মৃগয়া রাজ-রাজাদের অতি পুরাতন নেশা। রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যাসন, জাকজমক ছেড়ে তাঁরা শিকারের জন্য চলে যেতেন গহীন বনে। মৃগয়া নিয়ে অনেক বিখ্যাত কাহিনী রয়েছে। তাতে যেমন দেখা যায় তাড়িত হরিণছানার ভয়ার্ত চোখ দেখে রাজা সংসারত্যাগী দরবেশে পরিণত হয়েছেন, তেমনি আবার নানা রোমাঞ্চকর কাহিনীও পাওয়া যায়। পঞ্চপান্ডবের একজন অর্জুন গিয়েছিলেন মৃগয়ায়। গিয়ে শিকার করে আনলেন জলজ্যান্ত এক নারীকে। নাম দৌপ্রদী। বাড়ীর কাছে এসে বাইরে থেকে চিৎকার করে বললেন, মা দেখো তোমার জন্য কি এনেছি। মা বললেন, যা এনেছো, পাঁচ ভায়ে ভাগ করে নাও। মায়ের আদেশ বলে কথা, পাঁচ ভায়ে বিয়ে করলেন এক নারীকে।
প্রশ্ন জাগতে পারে রাজপ্রাসাদের আরাম আয়েশ ছেড়ে রাজারা কেন বনে যেতেন মৃগয়া করতে? হরিণের মাংস নাকি অতি সুস্বাদু। কিন্তু শুধুমাত্র মাংসের জন্য কি এতো কষ্ট করা রাজার মানায়? আসলে রাজারা মৃগয়ায় যেতেন শিকারকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার যে আনন্দ ও নেশা তার কারণেই।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখন রাজা বলে কিছু নেই। বরং রাজতন্ত্রকে পরিবারতন্ত্র বলে অনেক গালি-গালাজ করা হয়ে থাকে। এমনকি যারা কেবলমাত্র পিতা বা স্বামীর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন কিংবা নিজেদের পূত্র-কন্যা-ভগিনিদেরকে উত্তরসুরী বানাতে ব্যস্ত থাকেন, তারাও প্রতিপক্ষকে এই গালিটি দিতে ছাড়েন না।
আমাদের শাসকগোষ্ঠী যেমন পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারছেন না, তেমনি মৃগয়ার নেশাও তাদের কাটছে না। শিকারকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোর নেশা দিন দিন তাদের বেড়েই চলেছে। আগেকার রাজা-বাদশারা বনের পশু শিকার করতেন, এখনকার শাসকেরা অতো কষ্টের মধ্যে যেতে চান না, তাছাড়া বন্য প্রাণী শিকার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। তাই, তারা শিকারের জন্য বেছে নিয়েছেন নিজ দেশের মানুষকে, বিশেষ করে বিরোধী দলকে, কেননা বিরোধী দলের কাউকে মেরেও ফেললে সে মামলা আদালতের দরজা পার হতে পারবে না।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধী দল শিকারকেই তার প্রধান এজেন্ডা বানিয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী, যিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাকে তার বাসভবণ থেকে উৎখাত করতে হবে। বিরোধী দলের অফিস থেকেও চলে উৎখাতের চেষ্টা। একই শিকার নিয়ে বেশীদিন খেলার মধ্যে মজা পায় না শিকারী। তাই কিছুদিন পর পর শিকার পাল্টাতে হয়। বাড়ী থেকে উৎখাতের খেলার পর শাসককূল শুরু করলেন কবর থেকে লাশ উৎখাত এবং প্রতিষ্ঠান থেকে নাম উৎখাতের পর্ব।
তবে হরিণ শিকারের মত মজা যেমন অন্য শিকারে নেই, তেমনি জামায়াত-শিবিরের থেকে বেশী ভালো শিকার আমাদের রাজনীতিকদের জন্য পাওয়া যাবে না। বস্তুত: ছাত্র জীবন থেকে জামায়াত-শিবির শিকার করে তাদের চামড়া তুলে মাংস দিয়ে নাস্তা করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিকের। বাংলাদেশের খুব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে এ ধরণের শ্লোগান শোনা যায় না, ‘শিবিরের চামড়া, তুলে নেবো আমরা’, কিংবা ‘একটা দুটো শিবির ধরো, সকাল বিকাল নাম্তা করো।’ জামায়াত-শিবির শিকারের সুবিধা হলো, তাড়া করলে তারা মৃগের মত পালিয়ে যায় এবং তাদের চামড়া তুলে তা প্রতিবেশী দেশে পাচার করলেও তা নিয়ে কেউ কোন উচ্চবাচ্য করে না। বরং মেঘনাদ বদ করার পূণ্য ও বীরত্ব তাদের নসীবে জমা হয়। একজন জনপ্রিয় কলামিস্ট যথার্থই লিখেছিলেন, ‘ওরা মানুষ নয় শিবির।’
