গত ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে একটি নতুন রেকর্ড তৈরী হয়। সে দিন রিজার্ভ ১০.৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এটিকে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসাবে দাবী করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি আপতত: দৃষ্টিতে অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর মনে হলেও যে সকল কারণে এবারের রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটেছে তার মধ্যে আশঙ্কার উপাদানও রয়েছে প্রচুর।
প্রথমে দেখা যাক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রয়োজন কেন। প্রায় সকল ক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে ডলারে। আমরা যখন বিদেশ থেকে কোন কিছু আমদানী করি তার দাম ডলারে মেটাতে হয়। ফলে, দেশে পর্যাপ্ত ডলার মজুদ না থাকলে আমদানী বাধাগ্রস্থ হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডলার সরকারের কাছে বা বাংলাদেশ ব্যাংকে মজুদ থাকে না, থাকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে তার হিসাব থাকে। ফলে রিজার্ভ বৃদ্ধি মানে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, সরকারী কোষাগারের অর্থবৃদ্ধি নয়।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার ভালো রিজার্ভ প্রয়োজন হলেও তা অর্থনীতিকে কিভাবে প্রভাবিত করবে সেটি নির্ভর করে কিভাবে এই রিজার্ভ তৈরী হয় তার উপর। নিম্নলিখিত চারটি কারণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে পারে:
১. আমদানী হ্রাস:
আমদানী হ্রাস পাওয়া আপাতত: দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও আমাদের অর্থনীতির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ভালো ফল বয়ে আনে না। আমাদের আমদানী তালিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে বিলাস সামগ্রী থাকলেও, আমদানী ব্যয়ের সিংহভাগ চলে যায় মূলধনী বা বড়বড় যন্ত্রপাতির পিছনে। মূলধনী যন্ত্রপাতির সাথে দেশের শিল্পায়নের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। গার্মেন্টসের সেলাই মেশিন থেকে শুরু করে সিমেন্ট কারখানার বিশালাকার মেশিন পর্যন্ত সকল যন্ত্রপাতি এখনও বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। তাই, এই খাতে আমদানী হ্রাস পাওয়া শিল্পায়নের গতি ব্যহত হওয়ার চিত্রই প্রকাশ করে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই আশঙ্কাই করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত দলিল, 'সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৯' এ বলা হয়েছে,
"৪.৫.৩ আমদানী ব্যয় : উন্নয়নশীল কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা
২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট'০৯) আমদানী বাবদ মোট ব্যয় হয় ৩,৩০৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০.৪ শতাংশ কম।
২০০৯-১০ অর্থবছরের একই সময়ে মূলধন যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানী হ্রাস পেয়েছে যথাক্রমে ২২.৪ ও ২০.৮ শতাংশ।"
বোরো ধানের ফলন ভালো হওয়ায় চাল আমদানী কমে যাওয়াতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য হ্রাস পাওয়াতে এ খাতে আমদানী ব্যয় কমে গেছে, যা একটি ভালো সংবাদ।
২. রফতানী বৃদ্ধি:
রফতানী বৃদ্ধি হলে যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে তাই রিজার্ভ বাড়ে। এইভাবে রিজার্ভের বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য সবথেকে উপকারী, কেননা তা শিল্প ও অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতের উন্নয়নের কারণে ঘটে থাকে এবং এই খাতের উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। রফতানী বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা টাকা হিসাবে সরাসরি চলে যায় শিল্প এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগকারীদের হাতে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমান অর্থবছরে রফতানী বৃদ্ধি তো হয়ই নি, বরং অর্থনীতি ধ্বংসকারী কেয়ারটেকার সরকারের আমলের থেকেও তা কমে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত পুর্বোক্ত দলিলে তা স্বীকারও করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
"২০০৯-১০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পূর্ববর্তী অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় হ্রাস (ঋণাত্মক) পেয়েছে ১১.৯ শতাংশ। ২০০৬-০৯ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪২.৪ শতাংশ।"
