কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিবেশী জনৈক ব্যবসায়ী তার নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটা সুন্দর বাংলা নাম চান। বাংলা কবিতা লিখে নোবেল প্রাইজ পাওয়া কবিগুরুর চেয়ে এ কাজে উপযুক্ত ব্যক্তি আর কে আছে? ব্যবসায়ী কবিগুরুর শরণাপন্ন হলেন। কবিগুরু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি ব্যবসা,হে?’
‘আজ্ঞে, জুতোর দোকান।’
কবিগুরু একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, ‘দোকানের নাম দাও শ্রীচরণেষু।’
তাই হলো। জুতার দোকানের নাম হলো ‘শ্রীচরণেষু’।
ব্যবসার সাথে দোকানের নামের এমন চমৎকার সাদৃশ্যের কথা আমার বইয়ে পড়া। তবে চোখে দেখাও একটি আছে। এবং সেটি আমাদের এই শহরেই। দোকানের নাম ‘শেষ বিদায়’। সাইনবোর্ডে বাংলা নামের নিচে আরবী ও বাংলাতে লেখা ‘কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মওত। দুনিয়ার সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করিতে হইবে।’ মুসলমানদের মৃত্যু পরবর্তী দাফন কাফনের যাবতীয় সরঞ্জাম এই দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। কাফনের কাপড়, ফিতা, আগরবাতি, মোমবাতি, দিয়াশলাই, গোলাপজল, বাঁশের তৈরি মাচা, টুকরা করে কাটা বাঁশ, চাটাই, পলিথিন, কোদাল, বেলচা, সাবান, টিস্যু পেপার সবই পাওয়া যায়।
এই দোকানের মালিক আব্দুর রহমান। মাঝবয়সী পরহেজগার মানুষ। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, মুখে দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। আর একজন পরহেজগার লোককে কর্মচারী নিয়ে তিনি দোকান চালান। নানারকম ব্যবসা করে লোকসান দিয়ে শেষে আব্দুর রহমান বুদ্ধি করে এই ব্যবসা খুলেছেন। শহরে এমন দোকান আর দ্বিতীয়টি নেই। দোকানের বেঁচাকেনার নিয়ম কানুন আর পাঁচটা দোকানের মতো নয়। প্রতিটি দ্রব্যের নির্ধারিত দাম। দ্রব্যটির গায়ে সাঁটানো কাগজে দাম লেখা থাকে। যেমন- কাফনের কাপড়ঃ ঢাকা হইতে ক্রয়মূল্য ২৮০/-টাকা, পরিবহন ও কুলি খরচ ৮/৬০টাকা, কাপড় কাটা ও ফিতা তৈরির দর্জি খরচ ১০/-টাকা, প্যাকিং খরচ ৩/৪০টাকা, সর্বমোট ৩০২/-টাকা। ৫% হারে মুনাফাসহ বিক্রয়মূল্য ৩১৭/১০টাকা। ০/১০টাকা ছাড়ে চূড়ান্ত বিক্রয়মূল্য ৩১৭/-টাকা।
দোকানের এসব নিয়ম কানুন মেনে চলার ব্যাপারে আব্দুর রহমান খুব সচেতন লোক। তার কাছে পান থেকে চুন খসানোর উপায় নেই। কোন আইটেমেই তিনি পাঁচ শতাংশের বেশি লাভ করেন না। তাই দর কষাকষির কোন সুযোগ নেই। তবে কাস্টোমারের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ও তার কর্মচারী খুবই আন্তরিক। তাদের কোন কথা বা ব্যবহারে কাস্টোমার যাতে কষ্ট না পায়, সেদিকে তাদের কড়া নজর থাকে। বিশেষ করে এসব পন্য যারা কিনতে আসে, তাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় আব্দুর রহমান ও তার কর্মচারীকে কথাবার্তা ও আচার আচরনে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হয়। পন্য বিক্রি ছাড়াও আব্দুর রহমান ক্রেতাদের নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। যেমন, গোরখোদকের প্রয়োজন হলে তার মোবাইল নম্বর সরবরাহ করা অথবা নিজে সরাসরি কথা বলে ব্যবস্থা করে দেওয়া। কর্মচারীকে সিটি কর্পোরেশনে পাঠিয়ে কবরের জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে রসিদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা। গোরস্থানের তত্ত্বাবধায়ককে ফোন করে কবরের জন্য ভালো জায়গার অনুরোধ করা। ব্যবসায়ীকপ্রয়োজনে এসব লোকজনের সাথে আব্দুর রহমানকে সুসম্পর্ক রেখে চলতে হয়। আর আব্দুর রহমানের অমায়িক ব্যবহারের কারণে তারাও তার কথা ফেলতে পারে না।