এদিকে বেশ কয়েক বছর আগে আবুল বারাকাত সাহেব গবেষণা করে বের করেছেন যে, তাদের মাংস হরিণের থেকেও সুস্বাদু, কারণ, তাদের নাকি রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। ভদ্রলোকের অংকজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই, কেননা দলটির যদি এক লক্ষ নেতা-কর্মী থাকে এবং প্রত্যেকের যদি গড়ে দশ লক্ষ টাকার সম্পদ থাকে তাহলে মোট সম্পদের পরিমাণ দাড়ায় দশ হাজার কোটি টাকা। ভদ্রলোকের হিসাব শুনে যে অনেকেই এতোদিন গোপে তেল দিয়েছেন তা এখন বোঝা যাচ্ছে। আইন প্রতিমন্ত্রী প্রতিদিন একবার করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের ব্যবসা-বাণিজ্য অচিরেই সরকার নিয়ে নিবে। অতীতেও আওয়ামী লীগের আমলে সরকার বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর নাটবল্টু পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা ভাগ বটোয়ারা করে নিয়েছেন। আগামী অধিগ্রহণের ভাগ কে কত পাবে, তা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী ল্যাপটপে (যেহেতু এখন সবকিছু ডিজিটাল) হিসাব নিকাশ করছেন।
এ সব বিবেচনা করেই সরকার জামায়াত-শিবির শিকারে নেমেছে। দুটি ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র মারা গেলো। তার জন্য সারা দেশব্যাপী চিরুনী অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যেখানেই জামায়াত-শিবিরের কাউকে পাওয়া গেলো, সেখানেই তাকে এই হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসাবে জেলে পোরা হলো এবং দলে দলে তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হলো। পুলিশ একজন ছাত্রনেতার শরীরে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করলো। এই ঘটনা শুনে একজন প্রতিবেশী ঠাট্টা করে বলেছিলেন, একজনকে মারতে যদি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মী মিলে প্লান প্রোগাম করে মাঠে নামতে হয়, তাহলে সেই দল নিষিদ্ধ করে দেওয়াই উত্তম। যেখানে একজন ছাত্র নেতা এক বছরে একশত ধর্ষণ করতে পারে, খেলাচ্ছলে নিজ দলের নেতা-কর্মীকে নির্বিকারে হত্যা করতে পারে, সেখানে এই ধরণের অকর্মন্য দল বড়ই বেমানান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে ধড়পাকড় করা হয়েছে, তাতে ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষেপনাত্রের অজুহাতে বুশের ইরাক দখলের কথা মনে পড়ে যায়।
এই মৃগয়ায় শাসককুলের আত্মবিশ্বাস ও শিকারের নেশা বেড়ে গেলো। যাবে না কেন, এতো বড় দল, তারা নাকি সীসাঢালা প্রাচীরের মত সংগঠিত। দলটির কর্মীরা নাকি জীবন দিতে রাজী কিন্তু পিছু হটে না। অথচ, একজন নারীর রেশম কোমল চুলের সামান্য চিরুনী, তার ধাক্কাতেই তারা চিৎ-পটাং।
নরমাংসের স্বাদ একবার পেলে বাঘ যেমন তার জন্য পাগল হয়ে যায়, শিকারের স্বাদ পেয়ে শাসককুলের তেমনি অবস্থা। একেক সময় এক এক নামে এক এক অযুহাতে তারা শিকারের পিছনে ছুটে চলেছে। অবশ্য তাদের তেমন ছুটতে হচ্ছে না; আগেকার জামানায় যেমন মৃগয়াতে ঢাক, ঢোল, কাসর বাজিয়ে বাদ্যদল শিকারকে তাড়া করে রাজার কাছে নিয়ে আসতো, এখন সেই দায়িত্ব নিয়েছে নানা রকমের মিডিয়া।
অনেকে ভাবতে পারেন, শাসক কুলের এই মৃগয়াতে আমাদের সাধারণ মানুষের মাথা ঘামিয়ে কি লাভ। মরলে বিএনপি-জামায়াত মরুক না। মৃগয়া শুধু বিএনপি-জামায়াতে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো তেমন কোন সমস্যা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী, তাঁর আত্মীয় স্বজন ও মন্ত্রীরা মিলে আর কত শিকার করবে। কিন্তু, সমস্যা বাধে রাজাদের অভ্যাস তাদের পাইক পেয়াদা সবার মধ্যেই দ্রুত সংক্রমিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন কর বিভাগকে নির্দেশ দিলেন, ‘বড়লোকদের আয় ব্যয় খতিয়ে দেখতে।’ মনে রাখা দরকার যে, কর বিভাগের লোকজনের আয় ব্যয় খতিয়ে দেখার কেই নেই এবং সকল স্বৈরশাসক বিরোধী পক্ষকে দমন করতে প্রথম যে হাতিয়ার ব্যবহার করেন তা হচ্ছে, আয়করের ফাইল। টিভিতে প্রধানমন্ত্রীকে যখন এই কথা বলতে শুনলাম, তখন কেয়ারটেকার সরকারের মৎস শিকারের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টার চেহারা আর হাসির কথা মনে পড়লো। তিনি বিশেষ এক ধরণের ক্রুর হাসি হেসে সাংবাদিকদের জানাতেন কখন তারা রাঘব বোয়াল শিকার করছেন আর কখন শোল-মাগুরের দিকে নযর দিচ্ছেন।
