পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা কথা বলতে পারে না। তারা নানা রকম হাঁক ডাক ও ভাব ভঙ্গির মাধ্যমে একে অন্যের সাথে অর্থপূর্ণ ভাব বিনিময় করতে পারে। অবশ্য এক প্রজাতির প্রাণী অন্য প্রজাতির প্রাণীর সাথে এরকম ভাব বিনিময় করতে পারে কী না, জীববিজ্ঞান পড়িনি বলে সেটা আমার জানা নেই। তো এ রকম দুটি প্রাণী ছাগল ও ভেড়া একদিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো, ‘হে ঈশ্বর তুমি আমাদের কথা বলার ক্ষমতা দাও।’ ঈশ্বর তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। দেখা গেল, ছাগলদের সাথে ভেড়ারা কথা বলছে।
ভেড়া / গুড মর্নিং ছাগলদা। কেমন আছো?
ছাগল / মর্নিং। আছি রে না থাকার মতো।
ভেড়া / কী বলছো ছাগলদা? তোমরা ভালো না থাকলে আমাদের অবস্থাটা কী একবার ভাবো তো।
ছাগল / কেন, তোদের আবার কী হলো?
ভেড়া / আগে তো মানুষ আমাদের খুব একটা জবাই করতো না। এখন আমরাই বেশি জবাই হচ্ছি। আমাদের মাংসকে তোমাদের মাংস বলে খদ্দেরের কাছে চালিয়ে দিচ্ছে কসাইরা। আর বেকুব মানুষগুলো আমাদের মাংস বিশ ত্রিশ টাকা কম দামে পেয়ে তোমাদের মাংস ভেবে হাড় হাড্ডি পর্যন্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে। আমরা ভালো থাকবো কী করে বলো?
ছাগল / আরে ব্যাটা আহাম্মক, জবাই হওয়াটা তো খারাপ কিছু না। বিনা হিসাবে বেহেশতে চলে যেতে পারবি। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দ্যাখ! মাঠ ময়দান বলে কিছু কী আর আছে? বাড়ি ঘর তুলে মানুষ আমাদের চরে ফিরে খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। কুকুরের মতো এঁঠো ঝুটো খেয়ে কোনরকমে বেঁচে আছি। একে কী বেঁচে থাকা বলে, তুইই বল?
ভেড়া / আমাদেরও তো একই অবস্থা ছাগলদা। আমাদের সন্তানরা অপুষ্টিতে ভুগছে। ভিটামিনের অভাবে রাতকানা হয়ে যাচ্ছে। শুনেছি, মানুষরা নাকি এ ব্যাপারে একটা তদন্ত কমিটি করেছে।
ছাগল / ব্যা ব্যা ব্যা (অর্থাৎ হাঃ হাঃ হাঃ)। আসলে তোর বুদ্ধি সুদ্ধি আমাদের হাইব্রিড দাদা রামছাগলের চেয়েও কম। মানুষের তদন্ত কমিটির কাজ হলো ধামাচাপা দেওয়া। এতদিন মানুষের সাথে থেকেও সেটা বুঝিসনি? বেকুব কোথাকার!
ভেড়া / তাহলে আমাদের কী হবে ছাগলদা?
ছাগল / কী আর হবে? ঝাড়ে বংশে সাফ।
ভেড়া / সর্বনাশ!
ছাগল / এতে তুই সর্বনাশের কী দেখলি? স্বর্গে গিয়ে প্রাণভরে চরে ফিরে খেতে পারবি। সেখানে তো আর ঘাস বিচালির অভাব নাই। আর এই বদমাশ মানুষগুলো নরকের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরবে।
ভেড়া / আচ্ছা ছাগলদা, স্বর্গ নরক বলে সত্যিই কিছু আছে আসমানে?
ছাগল / কেন থাকবে না? ওদের পেট ভরানোর জন্য যখন তখন আমাদের জবাই করে ওরা খেয়ে ফেলছে, অথচ মরার আগে আমরা পেট পুরে দুটো ঘাস বিচালিও খেতে পাচ্ছিনা। এই অন্যায়ের কী বিচার হবে না ভাবছিস? অবশ্যই হবে।
ভেড়া / কী করে হবে দাদা? ওদের মতো আমাদের তো আর জজকোর্ট হাইকোর্ট নাই। বিচার করবে কে?
