আমাদের স্কুল জীবনে এখনকার মতো প্রাইভেট টিচার বা কোচিং ছিলনা। তবে স্কুলের বাইরে পড়ালেখার জন্য লজিং (জায়গীর) মাস্টারের ব্যবস্থা ছিল। গ্রাম থেকে শহরে আই,এ, বি,এ পড়তে আসা ছেলেরা থাকা খাওয়ার বিনিময়ে গৃহকর্তার ছেলেমেয়েকে পড়াতো। তখনকার দিনে শহর এলাকায় ছাত্রাবাস বা মেস টেস তেমন ছিলনা। তাছাড়া গ্রাম থেকে শহরে আসা এসব ছেলেরা প্রধানতঃ অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিল। লজিং প্রথার কারণে দু’পক্ষেরই উপকার হতো।
আমরা পাঁচ ভাই এক বোন সবাই স্কুল জীবনটা লজিং মাস্টারের কাছে পড়েই পার করেছি। এই লজিং মাস্টারের জোগান আসতো আমাদের নানাবাড়ি বা তার আশেপাশের গ্রাম থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো, লজিং মাস্টার আমার মায়ের মামাতো বোনের ছেলে বা ফুপাতো বোনের দেবর বা আরো একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়। দু’চার বছর শহরে থেকে পড়াশুনা করে একজন লজিং মাস্টার চলে গেলে আর একজন আসতো। এভাবে শহীদুল, দুলাল, খালেক, আনোয়ার ইত্যাদি নামের বেশ কয়েকজন লজিং মাস্টারের কাছে আমরা পড়েছি। আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুসারে আমরা তাদের ভাই বা মামা বলে ডাকতাম।
তো আজ খালেক ভাইয়ের কথা বলি। আমাদের বাড়ির সামনের দিকে বৈঠকঘরের পাশে আট হাত বাই পাঁচ হাত একটা ছোট্ট ঘর ছিল। লজিং মাস্টার এই ঘরে থাকতেন। আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। আমার অন্যান্য ভাই বোন স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। সন্ধ্যের পর আমাদের শোবার ঘরের সামনে চওড়া বারান্দায় দু’খানা জোড়া চৌকির ওপর মাদুর বিছিয়ে আমরা সব ভাইবোন হারিকেনের আলোয় গোল হয়ে পড়তে বসতাম। খালেক ভাই একটা কাঠের চেয়ারে বসে আমাদের পড়াশুনা তদারকি করতেন। তিনি ছোটোখাটো গড়নের নিরীহ মানুষ। আগের লজিং মাস্টার দুলাল ভাইয়ের মতো তিনি আমাদের ওপর হম্বি তম্বি করতেন না। পড়া না পারলে বা অংক ভুল করলে শহীদুল ভাইয়ের মতো কানমলা দিতেন না। এ কারণে লজিং মাস্টারদের মধ্যে খালেক ভাই আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের মায়ের কাছে ছিলেন অযোগ্য মাস্টার। মা প্রায়ই রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলতেন, ‘খালেক, চড় দাও, চড় দাও। কষে চড় না দিলে গাধাগুলো সোজা হবে না।’
খালেক ভাই থতমত খেয়ে আমাদের কোন ভাইয়ের গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলতেন, ‘চড় দিলাম,খালাম্মা।’
‘কী চড় দিলে তুমি?’ মা খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলতেন, ‘চড়ের কোন শব্দই পেলাম না। ঠাস্ ঠাস্ করে দুই গালে কষে দুটো চড় দাও। দেখবে সোজা হয়ে গেছে।’
‘দিচ্ছি,খালাম্মা।’
মা রান্নাঘরে ঢুকে গেলে খালেক ভাই নিজের দুই গালে শব্দ করে দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘দু’গালে চড় দিলাম,খালাম্মা।’ মা রান্নাঘর থেকে বলতেন, ‘হাঁ, ঠিক আছে।’
এদিকে আমরা খালেক ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হেসে লুটোপুটি। মা চিৎকার করে বলতেন, ‘খালেক, সব ক’টা বদকে থাপড়াও তো! একটা মার খেয়েছে দেখে আরগুলোর কী দাঁত কেলানো হাসি! থাপড়ে দাঁত কেলানো ছুটিয়ে দাও। বদের বিচি সব!’