তবে আশ্চর্য হলো, এতো কিছুর পরেও আব্দুর রহমানকে তার মহল্লার লোকজন এড়িয়ে চলে। তাদের ধারনা, আব্দুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া শুভ লক্ষণ নয়। এমন ধারনার অবশ্য কিছু ভিত্তি আছে। কিছু কাকতালীয় ঘটনা তাদের মনে আব্দুর রহমান সম্পর্কে এমন বিরূপ ধারনার জন্ম দিয়েছে। যেমন- আব্দুর রহমানের দোকানে বসে গল্পগুজব করে সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক আমানউল্লাহ বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। তাঁকে হাসপাতালে নিতে নিতে সব শেষ। আমানউল্লাহ মোটাসোটা বয়স্ক মানুষ। তাঁর ব্যাপারটা না হয় স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু ইউনুস আলির ব্যাপারটাকে কি বলবেন? ইলেকট্রিক মালামালের দোকানদার চল্লিশ বছর বয়সী ইউনুস আলি এক শুক্রবার মসজিদে আব্দুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে পরের শুক্রবার সকাল দশটায় হাসপাতালে ভর্তি হলো। পেটে তীব্র ব্যথা। এ্যাপেনডিক্স ফেটে ঐ দিন দুপুরেই সে মারা গেল। ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে অপারেশন করার সুযোগ পেলেন না। এই ঘটনার পর মসজিদে আব্দুর রহমানের পাশে কেউ দাঁড়াতে চায় না। তিনি মসজিদে না এলে বরং মুসল্লিরা আরো খুশি হয়। ফিরোজ ইকবাল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ছটফটে হাসিখুশি তরুণ। কোম্পানি থেকে সে নতুন মোটর সাইকেল পেয়েছে। সেটি চালিয়ে সে অফিসে যাওয়ার সময় কি মনে করে ‘শেষ বিদায়’এর সামনে একটু থামলো। আব্দুর রহমানকে সালাম দিয়ে বললো, ‘চাচা, এটা কোম্পানি থেকে পেলাম।’
‘তাই নাকি?’ আব্দুর রহমান খুশি হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো হয়েছে,বাবা। তোমার দূর দূরান্তে যাতায়াতের খুব সুবিধা হলো।’
‘জি, চাচা। দোয়া করবেন।’
লোকে বলে, আব্দুর রহমান দোয়ার বদলে বদদোয়া করেছিলেন। সেদিন বিকেলেই মোটর সাইকেল নিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে ফিরোজ মারা গেল। স্পট ডেড।
মহল্লার গৃহবধূরা বলে, যত মানুষ মরবে, আব্দুর রহমানের তত লাভ। এই লোক সাক্ষাৎ আজরাইল। এর সাথে কথা বলা তো দূরে থাক, দেখা হলেও বিপদ আছে। আত্মীয়স্বজনরাও তাকে এড়িয়ে চলে। বিয়ে শাদি, শালিস বৈঠক কোথাও তাকে ডাকা হয় না। ভোটের সময় ভোট চাইতে কেউ তার বাড়ি যায় না। চেনা জানা ভিক্ষুকরাও তার বাড়ি এড়িয়ে চলে।
আব্দুর রহমানের বউ ছেলেমেয়েরা এই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করে। আব্দুর রহমান বলেন, ‘ব্যবসা ছেড়ে দিলে তোমাদের খাওয়াবো কি?’
‘অন্য ব্যবসা করো।’
‘অন্য ব্যবসার হাল তো দেখলে! ঠিকাদারি করতে গিয়ে বাপ দাদার রেখে যাওয়া জমি জমা তো সব গেল। পোলট্রি খামার করে নগদ টাকা যা ছিল তা’ তো গেলই, মানুষের কাছেও দেনা হয়ে গেলাম। খড়ির আড়ত করে লোকসান হলো। পাড়ার লোকজন বাঁকি খেয়ে আমার মুদিখানায় লাল বাতি জ্বালিয়ে দিল। এখন আমি কি করবো,বলো?’
বউ হাত জোড় করে অনুরোধ করে, ‘আল্লার দোহাই লাগে। এই ব্যবসা তুমি ছেড়ে দাও। তোমার জন্য তোমার ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত পাড়ায় একঘরে হয়ে গেছে। আমিও কারো সাথে মিশতে পারি না। দরকার হলে আমরা একবেলা খাবো, একবেলা খাবো না।’
‘আরে পাগল, সেই একবেলার খাবারই বা আসবে কোত্থেকে?’