ছাগল / ভু রু রু রু (অর্থাৎ উঁ হু হু হু)। তুই তো দেখছি আবার বেলাইনে চলে গেলি! আরে বোকা, আমি কী এই দুনিয়ায় বিচারের কথা বলছি? এখানে তো ওরা নিজেদের হত্যাকাণ্ডের বিচারই করতে পারে না। আমাদেরটা করবে কীভাবে? শোন্, ওদের মানবাধিকার কমিশনের মতো একটা ছাগলাধিকার কমিশনের দাবি পেশ করার কথা আমরা একবার ভেবেছিলাম। কিন্তু জানিস তো, ওদের মানবাধিকার কমিশনে ঢাল নেই তলোয়ার নেই এমন একজন গোঁফওয়ালা নিধিরাম সর্দার আছে। তার কথা কে শুনছে বল্? আমাদের ছাগলাধিকার কমিশনেও যদি অমন একজন সর্দারকে বসিয়ে দেয় তো কী লাভ হবে? তাই ওই দাবি থেকে আমরা সরে এসেছি। যে সর্দারের বিষ নেই, শুধু কুলোপানা চক্কর, সে আমাদের কী উপকার করবে বল্? আজ ওরা আমাদের জবাই করে খাচ্ছে, খাক। বিচার একদিন হবেই।
ভেড়া / মানুষ তো সবই খেয়ে ফেলছে দাদা! আগে আমাদের নাড়ীভুঁড়ি ফেলে দিত, এখন তাও খাচ্ছে। টাকা পয়সা, জমি জমা, খাল বিল, নদী নালা সবই খাচ্ছে ওরা।
ছাগল / মানুষ নিজেরাই নিজেদের খেয়ে ফেলছে সেটা দেখিসনি?
ভেড়া / কেন দেখবো না? গুম খুন ক্রসফায়ার ব্রাশফায়ার এসব করে ওরা নিজেরাই নিজেদের খেয়ে ফেলছে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
ছাগল / তাহলে মানুষ জাতটা কী বুঝতেই পারছিস। ওরা দলাদলি করে দেদার লুটে পুটে খাচ্ছে। দলছুট লুটেরারা ঘর ভাড়া নিয়ে বা নিজের বাড়ির সামনে রঙ বেরঙের সাইনবোর্ড টানিয়ে গালভরা নামের নতুন দল তৈরি করে লুটপাটের সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। তাই এরা পুরনো দলের সাথে জোট করে সুরেলা গলায় গাইছে, ‘মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কী প্রেম দেব না?’
ভেড়া / ছাগলদা, তুমি তো অনেক খবর রাখো দেখছি।
ছাগল / তুই আসলেই একটা আহাম্মক। আমি খবর রাখবো কী করে? খবরের কাগজ দেখলে আমি তো ক্ষিধের জ্বালায় পাতা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলি। আমার খোঁয়াড়ে টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিচ্ছু নাই। একটা মোবাইল ফোন পর্যন্ত নাই।
ভেড়া / তাহলে এত সব তুমি জানলে কী করে?
ছাগল / (ভেড়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে) আরে বুদ্ধু, ভোটের আগে এই লোকগুলো যখন আমার মালিকের কাছে ভোট চাইতে আসে, তখন আমি মালিকের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করে সব জেনে যাই। ওরা নিজেরাই একে অন্যের হাঁড়ির খবর আমার মালিকের কাছে ফাঁস করে দেয়। কে কত টাকা পাচার করেছে, বিদেশে কার ক’টা বাড়ি আছে, কার ক’টা গাড়ি আছে, কে কত খাস জমি লুটে খেয়েছে, ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে কে কে ফেরত দিচ্ছে না, কার বউয়ের কত ভরি গয়না আছে সব বলে দেয় ওরা। এভাবেই আমি সব জেনে যাই। বুঝলি?
ভেড়া / তুমি সত্যিই জিনিয়াস ছাগলদা। নজরদারির কাজে গোয়েন্দা না লাগিয়ে যদি তোমাকে লাগানো হতো, তাহলে বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে যেতে পারতো না। আচ্ছা ছাগলদা, এত কিছু জেনেও মানুষ ওদের ভোট দেয় কেন?
ছাগল / ছ্যা ছ্যা ছ্যা (অর্থাৎ ছিঃ ছিঃ ছিঃ) তুই তো দেখছি শেয়ার বাজারে ফকির হয়ে যাওয়া লোকদের চেয়েও বোকা। আমাদের না হয় ছাগলিক অধিকার বলে কিছু নেই, কিন্তু ওদের নাগরিক অধিকার বলে একটা কথা আছে না? পাঁচ বছর পর পর এই অধিকার প্রয়োগ করার দিন ওরা ভোট প্রার্থীদের খায়-খাতির পেয়ে নিজেদের টিপু সুলতানের মতো নবাব নওয়াজি মনে করে। সেদিন সেজে গুজে ঈদের আনন্দ নিয়ে ওরা ভোট দিতে যায় আর টিপু সুলতানের মতো মনে করে একশো বছর শেয়ালের মতো বাঁচার চেয়ে একদিন সিংহের মতো বাঁচা ভালো। একদিনের জন্য রাজা বাদশা হওয়ার যে কী সুখ, তুই ভেড়া হয়ে তার কী বুঝবি?
ভেড়া / ব্র্যা ব্র্যা ব্র্যা (অর্থাৎ বাহ্ বাহ্ বাহ্) বাঁকি চার বছর তিনশো চৌষট্টি দিন ওরা যে দস্তুরমতো প্যাঁদানি খায়, সেটা বেমালুম ভুলে যায়?
ছাগল / হাঁ যায়। ওই যে ‘মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কী...............।’
ভেড়া / চেপে যাও ছাগলদা। কসাই আসছে।
********************************************************************************************
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ২:১২