১
প্রতিদিন খুব ভোরে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার গাড়ি গুলো আসার আগে জামাল আর মন্টু এসে হাজির হয়ে যায়। দশ বছর বয়সের জামাল আর ওর চেয়ে এক বছরের বড় মন্টু। আবর্জনা ফেলে ট্রাক গুলো চলে গেলে শুরু হয়ে যায় ওদের কাজ। সিমেন্টের খালি পলিব্যাগের বস্তা কাঁধে নিয়ে ভাগাড়ে পলিথিনের টুকরা খুঁজতে নেমে পড়ে ওরা। অন্য টোকাইরা আসার আগে যতটা পারা যায় ছেঁড়া ফাটা শপিং ব্যাগ, ভাঙ্গা ফাটা প্লাস্টিকের টুকরা, খাবারের পলিব্যাগ, সাটারিং কাজের ছেঁড়া পলিথিন ইত্যাদি খুঁজে খুঁজে বের করে বস্তায় ভরে শক্ত করে মুখ বেঁধে ঘাড়ে তুলে নেয় ওরা। তারপর কোন পুকুর বা জলাশয়ে নিয়ে পলিথিনের টুকরা গুলো ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিয়ে আবার বস্তাবন্দী করে। বিসিক শিল্প এলাকার কয়েকটি প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে এসবের চাহিদা আছে। সেখানে বস্তা পৌঁছে দিলে কারখানার ম্যনেজারের লোক ওজন করে ওদের টাকা দেয়। এক কেজি পলিথিন পাঁচ টাকা। বস্তায় ঠেসে ঠুসে ভরলেও দশ কেজির বেশি ধরে না। কোন কোন দিন ওদের ভাগ্যে সাত আট কেজির বেশি ছেঁড়া পলিথিন জোটে না।
আজ ময়লা ফেলার ট্রাক গুলো চলে যাওয়ার পর জামাল ভাগাড়ের আবর্জনা ঘেঁটে পলিথিন খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটা আজব জিনিষ পেয়ে ঘাবড়ে গেল। পলিথিন দিয়ে মোড়ানো আধখানা দেহের মৃত মানব শিশু। কাঠির মতো সরু সরু হাত পা। অস্ফুট নাক চোখসহ কিম্ভূতকিমাকার মাথা। ছোপ ছোপ রক্তে ভেজা এক খণ্ড মাংসপিণ্ড।
‘মন্টু!’ জামালের ভয়ার্ত চিৎকারে ছুটে আসে মন্টু। জামালের হাত থেকে পড়ে যাওয়া পলিথিনের প্যাকেটটা তুলে দেখে সে। তারপর নির্বিকার চিত্তে বলে, ‘ঘাবড়াইস না। এইডা হইল জাইরা পোলা। এই কামে তুই নতুন আইছস তো! তাই ভয় পাইছস। এই রহম জাইরা পোলা আমরা কত দেখছি!’
মাংসপিণ্ডসহ পলিথিনের প্যাকেটটা ভাগাড়ের আরও ভেতর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জামালের হাত ধরে টান দেয় মন্টু, ‘চল্ চল্। ঐ দেখ, টোকাইরা সব আইয়া পড়তাছে। দিরম করলে কিছুই পাইতি না।’
ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফোটেনি। তবু ওদের মতো একজন দু’জন করে টোকাই বস্তা কাঁধে নিয়ে ভাগাড়ে আসতে শুরু করেছে। সাথে সাথে শুরু হয়েছে নেড়ি কুকুরের আনাগোনা। টোকাইরা ওদের মতো পলিথিন ও প্লাস্টিকের টুকরা খোঁজে। কেউ কেউ খোঁজে ভাঙ্গা টিন, লোহা লক্কড় ও কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যান। মন্টু ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার কাজে। কিন্তু জামাল পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতা স্তব্ধ করে দিয়েছে ওকে। বুকের ভেতর ছোট হৃৎপিণ্ডটা ধুক ধুক করে এক অজানা আতংকের জানান দিচ্ছে ওকে। চলে যেতে হবে, এখান থেকে এখুনি চলে যেতে হবে ওকে। পিতৃ মাতৃহীন দশ বছরের টোকাই জামাল ভয় পেয়েছে। বস্তিতে ফিরে গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে সে। সারাদিন যেন ক্ষিধে না পায়, সে জন্য জুতার আঠা পুড়িয়ে ধোঁয়া টেনে নেশা করতে হবে ওকে। তারপর সে হারিয়ে যাবে এই ভয়ের পৃথিবী থেকে। এখানে শুধু ভয় আর ভয়, শুধু ক্ষিধে আর ক্ষিধে।
কিন্তু জামালের ফেরা হয়না। টোকাইরা ভাগাড়ের আবর্জনা থেকে খুঁজে খুঁজে পলিথিন, টিন, লোহা, কাঠ ইত্যাদি বের করে নিজ নিজ বস্তায় ভরছে। নেড়ি কুত্তাগুলো খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করছে। মন্টু পলিথিন খুঁজতে খুঁজতে চলে গেছে জামালের দৃষ্টিসীমার বাইরে। হঠাৎ জামালের চোখে পড়লো দুই কুত্তার কামড়াকামড়ি। ‘জাইরা পোলার’ রক্তাক্ত মৃতদেহটা কামড়ে ধরে টানাটানি করছে কুকুর দুটো।
জামালের কী যে হলো, সে নিজেও জানে না। সব আতংক দূর হয়ে গেল ওর মন থেকে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরা তুলে নিয়ে সে তাড়া করলো কুকুর দুটোকে। মৃত মাংসপিণ্ডটা ফেলে দিয়ে ছুটে পালালো ওরা। খুলে যাওয়া পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মাংসপিণ্ডটা জামাল বুকে তুলে নিয়ে ভাগাড় থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললো দিকভ্রান্তের মতো। কোথায় যাবে, কেন যাবে কিছুই জানে না সে।
২
