বাঙালি সংস্কৃতি ও রেডিসন
আলফাজ আনাম
বাংলাদেশের মানুষ হারাম জ্ঞান করে শূকরের মাংস খায় না। এমনকি এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও শূকর খায় না। তারা খায় না এই প্রাণীর মাংস খাওয়া আদৌ নিরাপদ বা স্বাস্থ্যসম্মত হবে কি না সে প্রশ্ন থেকে। কারণ হিন্দু ধর্মে শূকর খাওয়া নিষেধ এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের দূতাবাসের আয়োজনে সে দেশের রানীর জন্মদিন উপলক্ষে রেডিসন হোটেলে এক অনুষ্ঠানে শূকরের মাংস নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। নয়া দিগন্তের খবরে বলা হয়েছে, এ অনুষ্ঠানে শূকরের মাংস থাকায় অনেকে না খেয়ে অনুষ্ঠান থেকে চলে আসেন। অনেকে বিব্রত বোধ করেন। সম্প্রতি মেক্সিকোসহ সমগ্র বিশ্বে সোয়াইন ফ্লু দেখা দিয়েছে। তার উৎসও শূকর বলে জানা গেছে। আর সে কারণে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কেউ না খেয়ে চলে এসেছেন কি না জানা যায়নি। রাজধানীতে আরো অনেক পাঁচতারা হোটেল আছে। সেখানেও দেশী-বিদেশী নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সেগুলোতে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে শূকরের মাংস খাবারের মেনুতে থাকে না। কিন্তু রেডিসন খুবই আধুনিক হোটেল, সেখানে শূকরের মাংস তো না থেকে চলে না। রেডিসন হোটেল কাদের টাকায় চলে এর আয়-ব্যয় কোথায় যায় সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নেদারল্যান্ড দূতাবাসের এ অনুষ্ঠানে শূকরের মাংসের মতো আরো এক কাণ্ড ঘটেছে, সে বিষয়টি সংবাদপত্রে আসেনি। সেটি নিয়েই আজকের এই লেখা।
নেদারল্যান্ড দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজন কূটনীতিক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানে যারা খাবার পরিবেশন করেন তাদের পরিধানে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কপালে তিলক। ঢোলের বাদ্যের সাথে অনুষ্ঠানে অতিথিদের স্বাগত জানান ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকজন। যদিও নেদারল্যান্ড দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ পোশাকে উপস্থিত ছিলেন না। আমন্ত্রিত অনেক অতিথি অবাক হয়েছেন এদের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি কেন? এ পোশাক তো নেদাল্যান্ড বা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ নয়। উৎসাহ চাপিয়ে রাখতে না পেরে একজন জানতে চান তোমাদের পরনে এই ড্রেস কেন? স্যার বৈশাখ মাস তো তাই বাঙালি ড্রেস পরেছি। এটাই নাকি আয়োজকরা চেয়েছেন। আর সেভাবে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাহ চমৎকার! বাংলাদেশের মানুষ কি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে? না পরে না। পোশাক হিসেবে ধুতি-পাঞ্জাবির বিরোধিতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যে-কেউ ইচ্ছা করলে এ পোশাক পরতে পারে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ধুতি পরে থাকেন। এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। মনে রাখতে হবে ধুতি-পাঞ্জাবি কোনো ধর্মীয় পোশাক নয়। ধুতি-পাঞ্জাবি হিন্দু ধর্মের কোনো প্রতীক নয়। খোদ ভারতে অনেক অঞ্চলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে না। এমনকি বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালে কেউ ধুতি পরে না। কাজেই এ পোশাক নিয়ে সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো পোশাক একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ।
নেদারল্যান্ড দূতাবাসের অনুষ্ঠানে ধুতি নিয়ে আপত্তি এখানেই। এই পোশাক এ দেশের মানুষের সংস্কৃতির অংশ নয়, তাদের কোনো প্রতীকও নয়। এটি কলকাতার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাবু সংস্কৃতির পোশাক। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু পশ্চিম বাংলার এই সংস্কৃতি তো এ দেশের মানুষের সংস্কৃতি নয়। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনো অনুষ্ঠানে ধুতি পরে না। তাহলে নেদারল্যান্ড দূতাবাসের এই অনুষ্ঠানে ধুতি আর তিলকের প্রয়োজন পড়ল কেন? সাদা চামড়ার এই বিদেশীরা কোন সংস্কৃতির সাথে আমাদের লীন করতে চান? যত দূর জানতে পেরেছি এ অনুষ্ঠানে বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তারা কেউ ধুতি পরে যাননি। এ দেশের মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে ধরনের পোশাক পরে যান সে ধরনের পোশাক পরে গিয়েছেন। বিদেশী দূতাবাসের বা বড় আকারের এ ধরনের পার্টিতে অনেক সময় কী ধরনের পোশাক পরতে হবে তারও উল্লেখ থাকে। নেদারল্যান্ড দূতাবাসের আমন্ত্রণপত্রেও পোশাকের বিষয়টি লেখা ছিল বলে জানা গেছে। তাতে ন্যাশনাল ড্রেস ও লাউঞ্জ স্যুট পরার কথা উল্লেখ ছিল। আমাদের জাতীয় পোশাক কি ধুতি-পাঞ্জাবি? তাহলে তারা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করল কেন? নেদারল্যান্ড দূতাবাসের কাছে একটি জিজ্ঞাসা তারা যাদের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তারা এ সমাজের শিক্ষিত সংস্কৃতিবান এবং প্রগতিমনস্ক মানুষ। তাদের কাছে পাঠানো আমন্ত্রণপত্রে যদি বলা হতো, এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য