সচরাচর মিথ্যে কথা বলে যারা অভ্যস্ত, তাদের সত্যি কথাও মিথ্যের মতো শোনায়। ড্রাইভার কুদ্দুসের ব্যাপারটা দেখুন। ছোটবেলা থেকে সে মিথ্যে কথা বলে। স্কুলে পড়ার সময় ‘পেটে ব্যথা’, ‘মায়ের অসুখ’ ইত্যাদি ছোট ছোট মিথ্যে কথা বলে স্কুল ফাঁকি দেওয়া তার কাছে কোন ব্যাপার ছিল না। মিথ্যে বলার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের কাছে বেদম ধোলাই খেয়েও সে এই বদভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। ধোলাই খেতে খেতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনমতে ক্লাস এইট পাশ করার পর সে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে এক সরকারি অফিসের ভেহিক্যাল সেকশনে হেল্পার কাম ক্লিনার পদে মাস্টার রোলে কাজ করতে শুরু করে।
কুদ্দুস গরীবের ছেলে। তার সংসারে অভাব অনটনের কথা শুনে সিনিয়র ড্রাইভার মহসিন মিয়ার দয়া হলো। সে কুদ্দুসকে একটু একটু করে তালিম দিয়ে দু’বছরের মধ্যে পুরোদস্তুর ড্রাইভার বানিয়ে দিল। ঘুষ দিয়ে বিআরটিএ থেকে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও করিয়ে দেওয়া হলো। নিজের কাজের পাশাপাশি কুদ্দুস ভেহিক্যাল সেকশনের ড্রাইভারদের ছুটি ছাটায় গাড়ি চালাতে লাগলো। এভাবে দীর্ঘদিন গাড়ি চালালেও পোস্ট ফাঁকা না থাকায় তার চাকরি পার্মানেন্ট হলো না। ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে কাজ করতে করতে অবশেষে একদিন তার কপাল খুললো। তার ওস্তাদ মহসিন মিয়া রিটায়ার করলে তার শুন্য পদে কুদ্দুসকে নিয়োগ দেওয়া হলো।
এতদূর উঠে আসার পেছনে কুদ্দুসের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ছিল অজস্র মিথ্যে কথা বলা আর দুর্দান্ত অভিনয়। এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার পর মিথ্যে কথা বলতে বলতে কুদ্দুস সত্যি কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিল। স্কুল জীবনের মতো চাকরি জীবনেও মিথ্যে বলাটা তার কাছে হয়ে গেল ডাল ভাত। মিথ্যে বলে কখনো কখনো ধরা খেলেও ‘লজ্জা’ নামের শব্দটির সাথে তার পরিচয় না থাকায় সে মোটেই বিব্রত হলো না। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোণ নেওয়ার সময় সে লোণের কারণ হিসাবে লিখলো, মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন। ডাঁহা মিথ্যে কথা। কারণ, তার মা মারা গেছে অন্তত দশ বছর আগে। এইভাবে শুরু হয়ে গেল তার বড় বড় মিথ্যে কথা বলা। ছুটি, লোণ, এ্যাডভান্স, ফানারাল ইত্যাদি সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য হেন মিথ্যে কথা নাই, যা সে তার দরখাস্তে লেখে না। মায়ের চিকিৎসার জন্য লোণ নেওয়ার কিছুদিন পর মাকে মেরে ফেলে ( বাস্তবে নয়, দরখাস্তে ) সে ফানারাল মঞ্জুরি চেয়ে আবেদন করলো। সাথে একখানা ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট। নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের স্ত্রী, নাবালক সন্তান ও পিতামাতা কেউ মারা গেলে সরকারি খরচে ফানারাল নামের এই মঞ্জুরির টাকা থেকে দাফন কাফনের ব্যবস্থা আছে। আর সেই কারণে এই মঞ্জুরি ইমার্জেন্সী প্রকৃতির। আবেদন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার টাকা মঞ্জুর হয়ে গেল এবং টাকাগুলো পকেটে ভরে কুদ্দুস চোখ মুছতে মুছতে দুই দিনের ছুটি নিয়ে অফিস ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেল।
বউয়ের প্রথম বাচ্চা হবার পর কুদ্দুস অফিসের স্টাফদেরকে বলেছিল তার ছেলে হয়েছে। কিন্তু পরে জানা গেল, তার মেয়ে হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় বাচ্চাটি হলো ছেলে। কিন্তু কুদ্দুসের কথা কেউ বিশ্বাস করলো না। কারণ, সে যে প্রচুর মিথ্যে কথা বলে সেটা অফিসের লোকজন বুঝে ফেলেছে। তার দু’একটা সত্যি কথাও তাদের কাছে মিথ্যে বলে মনে হয়। তাই সবাই ধরে নিল কুদ্দুসের এবারও মেয়ে হয়েছে। তারা তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? ছেলের চেয়ে মেয়েই ভালো।’
কুদ্দুস রেগে গিয়ে বললো, ‘বলছি তো মেয়ে হয়নি, ছেলে হয়েছে।’
‘ও, ছেলে হয়েছে? ভালো, ভালো।’
এক সপ্তাহ পর অফিসের আরেক ড্রাইভার আকরাম জিজ্ঞেস করলো, ‘কুদ্দুস, তোমার ছোট মেয়েটি কেমন আছে? ভালো তো?’
