চারুকলার ছাত্রী রুনার সাথে খালেদের পরিচয় হয়েছিল একুশের বইমেলায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খালেদ বইমেলার এক স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন প্রকাশিত কিছু বই নাড়াচাড়া করে দেখছিল। স্টলের সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। দু’জন বান্ধবীর সাথে রুনা এসে খালেদকে রীতিমতো ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু সরে দাঁড়ান।’
মেয়েদের ধাক্কা খেলে কোন কোন তরুণ পুলকিত হয়, আবার কেউ কেউ রেগে যায়। খালেদ হলো দ্বিতীয় দলের। সে বহু কষ্টে রাগ দমিয়ে রেখে শান্ত গলায় বললো, ‘সরিয়েই তো দিয়েছেন! আরো সরে যাবো কি?’
খালেদের কথা যেন রুনা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে সে স্টলের কর্মচারীদের সাথে ‘এই বইটা দেখি’, ‘ঐ বইটা দেখি’ ইত্যাদি কথাবার্তায় ব্যস্ত। ওর বান্ধবীরা কুল কুল করে হাসছে আর চোরা চোখে খালেদকে দেখছে। এভাবে কিছুক্ষণ বইপত্র নাড়াচাড়া করে কোন বই না কিনেই ওরা চলে গেল। আসলে অপরিচিত যুবকটিকে ধাক্কা মেরে স্টলের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে পারলে রুনাকে যত খুশি ফুচকা খাওয়ানো হবে-এমন একটা বাজি হয়েছিল ওদের মধ্যে।
খালেদের আর বই দেখা বা কেনা কোনটাই হলো না। সে ভিড়ের মধ্যে রুনাদের অনুসরন করে বাংলা একাডেমীর বাইরে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালো। সেখানে রুনারা তিন বান্ধবী মিলে ধুমসে ফুচকা খাচ্ছে। ওদের খাওয়ার চেয়ে হাসির পরিমান বেশি। ফুচকাওয়ালা ওদের সামাল দিতে মহা ব্যস্ত। খালেদ শুনেছিল, মেয়েদের হাসি বা কান্নার নাকি বিশেষ কোন কারণ থাকেনা। ওর মনে হলো, কথাটা ভুল নয়। সে ওদের থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওদের ‘ফুচকা হাসির’ প্রতিযোগিতা দেখছিল। ঠিক এই সময় রুনা হাত ইশারায় খালেদকে ডাক দিল। তাকেই ডাকছে নাকি অন্য কাউকে, বুঝতে না পেরে খালেদ নিজের আশেপাশে চলমান অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। রুনা চিৎকার করে বললো, ‘আরে, আপনি, আপনি। আপনাকেই ডাকছি।’
খালেদ ওদের কাছে যাওয়ার আগে ভিড়ের মধ্যে থেকে এক মাঝবয়সী টেকো মাথার ভদ্রলোক হন হন করে হেঁটে রুনার সামনে গিয়ে হাজির। তিন বান্ধবীর ঝাড়ি খেয়ে ভদ্রলোক একই গতিতে আবার হাওয়া হয়ে গেলেন। খালেদ দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে রুনা বললো, ‘নিন, ফুচকা খান।’
খালেদ ইতস্ততঃ করে বললো, ‘আমি ফুচকা খাই না।’
‘তাহলে কি খান? ফিডারে দুধ খান?’
খালেদ বইমেলায় আসার আগে ওর ভাবীর অনুরোধে ছয় মাস বয়সী ভাতিজার জন্য একটা দুধ খাওয়ার ফিডার কিনেছিল। নাদুস নুদুস বাচ্চা ও ফিডারের ছবিওয়ালা প্যাকেটটি ওর হাতে ছিল, যা সম্ভবতঃ রুনার চোখে পড়েছে। এই মেয়েরা যে তাকে বোকা বানিয়ে মজা পাওয়ার চেষ্টা করছে, তা’ খালেদ বেশ বুঝতে পারছে। আজকাল মেয়েরা যে এত চালু হয়ে গেছে, ভাবা যায় না। টিজ করা আজকাল আর শুধু ছেলেদের ব্যাপার নয়, মেয়েদেরও এতে হিস্যা আছে তাহলে! বেশ, বেশ!
খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যৎসামান্য ছাত্র রাজনীতিও করে। সে মোটেই বোকা বা নির্বোধ নয়। বরং ছাত্র হিসাবে সে যথেষ্ট মেধাবী। কোন পরিস্থিতিতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়া তার স্বভাবের সাথে যায় না। সে মৃদু হেসে বললো, ‘আপনারা খুব স্মার্ট। অনেক খুঁটিনাটি জিনিষও আপনাদের চোখে পড়ে।’
‘তাই নাকি?’ একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে তিন বান্ধবীর মধ্যে আবার হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। খালেদও হাসতে হাসতে বললো, ‘ফিডারের প্যাকেট চোখে পড়লো, আর কিছু চোখে পড়েনি?’
হাসি থামিয়ে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে খালেদের আপাদমস্তক পরখ করে দেখলো। রুনা বললো, ‘আর কিছু কি?’ খালেদ বললো, ‘আগের দিনে কবি সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় নারীর বিশেষণ হিসাবে অবলা শব্দটি ব্যবহার করতেন। এই শব্দটি আজকাল আর প্রাসঙ্গিক নয়। এখনকার মেয়েরা যে কত স্মার্ট এবং ছেলেদের কত কিছু লক্ষ্য করে, সেটা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিকবাবুরা জানতেন না। জানলে ঐ ভুল শব্দটি তাঁরা লিখতেন না। যা হোক, আপনারা আমার হাতে ধরা ফিডারের প্যাকেট দেখেছেন, কিন্তু আমার পায়ে পরা জুতা জোড়া তো দেখেননি! আমার পায়ে কিন্তু এক জোড়া শক্ত পোক্ত কালো রঙের জুতা আছে!’
‘এসব আপনি কি বলছেন?’ রুনা ও ওর বান্ধবীরা খালেদের পায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক বান্ধবী ঢোক গিলে বললো, ‘আমাদেরকে জুতা দেখাচ্ছেন কেন?’
‘দেখাচ্ছি এই কারণে যে, অবলা শব্দটি এ যুগে অপ্রাসঙ্গিক হলেও জুতাপেটা শব্দটি কিন্তু এখনো যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। পকেটমার বা ছিনতাইকারী ধরা পড়লে মানুষ এখনো জুতাপেটা করে। অর্বাচীন কথাবার্তা বা অন্যায় কাজকর্মের জন্য মানুষ জুতা ছুঁড়ে মারে। প্রেসিডেন্ট বুশকে একজন ইরাকি সাংবাদিক জুতা ছুঁড়ে মেরেছিল, এ ঘটনা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের?’
রুনা বিড় বিড় করে বললো, ‘লোকটা পাগল। এই চল্, চল্।’ ফুচকাওয়ালা বললো, ‘আমার ট্যাকা দ্যান।’
‘হাঁ হাঁ মামা, আপনার কত হয়েছে বলেন তো!’ ফুচকাওয়ালার বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা তিন বান্ধবী অতি দ্রুত কেটে পড়লো। ফুচকাওয়ালা তার পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে হেসে বললো, ‘স্যার, এই তিন ম্যাডাম এই রহমই। খালি পোলাপানগো লগে তামশা করে।’
‘তুমি এদের চেন নাকি?’
‘চিনুম না ক্যান? হ্যারা তো চারুকলার বাগানে বইয়া ছবি আঁকে, মূর্তি বানায়।’
‘ও!’
খালেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র। হলে থেকে পড়াশুনা করে। ঢাকার যানজট তার কাছে অসহ্য লাগে। নেহাত প্রয়োজন না হলে সে ঢাকায় আসে না। মোহাম্মদপুরে বড় ভাইয়ের বাসায় মাসে দু’মাসে আসা হয়। অথচ বইমেলার সেই ঘটনার পর ভাতিজাকে দেখার জন্য সে দু’সপ্তাহে তিন চারবার ঢাকায় এলো। হলে ফিরে যাওয়ার আগে সে প্রতিবারই টি এস সি ও চারুকলার আশেপাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করলো। কিন্তু কেন, খালেদ নিজেও জানেনা। মেয়েগুলোর সাথে কড়া ব্যবহারের জন্য মনের ভেতর অনুশোচনা ছিল। দেখা হলে হয়তো ক্ষমা চেয়ে নিত। কিংবা দেখা হলে হয়তো ধাক্কা দেওয়া মেয়েটি নিজেই ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিত। দেখা হলে কিছু তো একটা হতো! কিন্তু ওদের সাথে আর দেখাই হলো না। খালেদ উপযাচক হয়ে চারুকলায় ঢুকে খোঁজ নেবে, এমনটা ভাবা ওর জন্য কঠিন।
তবে রুনার সাথে খালেদের আবার দেখা হলো। চার বছর পর। রুনা এক শপিং মলে তার বাচ্চার জন্য এক কৌটা দুধ আর ভালো ব্র্যান্ডের একটা ফিডার কিনে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিল। স্বামী জাফর নিজের জন্য পেন ড্রাইভ ও মেমোরি কার্ড কিনতে শপিং মলের থার্ড ফ্লোরে গেছে।
খালেদ একটি কর্পোরেট হাউসের লিয়াজোঁ অফিসার। নিজের জন্য একজোড়া বিদেশী ব্র্যান্ডের জুতা কিনে সে এস্কেলেটার বেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে রুনার সামনা সামনি পড়ে গেল।
‘এক্সকিউজ মি, আমি কি আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি?’