আব্দুর রহমান বউ ছেলেমেয়েকে বোঝাতে পারেন না। এই ব্যবসা করে পেটের ভাতটা অন্ততঃ হচ্ছে। ছেড়ে দিলে কি হবে, সে চিন্তায় তার মাথা ঘোরে। তার তিন মেয়ের বড়টির বিয়ে ঠিক হলো দূরের এক গ্রামে। ছেলে সৌদি আরব থাকে। বিস্তর কাঁচা পয়সা রোজগার করে। দেশে তার বৃদ্ধা মা আর এক বিধবা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে করে সে বউকে সৌদি আরবে নিয়ে যেতে চায়। আব্দুর রহমান ঘটককে আগাম কিছু টাকা দিয়ে খুশি করলেন। কিন্তু সেই বিয়ে হলো না। ছেলে দেশে আসার এক সপ্তাহ আগে রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেল।
আব্দুর রহমান দোকানের সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলে নতুন সাইনবোর্ড লাগালেন। ‘রহমান এন্টারপ্রাইজ।’ ভুষিমালের দোকান। খেসারি, মসুর, ছোলা ও গমের ভুষির সাথে সরিষা, তিল, তিসি ও মসিনার খৈল বিক্রির ব্যবসা। কিন্তু খদ্দের আসে না। রাস্তার ওপাশে নিবারন দাসের ভুষিমালের দোকানে সারাদিন ভিড়, অথচ আব্দুর রহমানের দোকান ফাঁকা। কর্মচারীকে দু’মাস বসিয়ে বেতন দেওয়ার পর তাকে ছাঁটাই করে তিনি একাই দোকান চালাতে লাগলেন। এভাবে কয়েক মাস পুঁজি ভাঙ্গিয়ে চলতে চলতে যখন তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল, তখন তিনি আবার ব্যবসা পরিবর্তন করলেন। দোকানের সাইনবোর্ড ঠিকই থাকলো, কিন্তু এবার খাতা, কাগজ, কলম, পেনসিল এসবের ব্যবসা। ‘রহমান এন্টারপ্রাইজের’ কাছাকাছি কিছু স্কুল কলেজ আছে। অনেক ছাত্র ছাত্রী তার দোকানের সামনে দিয়ে যায়। এবার নিশ্চয় ব্যবসা হবে। আব্দুর রহমান আশায় বুক বাঁধলেন।
কিন্তু পনের দিনেও একটা খাতা বা এক দিস্তা কাগজ বিক্রি হলো না। আব্দুর রহমান সারাদিন খদ্দেরের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। চার মাসে তিনটা খাতা, এক দিস্তা কাগজ আর দুটো বল পেন বিক্রি হলো। মুনাফা হলো সাড়ে সাত টাকা। আব্দুর রহমান তবু দোকান খুলে বসে থাকেন। ইদানিং আর শুধু বসে থাকেন না, দোকানের কাগজ ও খাতায় নিবিষ্টচিত্তে লেখালেখি করেন। কি লেখেন, কেউ জানে না। কারো জানারও আগ্রহ নেই।
অগ্রহায়ন মাস শেষ হয়ে পৌষ মাস এলো। আব্দুর রহমান রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় গায়ে চাদর জড়িয়েও ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে যান। মাঘ মাসে গায়ে চাদর জড়িয়ে কান ঢাকা উলের টুপি পরে সকালে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে দোকানে যান। বেঁচাকেনা নেই। তবু দোকান খুলে তিনি জবুথুবু হয়ে বসে থাকেন। খুব শীত। ঠাণ্ডায় হাত পা থর থর করে কাঁপে। আজ ক’দিন থেকে সকালে বাড়িতে নাস্তা হয় না। এক কাপ গরম চা খেতে পেলেও ভালো হতো। কিন্তু চা খাওয়া হয় না। দোকানের ভাড়া বকেয়া পড়ায় মালিক দোকান ছেড়ে দিতে বলেছে। কয়েক মাস বিদ্যুৎ বিল না দেয়ায় পিডিবির লোক এসে সংযোগ কেটে দিয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যের আগে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে হবে। ঘরে চাল না থাকায় দুপুরের আগে চাল নিয়ে বাড়ি ফেরার তাগিদ আছে। কিন্তু তা’ বোধহয় আর হবে না।
আব্দুর রহমান দোকানের তাক থেকে খাতা কলম নামিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখতে থাকেন। মাথা নিচু করে বিরামহীন শুধু লিখেই চলেন তিনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যের আঁধার নেমে এলে তার লেখালেখি বন্ধ হয়। দোকানের সাটারিংপাল্লা টেনে নামিয়ে তালা লাগিয়ে আব্দুর রহমান হাঁপিয়ে ওঠেন। দোকানের বারান্দায় বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে তিনি ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন। তার হাত পা ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসে। শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে আপাদমস্তক চাদর জড়িয়ে হাঁটতে থাকেন তিনি। বুকের ভেতর দুর্বল হৃৎপিণ্ডটা তখনো ধুক ধুক করে জানান দিচ্ছে যে, আব্দুর রহমান বেঁচে আছেন।
এক সপ্তাহ পর আব্দুর রহমানের ছেলে ও আশেপাশের দোকানদারদের সাক্ষী রেখে দোকান মালিক তালা ভেঙ্গে ‘রহমান এন্টারপ্রাইজ’ খুললেন। দেখা গেল, দোকানের কাগজ, কলম, খাতা, পেনসিল সব মেঝের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। খাতা ও কাগজে অসংখ্যবার শুধু একটা কথাই লেখাঃ কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মওত। দুনিয়ার সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করিতে হইবে।
(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)
*********************** *******************************************************************
গল্পটি পূর্বে প্রকাশিত। স্বল্প পঠিত হওয়ায় পুনরায় পোস্ট দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৪