কুদ্দুস চিৎকার করে বললো, ‘ছোটটি মেয়ে নয়, ছেলে। কতবার বলবো তোমাদেরকে?’
‘ও, আচ্ছা আচ্ছা! তোমার বড়টিও তো ছেলে, তাই না? তাহলে তোমার দুটোই ছেলে। মেয়ে নাই। আহা! একটা মেয়ে হলে কত ভালো হতো! তোমার স্ত্রীর লাইগেশন করিয়ে নিতে পারতে।’
অফিস প্রধানের পাজেরো গাড়ি চালায় জুলফিকার। সরকারি গাড়ি। তেল মবিলের কোন হিসাব নাই। এই গাড়ির দিকে সব ড্রাইভারের নজর। কুদ্দুসেরও মনে মনে খুব ইচ্ছা বসের গাড়ি চালানোর। কিন্তু সুযোগ মেলে না। একবার ভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়ে গেল সে। জুলফিকার জরুরী কাজে সাত দিনের ছুটি নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি গেলে কুদ্দুসকে বসের গাড়ি চালানোর অর্ডার দেওয়া হলো। আর তার ডিউটিসহ ডুয়েল করার অর্ডার দেওয়া হলো আকরামকে।
কুদ্দুস মহা খুশি। বসের গাড়ি চালালে তেল, মবিল, পার্টস, সার্ভিসিংসহ নানারকম চুরি চামারির সুযোগ পাওয়া যায়, যা অন্য গাড়িতে তেমন পাওয়া যায় না। অন্য গাড়ি একবার নষ্ট হলে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মেরামত হতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু বসের গাড়ির কোন অসুবিধা হলে সাথে সাথে ঠিক করা হয়। বসের গাড়ি বলে কথা! তা’ ছাড়া বসের ড্রাইভার মানে মিনি বস। বসের কান থেকে ড্রাইভারের মুখের দূরত্ব খুবই কম। অধিকাংশ বসই কান কথা শুনতে ভালোবাসে। তাই স্বাভাবিকভাবেই অফিসের স্টাফরা বসের ড্রাইভারকে সমীহ করে চলে। এসব নানা কারণে জুলফিকারের স্টিয়ারিংটা নিজের হাতে পেয়ে কুদ্দুস আকাশের চাঁদ হাতে পেল। এবার স্টিয়ারিংটা যেন আর জুলফিকারের হাতে ফেরত না যায়, তার একটা যুৎসই ফন্দি বের করতে হবে। আর ফন্দি একটা বেরিয়েও গেল।
বসের অফিসিয়াল ডিউটি ছাড়াও কোয়ার্টার থেকে তার বাচ্চা কাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া করা, বাজার হাট, মুদিখানা, লন্ড্রি, ফার্মেসি, বেগম সাহেবার শপিং, পার্লার ইত্যাদি সবই ড্রাইভারের দায়িত্বে। তো একদিন বেগম সাহেবা কুদ্দুসকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে মুদিখানা থেকে দু’হালি ডিম আনতে বললেন। কুদ্দুস ডিম এনে বেগম সাহেবাকে আঠারো টাকা ফেরত দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডিমের দাম কমেছে নাকি?’