রুনা কিন্তু খালেদকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে। সে কোন কথা না বলে তার হাতে ধরা প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে ফিডারের প্যাকেটটা বের করে হাতে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইল।
‘ও! আচ্ছা, আচ্ছা। বইমেলা?’
‘জি’
‘ফিডার আপনার বাচ্চার জন্য?’
‘জি’
‘আপনার নামটা যেন কি?’
রুনা মৃদু হেসে বললো, ‘আমরা তো সেদিন কেউ কারো নাম জিজ্ঞেস করিনি। এতদিন পর আর নাম জেনে কি হবে?’
রুনার নজর গেল খালেদের হাতে ধরা প্যাকেটের দিকে। সে হাসিমুখে বললো, ‘কি কিনলেন?’
খালেদ থতমত খেয়ে প্যাকেট ধরা হাতটা পেছনে লুকিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বললো, ‘না, কিছুনা।’
‘কিছু একটা তো বটেই।’ রুনা হাসতে হাসতে বললো, ‘হয়তো ভাবীর জন্য কিছু। তবে না দেখাতে চাইলে সমস্যা নেই। বি ইজি প্লিজ।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও খালেদ তার হাত সামনে এনে প্যাকেটটা দেখালো রুনাকে। মাথা নিচু করে বললো, ‘জুতা।’
‘এ্যাঁ, জুতা?’ চার বছর আগের মতোই হেসে গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো রুনার। মুখে হাত চাপা দিয়ে সে বললো, ‘শুধু জুতাই কেনেন দেখছি। বাচ্চার জন্য ফিডার কেনেন না?’
খালেদ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘না। সেদিন যে ফিডারের প্যাকেট দেখেছিলেন, সেটা ছিল আমার বড় ভাইয়ের বাচ্চার জন্য। আমার নিজের বাচ্চার জন্য ফিডার কেনার প্রয়োজন হবে না।’
‘ঠিক বুঝলাম না। বাচ্চা বড় হয়ে গেছে, নাকি বিয়েই করেন নি?’
‘না, আমার কোন বাচ্চা নেই। এক বছর আগে বিয়ের পর আমার ওয়াইফের ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়ে। আফটার অপারেশন সি ইজ নাউ পার্মানেন্টলি স্টেরিল।’
রুনার স্বামী জাফর পেন ড্রাইভ ও মেমোরি কার্ড কিনে ফিরে এসেছে। খালেদ তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো, ‘আমি খালেদ। গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’
‘আমি জাফর। মিট ইউ টু।’ জাফর তাড়া দিল স্ত্রীকে, ‘রুনা, চলো, চলো। আর দেরি করো না। বস্ ফোন করেছিল। আমাকে এখনই গাজীপুর ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে।’ তারপর সে খালেদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘এক্সকিউজ মি! উই আর ইন হারি। নেক্সট টাইম প্লিজ! বাসায় আসবেন, ও,কে?’
খালেদ ও রুনা একে অন্যের নাম জানলো প্রথম দেখা হবার চার বছর পর। এমন কত কিছুই তো আমরা জানতে পারি তখন, যখন তা’ আর জানার প্রয়োজন হয় না।
**********************************************************************************************************************
ছবিঃ নেট
[গল্পটি সাপ্তাহিক সাতদিন পত্রিকার ০৮/০২/২০১০-১৪/০২/২০১০ সংখ্যায় (ভালোবাসা দিবস সংখ্যা) প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।]
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:০২