ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কিছু বই ও পত্র পত্রিকা দেখেছি, যা আজকাল আর দেখা যায় না। যেমন, মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’, নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা’, লোকনাথ পঞ্জিকা, খাবনামা, বেহেশতি জেওর ও মেয়েদের পত্রিকা ‘বেগম’। এ ছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক তো ছিলই।
আমাদের বাড়িতে যে খাবনামা ছিল, সেটির নাম ছিল ‘সহি বড় খাবনামা’। ‘বড়’ শব্দের অর্থ বুঝতাম, কিন্তু ‘সহি’ ও ‘খাবনামা’ শব্দের অর্থ ঠিকমতো বুঝতাম না। পরে একটু উঁচু ক্লাসে উঠার পর জানতে পারলাম যে, ‘সহি’ শব্দের অর্থ শুদ্ধ বা সঠিক। আর ‘খাবনামা’ হলো ‘খোয়াবনামার’ সংক্ষেপিত রূপ। খোয়াব মানে স্বপ্ন আর খোয়াবনামা মানে স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
তো এই খোয়াবনামা বা খাবনামা প্রধানতঃ রেলস্টেশনের বুক স্টল, ফুটপাথ ও কোর্ট কাচারির বটতলায় বিক্রি হতে দেখা যেতো। আমাদের পিতা যেহেতু একজন উকিল ছিলেন, সেহেতু তাঁর বাসায় যে একখানা খাবনামা থাকবে, এটা আর বিচিত্র কী?
আমার মা ও ছোটখালা (আমাদের বাসায় থেকে পড়াশুনা করতেন) বিষাদ সিন্ধু ও আনোয়ারা পড়ে প্রায়ই চোখের পানি ফেলতেন। এই দুটি বই অসংখ্যবার পড়ে তাদের দু’জনের প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চোখের পানি ফেলার মতো আর কোন বই বাসায় না থাকায় তাঁরা ঘুরে ফিরে এই বই দুটোই পড়তেন। অবশ্য তাঁরা নিয়মিত ‘বেগম’ পত্রিকাও পড়তেন আর মাঝে মাঝে মনোযোগ দিয়ে খাবনামা ও বেহেশতি জেওরের পাতা উল্টাতেন। মা বা খালার হাতে খাবনামা দেখলে আমরা বুঝতে পারতাম যে, তাঁরা রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন। আব্বা নিয়মিত ইত্তেফাক পড়তেন আর মাঝে মধ্যে পঞ্জিকার পাতা উল্টে দেখতেন। তিনি ভুলেও কোনদিন মা-খালাদের বইগুলো ছুঁয়ে দেখতেন না।
আর আমরা? আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে বড় তিনজন পড়তাম দস্যু মোহন, দস্যু বাহরাম আর দস্যু বনহুর। তখন এই তিন দস্যু আর স্বপনকুমারের লেখা আট আনা দামের ডিটেকটিভ সিরিজের চটি বইগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে এই বইগুলো আমাদেরকে পড়তে হতো খুব গোপনে। স্কুলের পাঠ্যবই দিয়ে ঢেকে পড়তে হতো অথবা লুকিয়ে বাথরুমে নিয়ে যেতে হতো। মা টের পেলে পাঠ্যবই বাদ দিয়ে গল্পের বই পড়ার অপরাধে আমাদের এই তিনজনকে জবরদস্ত ধোলাই খেতে হতো। কখনো কখনো এই বইগুলো দিয়েই মা চুলা ধরানোর কাজ সেরে ফেলতেন। আর আব্বা টের পেলে অবধারিতভাবে আমাদের একবেলা উপোষ থাকতে হতো। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল পেটের মার দুনিয়ার বার। পেটে মারলে ভুতে ধরা রোগীর ভুত ছুটে যায়।
যাই হোক, খাবনামা প্রসঙ্গে আসি। এই বইটিতে স্বপ্নের যেসব ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল, তা’ ছিল একেবারেই উদ্ভট ও হাস্যকর। তারপরেও মানুষ ছাপানো কথার ওপর বিশ্বাসের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে এই বইগুলো কিনতো। যারা পড়তো, তারা কেউ বিশ্বাস করতো কেউ করতো না। আবার কেউ আংশিক বিশ্বাস করতো। আমাদের বাসায় থাকা খাবনামাসহ অন্যান্য বই ও পত্র পত্রিকার প্রতি আমাদের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। তবে বড়ভাই মাঝে মধ্যে খাবনামার দু’এক পাতা পড়ে দেখতেন। তাঁর কারণেই একদিন খাবনামার প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কীভাবে, জানেন?