কুদ্দুস বললো, ‘না, ম্যাডাম। ডিমের দাম তো কমেনি। ষোল টাকা হালি অনেক দিন থেকেই চলছে। বাজারেও তো একই দাম।’
‘কী বলছো তুমি? জুলফিকার তো গত কয়েক মাস ধরে কুড়ি টাকা করে ডিম আনছে। মাঝে মাঝে বাইশ টাকাও দিতে হয়।’
‘না, না, ম্যাডাম। ডিম তো আমার বাসাতেও লাগে। গত কয়েক মাসে আমি ষোল টাকার বেশি দিয়ে ডিম কিনিনি কোনদিন। তার আগে তো বারো টাকাও ছিল।’
‘বল কী?’ ম্যাডাম হতভম্ব।
কুদ্দুস কিছু না বলে মুচকি হাসির সাথে ইঙ্গিতপূর্ণ মুখভঙ্গির মাধ্যমে এমন একটা অভিনয় করে দেখালো যে ম্যাডামের মাথা ঘুরে গেল। তিনি সেই দিনই তার সাহেবকে বললেন, ‘জুলফিকার ছুটি থেকে ফিরলে ওকে অন্য গাড়িতে বদলি করে দাও।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
ম্যাডাম ডিমের ঘটনা খুলে বলে তার সাহেবকে বোঝালেন যে, সামান্য ডিম থেকে যদি সে প্রতি হালিতে চার টাকা চুরি করতে পারে, তাহলে এতদিন তাকে দিয়ে যে হাজার হাজার টাকার কেনাকাটা করানো হয়েছে তা’ থেকে সে নিশ্চয় বহু টাকা চুরি করেছে। তাকে এই গাড়িতে রাখা যাবে না। কুদ্দুস আছে, কুদ্দুসই থাক।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। জুলফিকার ছুটি কাটিয়ে এসে ট্রান্সফার অর্ডার নিয়ে অন্য গাড়িতে চলে গেল। সে জানতেও পারলো না যে কী কারণে তাকে বদলি করা হলো।
কুদ্দুস কয়েক সপ্তাহ নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে চালানোর পর একদিন ভর্তুকি তুলে নিয়ে বললো, ‘ডিমের দাম বেড়ে গেছে ম্যাডাম।’
ম্যাডাম বললেন, ‘সব জিনিষেরই দাম বাড়ছে তো ডিমের আর দোষ কী?’
বসের গাড়ি চালিয়ে বেশ সুখেই ছিল কুদ্দুস। কিন্তু এই সুখ তার কপালে সইলো না। কিছুদিন পর তার বস বদলি হয়ে গেলেন। তার জায়গায় ভীষণ রাশভারি চেহারার নতুন বস এসে অফিসের অনেক কর্মচারীকে বদলি করে দিলেন। কুদ্দুসকে বদলি করা হলো ঢাকা থেকে খুলনায়। হেড অফিস থেকে এক ধাক্কায় রিজিওনাল অফিসে বদলি। কুদ্দুসের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত।
বদলি ঠেকানোর জন্য পরদিন বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অফিসে চলে এল কুদ্দুস। কিন্তু বসের চেম্বারে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। বসের এ্যাটেনডেন্ট পিওন জলিল এতদিন কুদ্দুসকে সালাম দিয়ে কথা বলতো। কিন্তু আজ তার চেহারা বসের চেয়েও ভয়ংকর। সে কুদ্দুসকে কড়া গলায় জানিয়ে দিল যে, এই মুহূর্তে যদি সে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে এখান থেকে চলে না যায় তো বস বলেছেন তাকে সাসপেন্ড করা হবে। কুদ্দুসের বউ বিরামহীন কেঁদে চলেছে দেখে জলিল কষে ধমক দিয়ে বললো, ‘চুপ! একদম চুপ! ননসেন মহিলা! পোলাপান নিয়া অফিসে আইয়া পড়ছে।’
শেষ পর্যন্ত কুদ্দুসকে খুলনায় যেতেই হলো। সেখানে জয়েন করে সে বিকট বিকট মিথ্যে কথা লিখে ঢাকায় বদলির জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত পাঠাতে লাগলো। যেমন- “ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আমার পক্ষাঘাতগ্রস্থ পিতার ফিজিওথেরাপী চলিতেছে। তাহার চিকিৎসা ও দেখাশুনার জন্য আমি ছাড়া আর কেহ নাই। আমি তাহার একমাত্র সন্তান। এমতাবস্থায়...............”
