জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র তত্ত্ব : আলফাজ আনাম
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সরকারের নীতিনির্ধারণী নানা বিষয়ে এখন নিয়মিত বক্তব্য রাখছেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এ সরকারের আইনগত নানা দিক ছাড়াও সম্প্রতি সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদসহ নানা বিষয়ে তিনি সরকারের মতামতের পাশাপাশি তার নিজস্ব মতও তুলে ধরছেন। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বর্তমান মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল থেকে আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এগারোই জানুয়ারির পর যখন দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি সাহসের সাথে শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অপর দিকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত আইনজীবীরা সংস্কারপন্থÿীদের মতো বিপদের সময় আড়ালে চলে যান। এদের কেউ কেউ তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহলের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে আদালতপাড়ায় গুঞ্জন আছে। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তার এই আইনজীবীকে মূল্যায়ন করেছেন। এটি একটি ভালো দিক। যদিও তাকে মন্ত্রী করায় দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অসন্তোষও প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তবে আদালতপাড়ায় একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সুনাম আছে।
সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেসব বক্তব্য রাখছেন তাতে সরকারের মতের প্রতিফলন ঘটছে বলে ধরে নেয়া যায়। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ শীর্ষক এক কর্মশালায় কিছু মন্তব্য করেছেন তিনি। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে তার এই বক্তব্য এসেছে। তার এই বক্তব্য নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ সব বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে কী ধরনের চিন্তাভাবনা করছে, তার যেমন আন্দাজ পাওয়া যাবে, তেমনি আমাদের সংবিধানের মূল নীতিতে কোনো পরিবর্তনের চিন্তা আছে কি না, সে সম্পর্কে কিছু মন্তব্য এসেছে। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা মন্ত্রীর বক্তব্যগুলো আগে বোঝার চেষ্টা করি।
০১. তিনি বলেছেন, একশ্রেণীর কওমি মাদ্রাসা জঙ্গিবাদের প্রজননকেন্দ্র। ধর্মের নামে সন্ত্রাস রোধ করতে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। (প্রথম আলো, ২ এপ্রিল)
০২. কওমি মাদ্রাসায় ভালো হওয়ার কোনো শিক্ষা না দিয়ে সরাসরি বেহশতে যাওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। (যুগান্তর, ২ এপ্রিল
০৩. বাহাত্তরের সংবিধান থাকলে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সৃষ্টি হতো না। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাৎ করা হয়েছে। তারই ফলে দেশে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ দূর করতে হলে তিনি ধর্মীয় নেতাসহ সবার গঠনমূলক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত গেলে দেশে ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। (প্রথম আলো, ২ এপ্রিল)
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ শুধু আইনমন্ত্রী নন। একজন বিজ্ঞ আইনজীবী। আমরা ধরে নিই উকিল-মোক্তাররা সাধারণত যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কথা বলেন না। বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা সন্ত্রাসের প্রজননকেন্দ্র। এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়। দেশের কয়েকটি গণমাধ্যম এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু এসব প্রতিবেদনের বড় দুর্বলতা হলো, এখন পর্যন্ত আমরা প্রমাণ করতে পারছি না দেশের কোন কোন কওমি মাদ্র্রাসায় সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। কারা দিচ্ছে। দেশজুড়ে র্যাব-পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী বা জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে, কিন্তু সুস্পষ্টভাবে কোনো কওমি মাদ্রাসাকে আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না। যাদের জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে গ্রেফতার বা শাস্তি দেয়া হয়েছে তাদের কতজন কওমি মাদ্রাসার ছাত্র সে ধরনের তথ্য কেউ প্রকাশ করছে না। এমনকি আইনমন্ত্রীও না। আমরা জানি, বাংলাভাইয়ের মতো জঙ্গি নেতাও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র ছিলেন। শায়খ রহমানও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন না। তাহলে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে এই প্রচারণা কেন?
কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত গরিব ছাত্ররা পড়াশোনা করে। মন্ত্রীরা কি বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখেছেন কিভাবে এ মাদ্রাসাগুলো চলে? কারা এসবের আর্থিক সহায়তা দেন। ঢাকার একটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কারা তাদের আর্থিক সহায়তা দেন? তিনি অবাক করা তথ্য দিলেন, ঈদ বা সবেবরাতের মতো বিভিন্ন ধর্মীয় দিনে দানখয়রাতের বড় টাকা আসে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার কাছ থেকে। অন্য রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তাদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কই বরং বেশি ভালো।
এখানে বলে রাখা দরকার, কওমি মাদ্রাসা নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার আগে কিন্তু বিদেশী গণমাধ্যমে এ প্রচারণা শুরু হয়। চারদলীয় জোট সরকারের প্রথম দিকে ২০০২ সালের এপ্রিলে হংকংভিত্তিক ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় বার্টিল লিন্টনার ‘বাংলাদেশ এ কুকন অব টেরর’ শিরোনামে প্রথম প্রচারণা শুরু হয়েছিল। তখনো শায়খ রহমান বাংলাভাইদের জঙ্গি রূপ শুরু হয়নি। শীতনিদ্রায় থাকা জোট সরকার আন্তর্জাতিক এ প্রচারণার মর্ম বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও এ ধরনের প্রচারণার নেপথ্যে যে ভয়ঙ্কর খেলা রয়েছে, তা এ পত্রিকাটির সাবেক সম্পাদক ফিলিপ বাউরিং তার এক লেখায় প্রকাশ করেছিলেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সে সময় মালয়েশিয়াতেও বাংলাদেশের মতো সন্ত্রাসের প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছিলো। আমরা দেখলাম পরে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউসহ পশ্চিমা কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রচারণার সুর দেশের গণমাধ্যমে ঝড় তোলা শুরু করল। এখন আমরা আইনমন্ত্রীর মুখে একই কথা শুনছি। কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষায় যদি সমস্যা থাকে তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। যদি জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ঘাটতি থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কওমি মাদ্রাসার কেউ তো কখনো বলেনি আমরা ইংরেজি, অঙ্ক বা বিজ্ঞান পড়ব না। বরং অনেক কওমি মাদ্রাসায় কম্পিউটার শিক্ষাও দেয়া হয়। ছাত্ররা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। সে খবর হয়তো মন্ত্রী মহোদয়রা জানেন না। আইনমন্ত্রী বলেছেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনতে হবে। ভালো কথা। কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কওমি মাদ্রাসায় সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর ছাত্ররা পড়াশোনা করে। সেসব মাদ্রাসায় তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সে ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় শিক্ষায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কারণ কে কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করবে, কতটুকু করবে তাতে হস্তক্ষেপ করা সরকারের দায়িত্ব নয়। সেটি একজন ছাত্রের অধিকার। কেউ যদি কুরআন, হাদিস বা দর্শনের ওপর পড়াশোনা করতে চায় নিশ্চয় সরকার তাতে বাধা হতে পারে না?
০২.
আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, কওমি মাদ্রাসায় ভালো হওয়ার আরো কোনো শিক্ষা না দিয়ে সরাসরি বেহশতে যাওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। তিনি আরো বলেছেন, অন্যের জমি দখল যে খারাপ কাজ এ কথাটি এসব মাদ্রাসায় বলা হয় না। আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য চরম অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আইনমন্ত্রী নিশ্চয় শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে যান। তিনি যদি দু’টি শুক্রবার ঢাকায় নামাজ না পড়ে কোনো গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়েন তাহলে কওমি মাদ্রাসায় পড়া কোনো ইমামের খুতবা শুনতে পাবেন। কোনো ইমাম কখনো কারো জমি দখল করাকে উৎসাহিত করেন কি না, তা তিনি নিজে জানতে পারেন? কোনো মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষক কতজনের জমি দখল করেছে? দেশে যে অপরাধ হয় তাতে মাদ্রাসার ছাত্রের হার কত? সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে একজন ছাত্রকে কারা খুন করেছে? তারা কি কেউ মাদ্রাসায় পড়েছে? আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি নিহত ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র নেতা আগেই ডাকাতি মামলার আসামি ছিলেন। আইনমন্ত্রী জানেন, কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সন্ত্রাসের ফলে আজ একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আইনমন্ত্রী কি বলবেন ডাকাতি, ছিনতাই বা সম্পদের জন্য কাউকে খুন করেছে এমন অভিযোগে গত ১০ বা ১৫ বছরে কোনো মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম গ্রেফতার হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজে হত্যাকাণ্ড কী সন্ত্রাস বা জঙ্গিপনা নয়?