বড়ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল পাঁচ বছর। মাঝখানে আমাদের এক বোন। বড়ভাই পড়তেন একাদশ শ্রেনিতে আর আমি পড়তাম ষষ্ঠ শ্রেনিতে। এত ব্যবধান সত্ত্বেও বড়ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। মার্বেল খেলা ও ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা পর্যন্ত সব কিছুতেই আমরা দুই ভাই ছিলাম মানিকজোড়।
আমাদের বাড়ির পাশে একটা দোতলা বাড়ির নিচতলা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার’স ক্লাব। ওপর তলায় ছিল ডরমিটরি। সন্ধ্যে থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ক্লাব খোলা থাকতো। অফিসাররা এসে তাস, দাবা, টেবিল টেনিস (টি টি) খেলতেন। বাড়িটা ছিল চারদিকে অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। আমরা দু’ভাই খুব ভোরে প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে ক্লাবের টি টি খেলার বিশাল চওড়া বারান্দায় পড়ে থাকা ছোট ছোট সাদা বল (আমরা বলতাম পিংপং বল) কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। ক্লাবের দারোয়ান ও ডরমিটরির লোকজন সে সময় ঘুমিয়ে থাকতো বলে আমাদের এই অনধিকার প্রবেশ কেউ টের পেত না।
একদিন ভোরে আমার ঘুম ভাঙতে দেরি হচ্ছে দেখে বড়ভাই একাই পিংপং বল কুড়াতে গিয়ে বলের সাথে সাথে একটা চকচকে দশ টাকার নোট কুড়িয়ে পেলেন। তখনকার দিনে দশ টাকা মানে অনেক টাকা। বড়ভাই ভীষণ উত্তেজিত। দ্রুত বাসায় ফিরে এসে তিনি সাবধানে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে নোটটা দেখালেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বললেন, ‘জানিস! আজ রাতে আমি ঘুমের মধ্যে টাকা পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।’
আমি চোখ কচলে বললাম, ‘টাকা পাওয়ার স্বপ্ন কী রকম?’
বড়ভাই এদিক ওদিক দেখে নিয়ে গলার স্বর আরও খাদে নামিয়ে বললেন, ‘শোন্, আমাদের বাসায় যে খাবনামা আছে না তাতে লেখা আছে, নতুন পোশাক পরার স্বপ্ন দেখলে টাকা পাওয়া যায়। আমি আজ রাতে স্বপ্নে দেখলাম তুই আর আমি নতুন শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর সকালে উঠেই এই টাকাটা পেয়ে গেলাম।’
‘তাই? তাহলে আমিও দশ টাকা পাবো, তাই না ভাই?’
‘তুই পাবি কী করে?’
‘আপনি যে বললেন, আপনার সাথে সাথে আমিও নতুন শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি!’
‘হায় রে গর্দভ!’ বড়ভাই কপাল চাপড়ে বললেন, ‘স্বপ্নটা তো দেখেছি আমি! তাই আমি টাকা পেয়েছি। তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস? আমি স্বপ্নের কথা বললাম বলে না তুই জানতে পারলি!’
আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে ওঠা, নতুন শার্ট পরার স্বপ্ন, দশ টাকা পড়ে পাওয়া, বড়ভাইয়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর-সব মিলিয়ে একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার স্যাপার।
যাই হোক, আমার টাকা না পাওয়াটা কোন বিষয় না। বড়ভাইয়ের পাওয়া মানে আমারও পাওয়া। কিন্তু টাকাটা ফেরত না দিয়ে হাপিশ করে দেওয়া কী ঠিক হবে? টাকার মালিক কে, তা’ আমরা জানি না। ফেরত দেবই বা কাকে? বাড়ির দারোয়ান বা ডরমিটরির কাউকে ফেরত দিতে গেলে আমাদের প্রাচীর টপকে এ বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবে। তখন আরেক ঝামেলা হবে। দরকার নাই বাবা। সিদ্ধান্ত হলো, টাকাটা আমরা খরচ করবো।
ওহ্! সে একটা দিন গেছে! সারাদিন দুইভাই টো টো করে ঘুরে ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করছি। আইসক্রিম, চানাচুর, বাদাম, বাটা বিস্কুট, লাসসি, লজেন্স, টফি। দুই প্যাকেট নানা রঙের মার্বেল। জলছবির বই। দুপুরে হোটেলে ঢুকে খাসির মাংস দিয়ে ভাত। মিষ্টি পান আর দুইটা দামী সিগারেট কিনে দু’ভাই মিলে কাশতে কাশতে টান দেওয়া। আহা! পকেটে টাকা থাকলে কী শয়তানী বুদ্ধির অভাব হয়?