সপ্তাহ না ঘুরতেই আরেক মহারথী ঘোষণা করলেন, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে এগারটা পর্যন্ত এসি বন্ধ রাখতে হবে, নইলে তিন মাসের কারাদন্ড। অনুরোধ করতে পারতেন, উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন, কিন্তু একেবারে জেল-ফাঁসি ছাড়া শাসককুলের মুখে কথা নেই। অর্থমন্ত্রী বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললেন, সিএনজির দাম চারগুণ করতে হবে যাতে যে কেউ আর গাড়ী হাকাতে না পারে। এই কথা বলে তিনি সারা শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলেন। মানুষকে বিপদে ফেলে যে কত আনন্দ পাওয়া যায় তা আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের বডি ল্যাংগুয়েজ লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। তবে কথার চেয়ে কাজে অনেকেই এগিয়ে রয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রীতো ব্যাংকের এমডিকে ধরে আনতে গানম্যানই পাঠিয়ে দিলেন।
শুধু বিএনপি-জামায়াত বা সাধারণ পাবলিক যে মৃগয়ার লক্ষ্যবস্তু তা নয়, খোদ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাও একে অপরকে শিকারে ব্যস্ত। ইডেন কলেজের যে সকল ছাত্রীকে দিনের পর দিন মন্ত্রী ও নেতাদের কাছে দেহদানের জন্য পাঠানো হতো (এখনো হচ্ছে নিশ্চয়) তারা সকলেই ছাত্রলীগের কর্মী। কামরাঙ্গীর চরে আওয়ামী লীগ নেতা দিনে দুপুরে আগুন ধরিয়ে লুটপাট করলেন আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-কর্মীদের দোকান। টেন্ডার শিকার প্রায়ই স্বদলের মাথা শিকারে পরিণত হচ্ছে এবং প্রতিদিন সে খবরে ভর্তি হয়ে থাকছে পত্রিকার পাতা। মেয়েকে বিয়ে দিতে আপত্তি করার পিতা-মাতাকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিজ বাসায় সকলের সামনে হত্যা করা হচ্ছে, তিন বছরের শিশুও রক্ষা পাচ্ছে না তাদের পাশবিকতা থেকে।
এ অবস্থায় শিকারদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সুসময়ে যারা জোট বেঁধে ছিলেন, এখন তারা আলাদা আলাদা ভাবেই শিকারীর পেটে যাওয়ার অপেক্ষা করছেন। বিষয়টি বড়ই রহস্যময়। তাদের মনের খবর আল্লাহই ভালো জানেন। অনেকের ধারণা প্রধান বিরোধী দলটির সামনে এই মুলোটি হয়তো রয়েছে যে, তাদের বড় শরীক ধ্বংস হলে তাদের ভোটব্যাংক তো আর আওয়ামী লীগ পাবে না। শরীকের জমাজমির প্রতি লোভ কার না থাকে। তবে যারা ভোটের হিসাব কষে নির্বাচনের জন্য দিন গুনছে, তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছে যে, তিন-চতুরাংশ আসন পাবার পরও ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা রাখা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নেই। তাদের জন্য একটা পুরানো গল্প মনে করিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ দেখছি না।
এক লোক তার আখ ক্ষেতে গিয়ে দেখে তিনজন মিলে আয়েশ করে আখ খাচ্ছে। তাদের একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও একজন খ্রীষ্টান। তার এতো কষ্টের আখ খেয়ে সাবাড় করছে দেখে সে রেগে আগুন হয়ে গেলো। তার ইচ্ছে হলো লোকগুলোকে আখ দিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিতে। কিন্তু, তিনজনের সাথে একা সে পারবে না। তখন সে মুসলমান লোকটাকে বললো, আপনি আমার নিজের ধর্মের, আমার আখে তো আপনার হক রয়েছে, আপনি খেতেই পারেন। হিন্দুকে বললো, কত পুরুষ ধরে আমরা হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছি, আপনি আমার ক্ষেতের আখ খাওয়াতে বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু, ওই নাসারাটা কোন সাহসে আমার আখে হাত দেয়! দুইজনকে আলাদা করতে পেরেছে বুঝতে পেরে সে খ্রীষ্টানটাকে পেটানো শুরু করলো এবং পেটাতে পেটাতে গ্রামছাড়া দিল। এবার ধরলো হিন্দুকে। তাকে পিটিয়ে গ্রাম থেকে তাড়ানোর পর ধরলো মুসলমানকে। বললো, হারামজাদা, তুই আমার নিজের ধর্মের লোক হয়ে দল বল নিয়ে আমার সর্বনাশ করিস। শেষের লোকটা মার খেলো বরং অনেক বেশী, কেননা, তখন তাকে রক্ষা করার আর কেই ছিল না।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:৪৫