সারাদিন স্কুল আর বিকেলবেলা ফুটবল খেলা। আমরা ক্লান্ত হয়ে থাকতাম। ফলে সন্ধ্যের পর ঘুমে চোখ ঢুলে আসতো। তবে মায়ের ভয়ে দ্রুত ঘুম সামলে নিয়ে চোখ রগড়ে আরও জোরে জোরে পড়া শুরু করে দিতাম। পড়ার আওয়াজ কমে যাওয়া এবং হঠাৎ করে আবার বেড়ে যাওয়া শুনে মা রান্নাঘর থেকেই বুঝে ফেলতেন যে, আমরা ঝিমাচ্ছি। তিনি চিৎকার করে বলতেন, ‘খালেক, তুমি কী করছো? বদমাশ গুলো ঘুমাচ্ছে।’
‘আঁ হাঁ!’ খালেক ভাই নিজেও ঘুমকাতুরে মানুষ। মায়ের চিৎকার শুনে তিনিও ঝিমুনিভাব ঝেড়ে ফেলে মিনমিনে গলায় বলতেন, ‘এ্যাই, ঘুমাচ্ছো কেন? পড়, পড়।’
‘আমি ঘুমাচ্ছি না’
‘তাহলে কে ঘুমাচ্ছে?’
দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য মা হয়তো রান্নাঘর থেকে বেরতে পারছেন না। তিনি সেখান থেকে চিৎকার করে বলতেন, ‘ও খালেক, কাঠের স্কেলটা হাতে রাখো বাবা। ঘুমাতে দেখলে পিঠের ওপর দাও।’
খালেক ভাই স্কেল হাতে নিতেন ঠিকই, কিন্তু দু’ মিনিট পর তাঁর হাত থেকে স্কেল পড়ে যেত। কারণ এই সময়ের মধ্যে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে কাত হয়ে তিনি নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন। মা রান্নাঘরের কাজ সেরে এসে দেখতেন, আমরা সবাই গলা ফাটিয়ে পড়ছি আর খালেক ভাই চেয়ারে আধা শোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছেন।
এই খালেক ভাইকে একদিন দেখলাম তাঁর ঘরে বিছানায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। কান্নার কোন আওয়াজ নাই, কিন্তু দু’চোখ থেকে অনর্গল পানি ঝরে পড়ছে। আমার সাথে সাথে আব্বাও এই দৃশ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে খালেক? কাঁদছো কেন?’
খালেক ভাই নিরুত্তর। আব্বা বাড়ির ভেতরে ঢুকে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খালেকের কী হয়েছে? কাঁদছে কেন?’
‘আর বোলো না।’ মা হতাশ গলায় বললেন, ‘বাবলু(আমার ছোট ভাই)স্কুল থেকে ফিরে ভাত না খেয়ে রোদের মধ্যে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। বার বার ডেকে ওকে ছাদ থেকে নামাতে না পেরে আমি ছাদে উঠে ওকে ক’টা চড় থাপড় দিয়েছি। তাই দেখে খালেক কেঁদে অস্থির। বাবলুর চোখে এক ফোঁটা পানি নাই, ওদিকে খালেকের কান্না থামছে না। কী মুশকিল দেখো তো!’
আমার অন্য একটি লেখায় পাঠকদের জানিয়েছি যে, স্কুলে পড়ার সময় আমি চোর ছিলাম। ছোটবেলা থেকে বাজার করা শেখানোর জন্য মাঝে মাঝে আমাকে আর বড়ভাইকে বাজার করতে দেওয়া হতো। আমি বাজারের পয়সা থেকে আট আনা বারো আনা চুরি করে লুকিয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যেতাম। বাজার করে ফিরলে মা সাধারনতঃ হিসাব নিতেন না। কিন্তু চোরের দশ দিন, পুলিশের এক দিন। এ রকম এক দিনে আমি মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। তিন টাকার মধ্যে মাছ ও তরি তরকারি কিনে মায়ের হাতে মাত্র চার আনা ফেরত দিলে তাঁর সন্দেহ হলো। তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসে একটা একটা করে জিনিষের নাম ও দাম লিখে যোগ দিলেন। দেখা গেল, সব মিলিয়ে সোয়া দুই টাকা খরচ হয়েছে। তাহলে বারো আনা ফেরত পাওয়ার কথা। বাঁকি আট আনা গেল কোথায়? মা রান্নাঘর থেকে একটা লাকড়ি এনে আমার পিঠে সবে এক ঘা দিয়েছেন, খালেক ভাই ছুটে এসে মায়ের হাত চেপে ধরে আর্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ওর দোষ নেই,খালাম্মা। ছোট ছেলে তো! বাসায় ঢোকার সময় ওর পকেট থেকে আট আনা পড়ে গেছে। বুঝতে পারেনি। এই দেখেন, বৈঠকঘরের চৌকাঠের সামনে পড়ে ছিল।’
খালেক ভাই একটা চকচকে আধুলি(আট আনা)মায়ের হাতে তুলে দিয়ে আমাকে তাঁর শরীর দিয়ে ঢেকে দূরে নিয়ে গেলেন। মা হাতের লাকড়ি ফেলে দিয়ে আমাদের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো, খালেক ভাই চোরের উকিল কী না তা’ তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন। আমি তো বেঁচে গেলাম। কিন্তু বেচারা খালেক ভাইয়ের আট আনা পয়সা গচ্চা গেল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, শুধু এই ঘটনার কারণেই পরে আমি আর কোনদিন বাজারের পয়সা চুরি করার মত কুকর্মটি করিনি।