কিন্তু কুদ্দুসের পিতা আদৌ পক্ষাঘাতগ্রস্থ নন এবং সেও তার পিতার একমাত্র সন্তান নয়। তার আরও তিন ভাই ও দুই বোন আছে। পিতা পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও বেশ শক্ত পোক্ত মানুষ এবং তিনি তার বড় ছেলের সাথে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে থাকেন।
ডিপার্টমেন্টাল ইনকোয়ারিতে কুদ্দুসের মিথ্যা ধরা পড়ে গেল। বদলি তো দূরের কথা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে বদলির আবেদন করায় তাকে শো-কজ করে একটা ইনক্রিমেন্ট কেটে নেওয়া হলো। কুদ্দুসের বেতন কমে গেল।
বছর খানেক চুপচাপ থাকার পর হেড অফিসে নতুন বস এলে কুদ্দুস আবার বদলির আবেদন করলো। এবার সে লিখলো স্ত্রীর টিউমারের কথা। সাথে একখানা ভুয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট (ডাক্তারকে টাকা দিলে এমন সার্টিফিকেট আকছার পাওয়া যায়)।
“উক্ত টিউমারের অপারেশন খুলনায় সম্ভব নয় বিধায়.........।” অতঃপর ইনিয়ে বিনিয়ে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ভাষায় ঢাকায় বদলির আবেদন।
কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি না করে এক মাসের ছুটি দিয়ে দিল এবং স্ত্রীর অপারেশন শেষে আবার খুলনা অফিসেই যোগদানের আদেশ দিল। যোগদানের সময় জয়েনিং রিপোর্টের সাথে স্ত্রীর অপারেশন করা হয়েছে মর্মে হাসপাতালের সনদপত্র দাখিল করতে হবে।
কুদ্দুসের বেশিরভাগ মিথ্যে কথাই অসুস্থতা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত। কারণ, সে লক্ষ্য করে দেখেছে এতে বেশ কাজ হয়। তবে সে ভুলেও কখনো নিজের অসুখের কথা লেখে না। একবার নিজের এরকম মিথ্যে অসুখের কথা লিখে ছুটি চাওয়ায় তার আগের এক বস বলেছিলেন, ‘কুদ্দুস, মুরগির অসুখ হলে মানুষ কী করে জানো? মুরগিকে জবাই করে খেয়ে ফেলে। তোমাকে কিন্তু আমি ইনভ্যালিড পেনশনে পাঠিয়ে দেব।’
তারপর থেকে কুদ্দুস কখনো নিজের অসুখের কথা লেখে না। কিন্তু আজকাল অন্যদের অসুখের কথা লিখেও কাজ হচ্ছে না। বরং একবার একটা ইনক্রিমেন্ট খোয়াতে হলো, আর এবার আদেশ হলো স্ত্রীর অপারেশন হয়েছে মর্মে হাসপাতালের সনদপত্রসহ আগের অফিসেই জয়েন করতে হবে। বিপদ আর কাকে বলে!