অবশ্যই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতে হবে, তাহলে কতজন এ অনুষ্ঠানে আসত? কতজন বাড়িতে ধুতি পরে? অবশ্য নেদারল্যান্ড দূতাবাস যদি সমাজের ওপরতলার এ লোকদের ধুতি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করতে চায় তাহলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য একটি ড্রেসিং রুম রাখতে পারে। সেখানে অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগে আমন্ত্রিতরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে পারেন। তারা এক সেট ধুতি-পাঞ্জাবি উপহারও দিতে পারে। আশা করি, নেদারল্যান্ড দূতাবাস ভবিষ্যতে এ ধরনের একটি আয়োজন করবে। আমরা নিশ্চিত নেদারল্যান্ড দূতাবাসের এ ধরনের পার্টিতে অংশ নেয়ার মতো লোকের অভাব হবে না। এতে দুটো কাজ হবে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির বিস্তারের পাশাপাশি এ দেশের পশ্চিমা দূতাবাসগুলোতে সমাজের ওপরতলার অনেকে শুধু ফ্রি মদ খাওয়ার জন্য যান তারা কতটা নিচে নামতে পারেন তা দেশবাসীও জানতে পারবে।
আমরা বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ করছি পশ্চিমা দূতাবাসের কর্মকর্তারা হঠাৎ করে কলকাতার ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। পয়লা বৈশাখের দিন রমনা বটমূলের আশপাশে বেশ কিছু বিদেশী দেখা গেছে, তাদের পরনে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। কিন্তু রমনা পার্কসহ পুরো এলাকায় এ দেশের হাজার হাজার মানুষের কাউকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে দেখা যায়নি। এ দেশের মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে এটা তাদের ভ্রান্তি নয় বরং পরিকল্পিত তৎপরতার অংশ। এপার বাংলা ওপার বাংলা এক হওয়ার এক অদ্ভুত চিন্তা তাদের মাথায় বাসা বেঁধেছে বলে মনে হচ্ছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে মৈত্রী ট্রেন চালু হওয়ার উদ্বোধনী দিনে। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে সহজ যোগাযোগ স্থাপন দরকার। তার প্রয়োজন কতখানি সেটি ঢাকা কিংবা নয়াদিল্লির ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখলাম রেলস্টেশনে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা বেহালা, ঢোল, তবলা নিয়ে নেচে-গেয়ে উৎসব করছেন। ঢাকা-কলকাতা ট্রেন চালু হলে যারা কলকাতায় চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনে যান তাদের খুশি হওয়ার কথা। বাণিজ্যিক কারণে ভারত লাভবান হবে, খুশিও হতে পারে। কিন্তু এরা খুশি কেন? এ কারণে কি মুসলিমপ্রধান এ দেশে ধুতি-পাঞ্জাবির ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিস্তার হবে? সেই উৎসবের মৈত্রী ট্রেন এখন বাংলাদেশকে লোকসান দিয়ে চালাতে হচ্ছে। বাংলাদেশকে লোকসান দিয়ে ভারতীয় স্বার্থরক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ যেন ভারতীয় সংস্কৃতি অর্থনীতি এমনকি নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। মাত্র ৩৮ বছর আগে রাজনৈতিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ আর চাপিয়ে দেয়া সাংস্কৃতিক নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এ দেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তা যেন তারা ভুলেই যাচ্ছে। ভারতের একটি প্রদেশের একটি শ্রেণীর সংস্কৃতির সাথে আমাদের একাকার হয়ে যেতে হবে এটাই যেন পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশের কাছে আকাঙ্ক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আচরণ দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের ধর্মীয় পরিচয় ভুলে গেছে, তাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ যেন ভুলে গেছে।
শূকরের মাংস আর ধুতি সংস্কৃতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে শুধু দোষ দিয়ে আমাদের লাভ নেই। এর বিস্তারের কাজটি আমরাই করছি। যে রেডিসন হোটেল এই সংস্কৃতির বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখছে তার মালিকানা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর। এর লাভ-লোকসানও তাদের। আমরা জানি না সশস্ত্র বাহিনীর বার্ষিক যে অনুষ্ঠান হয় তাতেও ধুতি-পাঞ্জাবি যুক্ত হবে কি না। আমরা এত দিন যে সেনাবাহিনী দেখে আসছি, সেই সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন হোটেলে এখন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির চর্চা হয়। সহজে শূকরের মাংস পাওয়া যায়। আরো অজানা কত কিছু যে পাওয়া যায় বা কত কিছু ঘটে তা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের জানার কথা নয়। তবে এ দেশের মানুষ, যাদের কষ্টের টাকায় সেনাবাহিনী চলে তারা এসব খবরে দারুণ বেদনাহত হবে। তারা কেউ শূকরের মাংস খায় না। তারা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে না। তাদের সন্তানরা ধুতি পরে মাথায় তিলক এঁকে ঢোল বাজিয়ে উৎসব করুক তাও চায় না। সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে এমন কাণ্ড তারা আশা করে না। আমরা যেন এ সেনাবাহিনীকে চিনতে পারছি না। দিল্লি থেকে ঘোড়া আসার সাথে সাথে যেন সব কিছু বদলে যাচ্ছে।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০০৯ বিকাল ৫:০৯