খালেক ভাইয়ের একটা দোষ ছিল। অসুখ হলে তিনি ওষুধ খেতে চাইতেন না। একবার তাঁর ডায়ারিয়া হলো। তখনকার দিনে ওরস্যালাইনের এত ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। মা ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ আনিয়ে দিলেন। বাজার থেকে ডাব আনা হলো। চিঁড়া ভিজিয়ে পাকা কলাসহ খালেক ভাইকে খেতে দেওয়া হলো। দুপুরে তাঁর জন্য আতপ চালের জাউ আর কাঁচা কলার ঝোল রান্না করা হলো। কিন্তু তিনি বিরামহীনভাবে বদনা হাতে ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যেবেলা নেতিয়ে পড়লেন। মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। আব্বা বাড়ি ফিরলে মা খালেক ভাইয়ের অবস্থা জানিয়ে বললেন, ‘কী করা যায় বলো তো! পরের ছেলে। কিছু একটা হয়ে গেলে তো কৈফিয়ত দেওয়ার মুখ থাকবে না।’
আব্বা খালেক ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। বড়ভাই আর আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো পালাক্রমে রাত জেগে খালেক ভাইয়ের সেবা যত্ন করার। হাসপাতালে তাঁর শিরায় এ্যান্টিবায়োটিক ও ঘুমের ওষুধ মেশানো স্যালাইন পুশ করা হলো। খালেক ভাই ঘুমিয়ে গেলেন। এদিকে তাঁর অজ্ঞাতসারে রাতে দু’তিনবার বেডের চাদর নষ্ট হয়ে গেল। সিস্টার রুমে দু’জন সিস্টার নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন। তাদের একজনকে ডেকে আনা হলে সে রূমাল দিয়ে নাক ঢেকে তড়িঘড়ি করে কেটে পড়লো। অগত্যা আমি আর বড়ভাই দু’জন মিলে ধরাধরি করে বেডের চাদর ও খালেক ভাইয়ের পরনের লুঙ্গি বদলে দিলাম। দুই ভাইয়ের সারারাত ঘুম হলো না।
পরদিন সকাল থেকে খালেক ভাইয়ের অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো। মা দুপুরবেলা তাঁর জন্য খাবার নিয়ে এলেন। আব্বা বিকেলে দেখতে এসে বললেন, ‘এই তো খালেকবাবু সুস্থ হয়ে গেছে। গুড!’
মা বললেন, ‘তোমার খালেকবাবু এত কষ্ট পেতো না, বুঝলে? সে কী করেছে জানো? কাল ডাক্তারখানা থেকে যে ওষুধগুলো আনা হয়েছিল, তার একটাও সে খায়নি। সব ওষুধ তার বালিশের নিচে চাপা দেওয়া ছিল। এই দেখো।’
মা কিছু ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল আব্বাকে দেখালেন। খালেক ভাই বোকার মতো হেসে বললেন, ‘চিঁড়া খেয়েছি,খালাম্মা।’
‘এই তো, ছেলে কত ভালো দেখেছো?’ আব্বা মাকে বললেন, ‘খালেকবাবু চিঁড়া খেয়েছে। চিঁড়া না খেলে কী সে এত তাড়াতাড়ি ভালো হয়?’ সমর্থন পেয়ে খালেক ভাইয়ের মুখে স্বস্তির হাসি। মা বললেন, ‘বোকা ছেলে কোথাকার! আচ্ছা, তুমি যে বি,এ ক্লাসে পড়ছো, পাশ করতে পারবে?’ খালেক ভাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁ।’
পরদিন সকালে খালেক ভাইকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। দুই রাত না ঘুমিয়ে আমরা দুই ভাই পেরেশান। তবু খালেক ভাই সেরে উঠেছেন দেখে ভালো লাগছিল। বাড়ি ফিরে আমরা দুই ভাই গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। দুপুরে ঘুম ভাঙ্গার পর আমার কানে এল, মা খালেক ভাইকে বলছেন, ‘তুমি গোসল করে খেয়ে নাও,বাবা। ওরা যখন ঘুম থেকে উঠবে,তখন খাবে। তোমার দুর্বল শরীর,শুধু শুধু বসে থেকো না। খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমাও।’
আমি তাকিয়ে দেখি, খালেক ভাই আমাদের দুই ভাইয়ের মাথার কাছে বসে আছেন। তাঁর হাতে দুটো ঝকঝকে নতুন ঝর্না কলম।
তিনি আজ নেই,আছে তাঁর স্মৃতি,ছোট ছোট সুখ দুখ
মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল
মানব প্রেমের শিক্ষা কে দিল?
ভাবলে আমার মনে পড়ে যায় দ্বিতীয় পিতার মুখ।
****************************