ধরুন, চাকরি করতে করতে কোন কারণে আপনার চাকরি চলে গেল (আল্লাহ না করুন), তখন আপনি কী করবেন? আর একটা চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করবেন অথবা ব্যবসা বানিজ্য করার চেষ্টা করবেন। এই তো? নিশ্চয় কোন খারাপ কাজ করে রোজগারের চেষ্টা করবেন না। কেউ কেউ যে এমন খারাপ কাজ করেন না, তা’ নয়। অভাব অনটনে পড়ে ফেরেশতার মতো মানুষকেও আমি শয়তান হয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধু আব্দুর রউফ এই তিনটি কাজের একটিও না করে তিরিশ বছর বহাল তবিয়তে ছিল। কীভাবে, শুনবেন?
শুনুন তাহলে! আব্দুর রউফ রোড এ্যান্ড হাইওয়েজের সাব এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিল। ঘুষ কেলেঙ্কারিতে তার চাকরি চলে যায়। সেটা খুব সম্ভবতঃ ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনামলের ঘটনা। আব্দুর রউফ তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে ওঠে। ব্যস্, চাকরি চলে যাওয়ার পর তাকে এই কষ্টটুকুই শুধু করতে হয়েছিল। বাঁকি জীবনে সে আর কিছুই করেনি।
শ্বশুর একই ডিপার্টমেন্টের রিটায়ার্ড এক্স এন। চাকরি জীবনে প্রচুর ঘুষ খেয়েছেন। শহরে পাঁচ তলা বাড়ি, ফ্ল্যাট, মার্কেট এসব করার পরেও তার টাকা শেষ হয় না। তিনি জামাইকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, মিলিটারি গভর্নমেন্ট চলে গেলে তিনি চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে ঘুষ দিয়ে আবার চাকরি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন। এমন সোনার ডিম পাড়া রাজহংসের মতো চাকরি এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না। কিন্তু মিলিটারি গভর্নমেন্ট চলে যাওয়ার আগে তিনি নিজেই পরপারে চলে গেলেন। ফলে আব্দুর রউফের চাকরি আর হলো না। সে তখন শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে আর খায়।
তার একটি মাত্র শ্যালক। সে আবার যাচ্ছে তাই প্রতিবন্ধী। সারাদিন তার মুখ থেকে লালা ঝরে। বাথরুমের দরজা খোলা রেখে সে বড় কাজ করে। বয়স বারো তের বছর হলেও সে ছোট কাজ আটকে রাখতে পারে না। যখন তখন কাপড় চোপড় ভিজিয়ে ফেলে। শাশুড়ি প্যারালাইসিসের রোগী। আব্দুর রউফের পোয়াবারো। সে শ্বশুরের মার্কেট ও বাড়িভাড়া এবং ব্যাংকে জমানো টাকা পয়সা তুলে রাজকীয় হালে খরচ করতে থাকে। শ্বশুর শাশুড়ির কিছু উড়ো আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে এসে ঝামেলা করে। আব্দুর রউফ স্ত্রীর সহযোগিতায় সেসব ঝামেলা পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে ফেলে দেয়। পোশাকের কিছু কিছু দাগ সহজে উঠতে চায় না। সেসব ক্ষেত্রে আব্দুর রউফ সনাতন ব্লিচিং পাউডার (অর্থাৎ, ঘুষ)–এর আশ্রয় নেয়। সে পুলিশকে ঘুষ দেয়। পুলিশ থানায় নিয়ে মার ধোর ও মামলার ভয় দেখানো থেরাপি প্রয়োগ করে। ফলে কঠিন দাগও পরিষ্কার হয়ে যায়।
আব্দুর রউফের শ্বশুর শাশুড়িকূলের আত্মীয়স্বজন গ্রামের লোক। তারা মামলা মোকদ্দমাকে যমের মতো ভয় করে। ‘ও হরি! ক্ষ্যামা দাও’-এই সাহস নিয়ে তারা আর শহরমুখো হওয়ার চেষ্টা করে না। তবে আব্দুর রউফের এক চাচাশ্বশুর ভীষণ টাউট। তার আবার বিদেশ যাওয়ার বাতিক। দীর্ঘ আট দশ বছর সে কাঁঠালের আঠার মতো আব্দুর রউফের পিছে লেগে রইল। আব্দুর রউফ নিজেও কম টাউট নয়। সে দুই লাখ টাকা খরচ করে ১৯৯৬ সালে চাচাশ্বশুরকে অবৈধ পথে সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দিল। সেখান থেকে ফিরে আসা এত সহজ নয়। ধরা পড়ে ব্যাটা সাইপ্রাসের জেলে পচে মরুক!
