somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যরচনাঃ চুল নিয়ে চুলচেরা

২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

( ব্লগার বন্ধুদের মধ্যে যাদের মাথায় চুল নেই, এই লেখাটি তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম )

সম্প্রতি সাদাকালো (মানে কাঁচাপাকা) ও রঙিন (মানে ডাই করা) চুল নিয়ে চারদিকে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। একটি পত্রিকার শিরোনাম দেখলাম, ‘রাজনীতিতে চুলাচুলি।’ ফেবুতে একটা কমেন্ট দেখলাম, ‘যাদের মাথায় চুল নেই, তারা কী করবে?’ খুব গুরুতর প্রশ্ন।
আমার নিজের মাথায় যে ক’টা চুল আছে, তা’ গুনে শেষ করতে পনের বিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। এ অবস্থায় আমিই বা কী করবো? আমার কাজ হলো লেখালেখি করা। কিন্তু এমন বিরল কেশ মানুষের পক্ষে চুল নিয়ে লেখালেখি করা অনেকটা অনধিকার চর্চার মতো। তারপরেও এক ব্লগার বন্ধুর অনুরোধে আজ ঢেঁকি গিলতে বসে গেলাম।

চুল-দু’ অক্ষরের একটা ছোট্ট শব্দ। অথচ এর ব্যঞ্জনা (Figurative mode of expression) অনেক। সাধারনতঃ মেয়েদের ক্ষেত্রে এই Figurative mode of expression বেশি লক্ষ্যনীয়। তবে আজকাল শ্যাম্পু, জেল, ডাই, কন্ডিশনার ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে এসেছে। আমাদের যুগে (মানে আমরা যখন ছেলে মেয়ে ছিলাম) এসব তো দূরের কথা, টয়লেট সাবান না থাকলে কাপড় কাচার হুইল সাবান দিয়ে মাথার চুল পরিস্কার করেও আমরা ক্লাসে গেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা এ কথা শুনলে নির্ঘাত আঁতকে উঠবে।

তবে ব্যাতিক্রম যে সে যুগে ছিল না, তা’ নয়। যেমন, আমার বন্ধু আফতাব। স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা তাকে চুল নিয়ে নানা কসরত করতে দেখে আসছি। নাইন টেনে পড়ার সময় সে চুলে জবজবে করে শর্ষের তেল মেখে পরিপাটি করে আঁচড়ে ক্লাসে আসতো। তার দুই চিপ গড়িয়ে শর্ষের তেল চুঁয়ে গালের ওপর এসে পড়তো। অংক টিচার জামীল স্যারের একটা বদভ্যাস ছিল। ক্লাসের কোন ছাত্র অংক না পারলে শাস্তি স্বরূপ তার চিপ ধরে তিনি টেনে তুলতেন। আফতাবের বেলায় তাঁর হাতের আঙ্গুল বার বার পিছলে যেতো।
দেশ স্বাধীন হবার পর আফতাবের চুল বদলে গেল। সে চুলে শর্ষের তেল মাখা বন্ধ করলো এবং মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বাবরি চুল রাখা শুরু করে দিল। এই ফ্যাশনটা কয়েক বছর কন্টিনিউ করার পর তার বাবরি চুলে অরুচি হলো। তখনকার জনপ্রিয় সুইডিশ ব্যান্ড ‘বনি এম’-এর এক সদস্যের অনুকরণে সে সেলুনে গিয়ে চুলের ছাঁট বদলে ফেললো। মাথার মাঝখানে ঘাড় থেকে কপাল পর্যন্ত লম্বা ও দুই ইঞ্চি চওড়া সজারুর কাঁটার মতো এক গোছা চুল রেখে দু’পাশে চেঁছে ফেললো। আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে সে বললো, ‘এটা পাঙ্ক।’ ইউরোপে এই পাঙ্ক নাকি লেটেস্ট ফ্যাশন।