কুদ্দুস ঝুঁকি নিল না। অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা নাই, তাই আপাতত স্ত্রীর অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে সে এক মাসের ছুটি বাতিল করে দিল। মিথ্যে কথা লিখে এবারও তার কোন ফায়দা হলো না।
বহু চেষ্টা করেও কুদ্দুস ঢাকায় বদলি হতে পারে না। তিন বছর খুলনায় থাকার পর তাকে বদলি করা হলো রাজশাহীতে। সেখানে দু’বছর কাটিয়ে যেতে হলো রংপুর। তারপর চট্টগ্রাম। এভাবে ঢাকার বাইরে ঘুরতে ঘুরতে চাকরি জীবনের শেষের দিকে এসে একদিন সে এক দালালের খোঁজ পেয়ে গেল। সরকারের উপর মহলে এই দালালের ভীষণ দহরম মহরম। মন্ত্রী এমপি সব তার হাতের মুঠোয়। কুদ্দুসকে ঢাকায় বদলি করা তার কাছে ওয়ান টু ব্যাপার। প্রথম প্রথম একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগলেও কুদ্দুস দালালকে কিছু টাকা দিয়ে তার বদলির আবেদনপত্রে একজন মন্ত্রীর লিখিত সুপারিশ নিয়ে হেড অফিসে পাঠিয়ে দিল। দালাল বললো, এক সপ্তাহের মধ্যে অর্ডার হয়ে যাবে।
অর্ডার এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে গেল। তবে সেটা ট্রান্সফার অর্ডার নয়, সাসপেনশন অর্ডার। আবেদনপত্রে ভুয়া সুপারিশের অভিযোগে ‘মিসকন্ডাক্ট’ চার্জ এনে কুদ্দুসকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হলো। এবার অবশ্য কুদ্দুসের বউয়ের আকাশ পাতাল কান্নাকাটি দেখে কর্তৃপক্ষের একটু দয়া হলো। বিভাগীয় তদন্ত শেষে কুদ্দুসকে ডিসমিস না করে কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিতে জয়েন করার সুযোগ দিল। তবে শাস্তি হিসাবে তার দুটো টাইম স্কেল গচ্চা গেল। একই স্কেলের অনেক জুনিয়র কর্মচারীর চেয়ে কুদ্দুসের বেতন কমে গেল।
দেখতে দেখতে কুদ্দুসের রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেল। কিন্তু তার মাথা থেকে মিথ্যের ভুত নামলো না। সে কোত্থেকে একটা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র জোগাড় করে সার্ভিস এক্সটেনশনের দরখাস্ত করলো। মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীরা অতিরিক্ত দু’বছর চাকরি করার সুযোগ পায়। এই সুযোগটা সে কাজে লাগাতে চাইল।
দরখাস্ত পেয়ে হেড অফিস থেকে কুদ্দুসকে ডেকে পাঠানো হলো। সে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে তসবিহ হাতে জিকির করতে করতে বসের সাথে দেখা করতে ঢাকায় চলে এলো।
বস নরম স্বভাবের ভদ্রলোক মানুষ। তিনি অফিসের হেড ক্লার্কের কাছে কুদ্দুসের দরখাস্ত, সার্ভিস বুক, পার্সোনাল ফাইল ও এসিআর চেয়ে পাঠালেন। মনোযোগ দিয়ে সমস্ত নথিপত্র দেখার পর তিনি কুদ্দুসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?’
‘জি স্যার।’
‘কোন্ সেক্টরে যুদ্ধ করেছো?’
কুদ্দুস আমতা আমতা করে বললো, ‘এতদিন পরে কী আর মনে আছে স্যার?’
‘তোমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কে ছিল?’
কুদ্দুস মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কমান্ডারের নাম তার মনে পড়লো না। সে হাসি হাসি মুখ করে বললো, ‘মনে পড়ছে না স্যার।’
অফিসার ঠাণ্ডা চোখে অনেকক্ষণ কুদ্দুসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বললেন, ‘দরখাস্ত উইথড্র করো। তোমার জন্য সেটাই ভালো হবে।’
কুদ্দুস উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, ‘কেন স্যার?’
‘তোমার এই মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র যাচাইয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে কী রিপোর্ট আসবে, সেটা আমরাও জানি, তুমিও জানো। তাই দরখাস্ত উইথড্র করাটাই তোমার জন্য ভালো হবে।’
কুদ্দুস কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঠিক আছে স্যার। আমার দরখাস্তটা ফেরত দিয়ে দেন।’
‘স্টাফ সেকশন থেকে সই করে ফেরত নিয়ে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।’ অফিসার কলিং বেলের সুইচ টিপে হেড ক্লার্ককে ডেকে পাঠালেন।
কুদ্দুস যেদিন অবসরে গেল, সেদিন সে অফিসের স্টাফদের কাছে মাত্র একটাই মিথ্যে কথা বলেছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এক্সটেনশন নিলাম না ভাই। আসলে চাকরি করতে আর ভালো লাগছিল না। বহু বছর তো চাকরি করলাম। আর কত?’
*************************************************************************************************************
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৪৬