চাইল, ‘আপনি কে? আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন?’
বললাম, ‘আমি চাঁন্দিছিলা হেনা। আপনার পাঁচ লাখ টাকার টোপ। আমার সেই ছবির কী হলো ম্যাডাম? ছবিটা কী ইন্টারনেটে ছেড়েছেন?’
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিল। পরে বহু চেষ্টা করেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যখনই কল করি, তখনই ফোন বন্ধ পাই। মাসখানেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওই নোংরা মেয়েটাকে আর ফোন করার দরকার নাই। তোমার ফোনবুক থেকে ওর নম্বর ডিলিট করে দাও।’
আমি তাই করলাম। নামের ঘরে ‘পাঁচ লাখ’ লিখে সেভ করে রাখা নম্বরটা আমি ডিলিট করে দিলাম। তারপর থেকে আর কোন জ্বালা যন্ত্রণা নাই। শুধু মাঝে মাঝে আমার ছোট ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, ‘সব ঠিক আছে তো আব্বা?’ আমি কিছু বলি না। ছেলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। আর ওর মা মাঝে মাঝে বলে, ‘বুড়ো বয়সে ফেসবুকে ছেলে ছোকরাদের মতো ফেস দেখাতে গেলে এরকম তো হবেই। যত্তসব ভীমরতি!’
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে )
*********************************************************************************************************************
[ এই গল্পটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার জানুয়ারি ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা এটি পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। ]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৩০
৭৪টি মন্তব্য ৭৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেন ড. ইউনূস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১০





যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।শুভেচ্ছা বার্তায় ড. ইউনূস বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আপনাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×