অবশ্য পাঙ্কও বেশিদিন টিকলো না। সম্ভবতঃ ১৯৭৮ সালের দিকে আফতাবসহ আমরা কয়েক বন্ধু গর্দানি পাসপোর্টে ভারতে গেলাম হিন্দি সিনেমা দেখতে। জানেনই তো, সেই সময় বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা দেখার কোন সুযোগ ছিল না। তো এই গর্দানি পাসপোর্টটা কী? এই পাসপোর্টের শানে নজুল হলো, এটা আসলে কোন পাসপোর্টই নয়। সীমান্তের এপারে বিডিআরকে কুড়ি টাকা আর ওপারে বিএসএফকে দশ রুপী নজরানা দিলে তারা আমাদের ঘাড়ে (মানে গর্দানে) ধাক্কা দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকিয়ে দিত। আবার ভারত থেকে ফেরত আসার সময় আমরা একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে পড়তাম। ভারতে যাতায়াতের এই চমৎকার সিস্টেমকে আমরা গর্দানি পাসপোর্টে যাতায়াত বলে অভিহিত করতাম। এই পাসপোর্টে আমরা সেই সময় অনেকবার ভারতে যাতায়াত করেছি।
তো সেবার ভারতে গিয়ে হিন্দি ছবি ‘শোলে’ দেখার পর আমাদের আফতাব হয়ে গেল অমিতাভ। মাথা ভর্তি চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে সে অমিতাভ বচ্চনের হাঁটা চলা রপ্ত করে ফেললো। বন্ধুদের মধ্যে সে তুলনামুলক লম্বা ছিল বলে আমরা তাকে খেতাব দিলাম ‘বাংলার অমিতাভ’। কেউ কেউ বলতো, ‘গরীবের অমিতাভ’।
কিন্তু এই খেতাবও সে বেশি দিন ধরে রাখতে পারলো না। আশির দশকে ‘ডিসকো ড্যান্সার’ ছবি দেখার পর সে নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীর অনুকরণে কানের ওপর থেকে দুই চিপ চেঁছে উধাও করে দিল এবং শীত গ্রীষ্ম সব মৌসুমে গলায় মাফলার জড়িয়ে চলাফেরা করতে লাগলো।

বিয়ে করার পর বউয়ের গুঁতো খেয়ে সে মাফলার খুলে ফেললো বটে, কিন্তু তার চুলের মিঠুন কাট থেকে গেল। ১৯৮৫ সালের দিকে সে তার বন বিভাগের চাকরিতে বদলী হয়ে চলে গেল বান্দরবান। ঈদ পালা পার্বণে বাড়ি এলে দেখতাম, তার চুলে আর মিঠুন কাট নেই। পরিবর্তে নতুন ফ্যাশন ডাই। চুলের এখানে কালো, ওখানে লাল, এমনকি হলদেটে সাদাও। তবে বয়সের কারণে তার মাথা ভর্তি চুল অনেকটাই পাতলা হয়ে এসেছে।
এরপর গত বছর ঈদের সময় দেখা হলো আফতাবের সাথে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম, ওর চুলে কোন ফ্যাশন নেই। মাথায় চুলই নেই তো ফ্যাশন হবে কোত্থেকে? ওর বউয়ের কাছে শুনলাম, কিছুদিন সে নাকি উইগ (পরচুলা) পরে চলাফেরা করেছে। পরে ছেলেমেয়েদের ধমক খেয়ে উইগ খুলে ফেলেছে।

আফতাবের চা, পান, বিড়ি-সিগারেট কোন কিছুরই নেশা ছিল না। পোশাক আশাকেও সে যে খুব ধোপ দুরস্ত ছিল, এমন নয়। তার একটাই শখ ছিল চুলের ফ্যাশন করা। শেষ বয়সে এসে চুলের অভাবে তার সেই শখটাও গেল। এই কারণেই কী না জানিনা, চুলকে বলা হয় মীর জাফর। বুড়ো বয়সে, যখন মাথায় রোদ বৃষ্টি সহ্য হয়না, তখনই নাকি সে ফাঁকি দিয়ে পালায়। সারা জীবন তার যত্ন আত্যির কথা একটুও মনে রাখে না।
রচনাঃ ২৩/০৮/২০১৩
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪২
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×