ছুটতে ছুটতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে এক নির্জন রাস্তার পাশে বসে পড়ে জামাল। হাপরের মতো বুকটা ওঠানামা করতে থাকে ওর। পূবের আকাশে লাল রঙের সূর্য উঠছে। পলিথিনের মোড়ক ধরা জামালের দু’হাতে মাছি বসে ভন ভন করছে। অসহায়ের মতো সেদিকে তাকিয়ে থেকে কী করবে কিছু ভেবে পায়না জামাল। এক মাস আগে এতিমখানা থেকে পালিয়ে এসেছে সে। সেখানে খাওয়ার খুব কষ্ট। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনী। ভারি কুড়াল দিয়ে লাকড়ি ফাঁড়ার কাজ করতে করতে দম বেরিয়ে আসে ওর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতিমখানাই ভালো ছিল ওর জন্য। এতিমখানার চার দেয়ালের বাইরে এই দুনিয়াটা আরও ভয়ংকর। সারাদিন নোংরা আবর্জনা ঘেঁটে দু’বেলা পেট পুরে খাবার জোটে না। ওর সারা গায়ে খোস পাঁচড়া। সারাদিন চুলকায়। চুলকাতে চুলকাতে অস্থির হয়ে যায় সে। সব কষ্টের একটা ভালো ওষুধ অবশ্য ওর কাছে সব সময় থাকে। জুতার আঠা। পেটে না খেলেও এই আঠা ওকে কিনে রাখতে হয়। আঠা পুড়িয়ে ধোঁয়া টেনে নেশা করলে ক্ষিধে, ভয়, চুলকানি কিছুই থাকে না। দশ টাকার আঠায় পাঁচ দিন নেশা করা যায়। নেশা হলে জামাল স্টেশনের প্লাটফরমে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। ট্রেন চলে যায়, যাত্রীরা চলে যায়, দিন রাত সবই চলে যায়। রেল পুলিশের লোকেরা ওকে লাথি মেরে চলে যায়। জামাল চোখ বুঁজে নিঃশব্দে পড়ে থাকে।
রাস্তার পাশে অগভীর শুকনো খালে একটা ভাঙ্গা টিনের টুকরা দিয়ে খানিকটা গর্ত খোঁড়ে জামাল। মানব শিশুর ক্ষত বিক্ষত আধখানা দেহ যত্ন করে গর্তে শুইয়ে মাটি চাপা দেয় সে। তারপর সেখানে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে পড়ে। এখন নেশা করতে হবে। নেশা না করলে সে আজই মরে যাবে। শরীরটা চরম অস্থির হয়ে উঠেছে। ক্ষিধের জ্বালায় পেটের ভেতর নাড়ীভুঁড়িগুলো জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আধখানা কদর্য মানব শিশুর আতংক ধরানো চেহারা বার বার ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে। এ সব থেকে মুক্তি পেতে চায় জামাল।
রাস্তার ওপাশে নির্জন রেল লাইনের ধারে বসে হাফ প্যান্টের পকেট থেকে জর্দার কৌটা, রাংতা আর দিয়াশলাই বের করে এদিক ওদিক দেখে নেয় সে। কোথাও কোন লোকজন নেই। কৌটা থেকে আঠা বের করে রাংতার ওপর রেখে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে নিচ থেকে তাপ দেয় সে। নীলচে ধোঁয়া উঠলে নাক দিয়ে টেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জামাল। আহ্!
৩
দুই চোখ বুঁজে রেল লাইনের স্লিপারের ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে জামাল। স্বর্গের দূত হয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা নেমে এসেছে মর্তে। কী অদ্ভুত সুন্দর চেহারা তাদের! রঙিন পোশাক পরে প্রজাপতির মতো চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। ওদের আলোয় সারা জগত আলো ঝলমলে।
লাইনের ওপর দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে একটা ট্রেন। মসৃণ সাদা ডানাওয়ালা শ্বেতশুভ্র অপরূপা এক ঝাঁক পরী ফুলের বাগানে নেচে নেচে কিন্নর কণ্ঠে গান গাইছে। মন ভোলানো সৌরভময় শত শত রঙ বেরঙের ফুলের মাঝে আধ ফোটা বর্ণ গন্ধহীন এক নাম না জানা ফুল মাথা নুইয়ে নিজেকে যেন লুকাতে চাইছে। অথচ আকাশের তারার মতো উজ্জ্বল হয়ে অস্ফুট সেই ফুলের কলি কতই না সুন্দর! আরও সুন্দর হয়ে পাপড়ি মেলতে চায় সে।
বিকট হুইশেলের আওয়াজ তুলে ছুটে আসছে ট্রেনটা। যেন সর্বগ্রাসী এক যন্ত্রদানব। আধ ফোটা ফুলের কলিটাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে জামাল। কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও হাত দুটো তুলতে পারছে না সে। ওর এত কাছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, অথচ রঙ রূপহীন ছোট্ট আধ ফোটা ফুলের কলিটা কিছুতেই ছুঁতে পারছে না জামাল। হাতের স্পর্শে ছুঁতে না পারলে মনের স্পর্শ দিয়ে ছুঁতে চায় সে। তবু একবার কলিটাকে ছুঁয়ে দেখতে চায় সে।
হঠাৎ দপ করে নিভে গেল চারদিকের আলো। নিকষ কালো অন্ধকারের পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল সব। শব্দ, বর্ণ, গন্ধ, রূপ, রসময় স্বর্গের দ্যুতি নিমেষে হারিয়ে গেল এক এতিম মানব শিশুর চোখের সামনে থেকে।
***************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:২৭