দুই ভাই চলে গেলাম ম্যাটিনি শো দেখতে। সেখানে কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে ব্ল্যাকে দশ আনার টিকিট বারো আনা দিয়ে কিনে আমরা দেখলাম ‘’খাইবার মেইল’’। নিলো-রতনকুমার। তখনকার উর্দু ছবির হিট নায়ক নায়িকা। এত খরচ করার পরেও সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফেরার পথে রিক্সায় বসে হিসাব করে দেখা গেল, চার আনা রিক্সা ভাড়া দেওয়ার পরে আমাদের হাতে থাকবে চৌদ্দ আনা তিন পাই।
সারাদিন বাইরে থাকার অপরাধে সেদিন মায়ের হাতে আমরা দু’ভাই নিখুঁতভাবে দুরমুশ হলাম। আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি করলেও বড়ভাই ‘উহ্’,‘আহ্’,‘মাগো’,‘বাবাগো’ ছাড়া বেশি কিছুর মধ্যে গেলেন না। হাজার হলেও অভিজ্ঞতা একটা ফ্যাক্টর!
এই ঘটনার পর থেকে খাবনামার ওপর আমার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। একদিন সবার অলক্ষ্যে আমি মায়ের ঘরের দেয়াল আলমারী থেকে বইখানা নামিয়ে নিজেদের ঘরে নিয়ে এলাম। এই ঘরে দুই পাশের দুটো চৌকিতে আমি আর বড়ভাই ঘুমাতাম। বিছানায় বসে খাবনামার পাতা উল্টে দেখতে গিয়ে বড়ভাইয়ের দেখা স্বপ্নের কথা মনে হলো। ‘নতুন পোশাক পরার স্বপ্ন দেখলে টাকা পাওয়া যায়’ কথাটা কোথায় লেখা আছে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও গেলাম। কিন্তু বড়ভাই যা বলেছিলেন, এখানে তা’ লেখা নাই। বরং লেখা আছে, ‘নতুন পোশাক পরার স্বপ্ন দেখিলে জানিবে মৃত্যু আসন্ন।’
আমার কিছুটা অস্বস্তি হলো। একটু ভয় ভয়ও করতে লাগলো। বড়ভাই কলেজ থেকে ফিরলে তাঁকে খাবনামার লেখাটা দেখিয়ে আমি শুকনা কণ্ঠে বললাম, ‘ভাই, আপনি তো নতুন পোশাক পরার স্বপ্ন দেখেননি তাই না? অন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন।’
লেখাটা পড়ে বড়ভাইয়ের কপাল ঘেমে গেছে। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, ‘হাঁ, বোধহয় তাই হবে।’
পরের একটা সপ্তাহ আমাদের দুই ভাইয়ের খুব আতংকের মধ্যে দিয়ে গেল। মৃত্যুভয়ে দু’জনে সব সময় সিঁটিয়ে থাকি। ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজের মধ্যে যাই না। পুকুরে গোসল করা, গাছে চড়া, ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানো (যদি ছাদ থেকে পড়ে যাই!), এবং এমনকি খেলাধুলাও বন্ধ। গলায় কাঁটা ফুটে যদি মরে যাই সেই ভয়ে আমরা কাঁটাওয়ালা মাছ খাই না। মা মুরগি জবাই করার কথা বললে বড়ভাই এটা ওটা বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। সে এক বিদঘুটে অবস্থা!
দুই ভাইয়ের এসব পরিবর্তন দেখে মায়ের সন্দেহ হলো। একদিন তিনি আমাদেরকে যৎসামান্য প্রাথমিক ধোলাই দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কী হয়েছে? বড়ভাই কিছু না বললেও আমি আরো বেশি মার খাওয়ার ভয়ে সব বলে দিলাম।
কিন্তু এতে ফল হলো উল্টো। মা এবার খালি হাতের পরিবর্তে উনুনের লাকড়ি এনে ধোলাই দেওয়া শুরু করলেন। আব্বা কোর্ট থেকে ফিরে মায়ের কাছে সব শুনে শোবার ঘর থেকে ‘সহি বড় খাবনামা’ এনে রান্নাঘরে জ্বলন্ত চুলার মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর তিনিও লাকড়ি হাতে আমাদের দু’ভাইকে ফিনিশিং টাচ দিয়ে বক বক করতে করতে চলে গেলেন।
এই ঘটনার পর থেকে আমাদের দুই ভাইয়ের আতংক অনেকটাই দূর হয়ে গেল। তবে সেটা ‘সহি বড় খাবনামা’ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কারণে, নাকি বাবা-মার হাতে স্পেশাল ধোলাই খাওয়ার কারণে, তা’ বলতে পারবো না।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
******************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০২