তিরাশি সাল থেকে দু’হাজার সাল পর্যন্ত মোটামুটি এভাবেই চললো। শ্বশুরের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল। বাড়ি ও মার্কেটের ভাড়া দিয়ে আব্দুর রউফের রাজকীয় খাই-খরচায় কিছু টানাটানি হয়। এক বোতল ভদকা বা স্কচের দামই তো তিন হাজার (নাকি পাঁচ হাজার?) টাকা। তার ওপর তার জুয়া খেলার নেশা। টানাটানি হবে না কেন,বলুন? সে একে একে মার্কেটের দোকান গুলো বিক্রি করে দিতে লাগলো। ২০০৫ সালের দিকে পুরো মার্কেট সাফা হয়ে গেল। আব্দুর রউফ দেনার দায়ে শ্বশুরের পাঁচ তলা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলো।
এ বছর জানুয়ারি মাসে আব্দুর রউফের সাথে আমার দেখা হলো। সে সময় তার সাথে আমার যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তা’ এরকমঃ
‘এখনো তো তোমার শ্বশুরের ফ্ল্যাটেই আছো, নাকি?’
‘আরে না! ওটা কবে বেঁচে দিয়েছি!’
‘তাহলে কী নওগাঁ চলে গেছ?’ (আব্দুর রউফের দেশের বাড়ি নওগাঁ)
‘আরে না! সেখানে কী বাড়িঘর কিছু আছে নাকি? দু’কাঠা জমি নিয়ে আমার চার ভাইবোন রোজ মারামারি করে। সেখানে কী যাওয়ার উপায় আছে?’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আবার কী? ভাড়া বাসায় আছি।’
‘বলো কী? তোমার এত টাকা পয়সা বিষয় সম্পত্তি উচ্ছন্নে গেল কীভাবে? তাস আর বোতল এখনো চলে নাকি?’
‘ছিঃ ছিঃ, কী যে বলো না! এই বুড়ো বয়সে ওসব পাপের কথা আর বলো না তো!’
‘তোমার ছেলেমেয়ে যেন কয়টা?’
‘দুই ছেলে, এক মেয়ে। আরে, ওই মেয়েটার জন্যেই তো আমি শেষ হয়ে গেলাম। মেয়ের বিয়ে দিয়ে এমন একটা জামাই পেয়েছে যে কী আর বলবো! কোন্ হাভাতে ঘরের পোলা, কে জানে? তাকে টাকা পয়সা দিতে দিতে আমি ফতুর হয়ে গেলাম।’
‘তা’ তোমার ছেলে দুটো এখন কী করে?’
‘বড়টা চাকরি করে, আর ছোটটা তো হেরোইন খেয়ে শেষ। এই হারামজাদা আমার আগেই ইন্নালিল্লাহ হবে।’
‘বলো কী? আহা! ছেলেটার এই দশা! তা’ তোমার বড় ছেলেটি কী চাকরি করে?’
‘ও চাকরির কথা আর বলো না। এত লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে বীমা কোম্পানিতে।’
‘ভালো তো।’
‘কীসের ভালো? নিজের বউ ছেলের মুখে ভাত দিতে পারে না। চাকরিতে এক পয়সা ঘুষ নাই। ফকিরের ভিক্ষার মতো শুধু বেতন দিয়ে কী সংসার চলে?’
ভেবে দেখুন, আব্দুর রউফের ছেলের ঘুষ নাই। কী মর্মান্তিক! ১৯৮৩ থেকে ২০১৩-মাত্র ত্রিশ বছরে গনেশ উল্টে গেছে।
*********************************************