ইসলামের ধর্মবিশ্বাসের সাথে পারলৌকিক দিকের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। যারা ইসলামে বিশ্বাস করেন তারা বেহেশতে বিশ্বাস করেন। বেহশতে যাওয়ার জন্য ভালো গুণাবলির কথা বলা হয়েছে। সে কথা যদি মাদ্রাসার শিক্ষকরা বলে থাকেন তাতে কি অন্যায় হয়েছে? মাদ্রাসাগুলোতে কিভাবে সরাসরি বেহশতে যাওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে তা পরিষ্কার নয়। কেউ যদি বেহশতে বিশ্বাস না করেন সেটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনো কওমি মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষক বেহেশতে বিশ্বাস না করার কারণে বা যেতে না চাওয়ার কারণে হামলা করেছে এমন খবর তো আমাদের জানা নেই। মন্ত্রী কিভাবে এমন অন্ধ ধারণা নিয়ে কওমি মাদ্রাসার সংস্কার আনতে চান? যদি তিনি শিক্ষায় নতুন কোনো বিষয় যোগ বা আধুনিকায়ন করতে চান তাহলে তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে। খুঁটিনাটি দিকগুলো জানতে হবে। আমরা লক্ষ করছি, মন্ত্রীরা মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কথা বলেন আবার সরকার সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা মাদ্রাসা পড়া শিক্ষার্থীরা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারে সে জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। এভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মানসিকতা থেকে কওমি মাদ্রাসায় কী পরিবর্তন আনতে চান তিনি? নাকি তিনি ওয়ার অন টেররের ক্ষেত্র হিসেবে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোকে বেছে নিতে চান, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
০৩.
আইনমন্ত্রী বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধান থাকলে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সৃষ্টি হতো না। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাৎ করা হয়েছে। তারই ফলে দেশে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধানের ভালো দিকগুলো রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই ধ্বংস করেছেন চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, যাতে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একদলীয় শাসন চালু করা হয়েছিল। আইনমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে সংবিধানের মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংযোজনের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন।
সংবিধানে ১৯৭৯ সালে এ পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তার পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত তো দেশে জঙ্গি ছিল না। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পরও তো কোনো জঙ্গির উত্থান ঘটেনি। কোথাও কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ’৭৪ সাল পর্যন্ত দেশে বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী সে সময় নিহত হয়েছেন। তখন তো সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, তাহলে কেন এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল? সেগুলো তো কোনো মাদ্রাসার ছাত্র ঘটায়নি। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাই যদি জঙ্গিবাদের রক্ষাকবচ হয় তাহলে ভারতের চিত্র কিন্তু ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা রয়েছে। কিন্তু ভারতের বাস্তবতা কী? গুজরাটে কত মুসলমানকে মারা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে? উড়িষ্যায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা কেমন ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করছে? কেন ধর্মনিরপেক্ষ দেশে খ্রিষ্টান যাজকদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের রক্ষা করা যায় না? ইরাক ও আফগানিস্তানে যারা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের জঙ্গি বলা হচ্ছে। জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের মধ্য দিয়ে। মন্ত্রী নিজেও এটা হয়তো উপলদ্ধি করেন, কিন্তু সাহস করে বলতে পারেন না।
মন্ত্রী এক দিকে ধর্মীয় নেতাদের গঠনমূলক ভূমিকা রাখার কথা বলছেন, অপর দিকে কেন সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লেখা হলো তার বিরোধিতা করছেন। ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে সে নিশ্চয়তা কোথা থেকে পেলেন? তাহলে কি ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্যই জঙ্গিবাদের জন্ম হয়েছে? জঙ্গিবাদের ওপর ভর করে কি ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বা বিশ্বাস’ এ শব্দাবলি সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হবে? প্রতিস্থাপন করা হবে ধর্মনিরপেক্ষতা? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে।
মন্ত্রী বলেছেন, ’৭২-এর সংবিধান থাকলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকত না। রাজনৈতিক দল থাকা-না থাকার ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্ত যদি সরকার নিতে চায় তাহলে চতুর্থ সংশোধনীর একদলীয় শাসন কায়েমের সুরই আমরা যেন আইনমন্ত্রীর কথায় শুনতে পাচ্ছি। আর যদি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় তাহলে ভারতে বিজেপি রাজনীতি করে কী করে? কিংবা কংগ্রেসের সহযোগী হিসেবে জমিয়তে উলামায় ইসলাম কিভাবে রাজনীতি করে? মন্ত্রীর কথায় জঙ্গিবাদকে পুঁজি করে দুই ধরনের বিপদের ধরন আমরা দেখছি। প্রথমত, মাদ্রাসাগুলোকে ঘিরে ওয়ার অন টেররের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং ’৭৩-এর নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র হত্যার রাজনীতি আবার ফিরিয়ে আনা। আমরা কি আবার পেছনে ফিরে যাবো? তাহলে দেশের মানুষ যে গণতন্ত্র, অগ্রযাত্রা, সুশাসন, ডিজিটাল বাংলাদেশ চেয়েছিল এসবের কী হবে?
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:০৭