৩. বৈদেশিক ঋণদাতা সংস্থার ঋণের অর্থ জমা:
বৈদেশিক ঋণদাতা সংস্থার ঋণের অর্থ সরাসরি ডলারে জমা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই ধরণের অর্থের কিছু জমা হয়, তবে তার পরিমাণ খুবই কম। এই অর্থ সাথে সাথে টাকায় রূপান্তরিত হয়ে বাজারে চলে যায় না, কিস্তিতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়। ফলে এই ধরণের রিজার্ভ অর্থনীতির জন্য উপকারী। তবে, এটি যেহেতু ঋণের অর্থ এবং সেই ঋণ যথাসময়ে শোধ দিতে হয়, ফলে ঋণের অর্থের অপচয় হলে বা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না হলে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মনে রাখা দরকার যে, এখনও পর্যন্ত আমাদের বৈদেশিক ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় উচ্চমূল্যের গাড়ী কেনা এবং সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে।
৪. প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশে অর্থ প্রেরণ:
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৬,৬৭৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়। রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি অর্থনীতির ধমনীতে সরাসরি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অর্থ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তবে রেমিটেন্সের অর্থ যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ।
ক. রেমিটেন্সের অর্থ অতি অল্প সময়ে বাজারে চলে আসছে এবং জনগণের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়াতে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে।
খ. রেমিটেন্সের অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে রিয়েল এস্টেট এবং বিলাস সামগ্রী ক্রয়ে। এর ফলে একদিকে যেমন গ্রামের কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি শহরে প্লট, ফ্লাট ইত্যাদিতে বিনিয়োগের ফলে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় অনুৎপাদনশীল খাতে আটকে যাচ্ছে। বিগত এক যুগে বাংলাদেশের সামর্থবান মধ্যবিত্ত তাদের সঞ্চয় জমি, ফ্লাট ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এটি একটি অনুৎপাদনশীল খাত। রাজধানীতে এক বিঘা জমির উপর ফ্লাটবাবদ ২০-৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এই অর্থে বড়জোর কিছু নির্মাণ শ্রমিকের কয়েক মাসের কর্মসংস্থান এবং ২-৩ জন দারোয়ানের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ, এই পরিমাণ অর্থ শিল্প বা অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হলে তা কয়েকশত মানুষের সারা জীবনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারতো এবং দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর দাড় করাতে সাহায্য করতো।
সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নয়, তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের উক্ত রিপোর্টটিতেই বলে দিচ্ছে। 'চায়না শপে ষাড়' এর মত কেয়ারটেকার সরকার অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত সকলকে সন্ত্রস্ত করে তুলে ইমার্জিং টাইগারের টুটি টিপে ধরার যে খেলা শুরু করেছিল, বর্তমান সরকার তার থেকে এখনও বের হতে পারেনি। এখনও পত্রিকার পাতা ভর্তি হয়ে থাকছে সরকারী দলের ক্যাডারদের দ্বারা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেয়া, বেপরোয়া চাঁদাবাজি, গোয়ালের গরু, পুকুরের মাছ থেকে শুরু করে দোকান, ফ্যক্টরী ইত্যাদি লুটপাটের খবর। সাথে রয়েছে সরকারের মামলা অভিযান। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মন্ত্রীদের অনভিজ্ঞতা, অপরিপক্কতা ও অযোগ্যতা। নির্বিচার দলীয়করণ ও ওএসডির মাধ্যমে থামিয়ে দেয়া হয়েছে জনপ্রশাসনের কাজের গতি। বেকারত্ব বাড়ছে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে, বাড়ছে শহরের ফুটপাথে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা। এই সবের পরেও অর্থনীতির সুস্বাস্থ্য নিয়ে সরকারের দাবী রসিকতা মনে হতে পারে। তবে, মাসে দুইবার প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ এবং জেলায় জেলায় সরকারদলীয় কিছু নেতার হঠাৎ গাড়ী-বাড়ীর মালিক হওয়াকে যদি অর্থনীতির সূচক ধরা হয় তাহলে স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১০ রাত ৯:০৪