০১.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে এখন দেশজুড়ে চলছে চিরুনি অভিযান। এই অভিযানে শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা সবাই বিশেষ একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে কিন্তু গ্রেফতার হচ্ছে সারা দেশে। রাজশাহীর ঘটনায় দেশের সব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোমরে রশি বেধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সে ছবি ফলাও করে ছেপেছে সংবাদপত্র গুলো। যে ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। ৫৪ ধারায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে অর্থাৎ সন্দেহ জনক ভাবে। এদের হাতে কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ খুন হয়েছে? এরা কী টেন্ডারবাজ কিংবা ছিনতাইকারী ? এরা কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল করতে গিয়েছে? এরা কী ছাত্রীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে? না, কেউই এদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অনেনি। তাহলে গ্রেফতার করা হচ্ছে কেন? কারণ এরা ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মী। ছাত্র শিবির কী নিষিদ্ধ সংগঠন? না তাও না। তাহলে সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই ছাত্রদের কোমড়ে রশি লাগিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,প্রতিমন্ত্রী কিংবা আইজির উল্লাসের অর্থ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কোথায়? তিনি কি অতিশয় আনন্দিত তার শিক্ষা প্রতিষ্টানের ছাত্রদের কোমড়ে রশি বেধে ধরে নিয়ে যাওয়াতে? এতে তার মর্যাদা কী বেড়েছে? তার এই নীরবতার অর্থ হচ্ছে তিনি ছাত্র নির্যাতনের পুলিশী অভিযানকে সমর্থন করেন। কিন্তু ভিসি সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরবতার পরিনতি হবে ভয়ংকর। আমরা হয়েতো এমন দৃশ্যও দেখতে পারি ছাত্রদের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কিংবা শিক্ষকদেরও কোমড়ে রশি বেধে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু ছাত্ররা নীরব। কারন একজন শিক্ষক যখণ অন্যায়ভাবে ছাত্রদের গ্রেফতারে নীরব থাকবেন তখন ছাত্ররাও শিক্ষকদের ব্যাপারে সমব্যাথী হবেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। মঙ্গলবার শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত ১৬ ছাত্রকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে ভিসির বাসভবনে হামলার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় তাদের আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন ছাত্র আছে যে ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। পুলিশের দক্ষতা বটে! এই ছাত্ররা শাহবাগ থানা থেকে কিছু দূরে একটি মেসে থাকতেন। তাদের গ্রেফতার করতে দু বছর লাগলো কেন? পুলিশ কী নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। এ ঘটনা ছাত্রদের পুলিশি হয়রানির একটি নমুনা মাত্র।
নিরীহ ছাত্রদের যখন গ্রেফতার করা হচ্ছে তখন প্রকৃত অপরাধীদের আস্কারা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রী আর পুলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর মারা গেছেন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের হল দখলের প্রতিযোগিতায় কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চিরুনি অভিযান হয়নি। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুইগ্রুপের সংঘর্ষে একজন মারা গেছে কিন্তু সেখানেও চিরুনি অভিযান হয়নি। জানুয়ারী মাসে আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরিন সংঙাঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৪১টি। নিজেদের মধ্যে এই হনন প্রক্রিয়ায় মারা গেছে ৩ জন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে সংসদ সদস্যও উপস্থিতিতে এক অনুষ্টানে অসংখ্য ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ছাত্রীদের ওপর হামলে পড়েছিলো। অনেক ছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো ৭২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারীর রাতে শহীদ মিনারে। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা কত ছাত্রীর ইজ্জত হরন করেছিলো সে সময় সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে। যারা আবু বকরকে হত্যা করেছে তারা এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। ভিসির সাথে বৈঠক করেন। এদের অনেকে মন্ত্রীদের সাথে দেখা সাক্ষাত করেন। টেন্ডার বাজরা ভিসির সাথে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করেন। এরা মানুষ খুন করলেও খুবই ভালো ছাত্র। কারণ এরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা একটি কেন সাতটি খুন করলেও এরা অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হবেনা। কারণ এরা ছাত্রলীগ। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আমরা জানি আবু বকর কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কোনো ছাত্র সংগঠন এমন দাবিও করেনি। কিন্তু তার সহপাঠীরা ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আবু বকরের সহপাঠী বেশ কয়েক জন বন্ধু এখন হল ছাড়া। কারণ তারা কেন আবু বকরের হত্যার বিচার দাবি করেছিলেন। আবু বকর হত্যার নিন্দা জানিয়ে তৈরি করা একটি পোস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতে দেয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো মাত্রায় বাকশালি জামানা ফিরে এসেছে। অবস্থা এমন যে মার খেয়ে কাদাও যাবেনা। ছাত্রলীগ সাধারন ছাত্রকে মার দিলেও চিৎকার করে বলতে হবে জয়বাংলা। বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদের উৎকৃষ্ট উদহারন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যে স্থানকে আমরা বড় গলায় বলি মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র। আসুন জয়বাংলা বলে আমরা মুক্তবুদ্ধির জয়গান গাই।
০২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিল খেয়ে এখনও কিল হজম করতে চাইছে না। দুএকজন বেয়ারা ছাত্র প্রতিরোধ না করুক প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কিল খেয়ে কিল হজম করার কৌশল রপ্ত করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের টেন্ডারবাজি আর সেসব খবর প্রকাশ করা নিয়ে সাংবাদিকরা ছিলো তাদের প্রধান টার্গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকরা অনেকবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এমন কী সুশীল পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টারাও বাদ যাননি। গত বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি চারুকলা অনুষদে সংবাদ সংগ্রহকালে পাঁচ সাংবাদিককে নির্যাতনের শিকার হতে হয় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে। ইউএনবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জুয়েল সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তার ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ।
সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরন সাংবাদিকরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ৭ এপ্রিল দৈনিক দিনকাল পত্রিকার জাবি প্রতিনিধি পারভেজ সাজ্জাদকে হলের সামনে রড, লাঠি দিয়ে মারধর করে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রলীগ কর্মীকে এক মাসের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিছুদিন না যেতেই আবারও ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দৈনিক আমার দেশের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিকে মারপিট করে। স¤প্রতি কুষ্টিয়া সরকারি কলেছে ভর্তি বানিজ্যর খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন প্রথম আলো ও দেশ টিভির দুই সাংবাদিক।
কিল খেয়ে কিল হজম করার বড় উদহারন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক ছাত্র নিহত হওয়ার পরও সেখানে ছাত্রলীগের দুইগ্রুপে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সে খবর সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গেলে আহত হয় ১১ জন সাংবাদিক। গত ১১ ফেব্রুয়ারী এ ঘটনায় সাংবাদিককে লাঠিপেটা করে ছাত্রলীগ। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম যেসব সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা আহত হয়েছে সেসব পত্রিকায় খবরটি গুরত্বের সাথে ছাপা হয়নি। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলা হলেও সে টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে ছাত্রলীগের নাম নেয়া হয়নি। বলা হলেও দুবৃত্তরা ক্যামেরা ভেঙ্গে দিয়েছে। অনুগত সাংবাদিকতা বলে কথা! একই দিনে ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টের সংবাদদাতার বাসায় হামলা চালানো হয়। এর আগে পাবনা প্রেসক্লাবেও হামলা চালানো হয়। কিন্তু এসব খবর অনেক সংবাদপত্রে আসেনি। কারণ অধিকাংশ গনমাধ্যম এখন ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগি হিসাবে আর্বিভুত হয়েছে। মুসলিনীরও শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম ছিলো কারণ ফ্যাসিবাদ কায়েমের বড় হাতিয়ার হচ্ছে প্রচারযন্ত্র। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছাত্রলীগ যেমন প্রতিপক্ষের পাশাপাশি নিজেরা নিজেদেরই হনন করছে এক সময় এসব প্রচার যন্ত্রকেও তারাই হনন করবে। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের মাধ্যমে ৭২ সালে আমরা একবার তা প্রত্যক্ষ করছি। যতই অনুগত সাংবাদিকতার কৌশল নেয়া হোকনা কেন ফ্যাসিবাদের লাঠি সাংবাদিকদের পিঠে পড়বে।
[email protected]