দীর্ঘ এক দশকের সোভিয়েত যুদ্ধে আফগান মুজাহেদিনরা মার্কিন ও পাকিস্তানি,ইসরায়েলি সামরিক সহায়তা ও সৌদি আরব আমিরাত,কুয়েত ,মিশরের আর্থিক সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মিকে পরাজিত করে। সিআইএ, আইএসআই যৌথ ভাবে দীর্ঘ দশ বছর আফগান মুজাহেদিন ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে বহিরাগত যোদ্ধাদের পবিত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষন দিয়েছে। পরবর্তিতে আফগান মার্কিন নীতি পাকিস্তানের হাতে শঁপে দিয়ে পশ্চিমা ও মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ঐ অঞ্চলের কথা ভুলে গেলে আফগানিস্তান এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ি গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে ও সমগ্র আফগানিস্তান চলে যায় স্থানী যুদ্ধবাজ গোত্র নেতাদের অধীনে ।অভিভাবক হীন আফগানিস্তানে আঞ্চলিক শক্তি সৌদি,তুরস্ক,ইরান,উবেজিস্তান,পাকিস্তানের মধ্যে আফগানিস্তানের প্রভাব বিস্তার নিয়ে তীব্র দ্বন্দ ও কৌশলগত মিত্রতার খেলা তখন চলছে।
সোভিয়েত শাষনাধীনে থাকা কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তি সদ্য স্বাধীন মুসলিম অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলো তাদের বিপুল জ্বালানী সম্পদ পুজিবাদি বিশ্বের হাতে পৌছে দিতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে বহির্বিশ্বে পৌছানোর একমাত্র জানালা মস্কো ছিলো বিধায় তাদের সমস্ত জ্বালানী অবকাঠামো মস্কো মুখি। এখন প্রয়োজন নতুন পাইপ লাইন। পশ্চিমা জ্বালানী সম্রাটরা ভাবতে ব্যাস্ত ঐসব দেশের মধ্যযুগিয় স্বৈরশাষকদের ম্যানেজ করে ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আর মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যারেল তেলক্ষেত্রের জ্বালানী সম্পদ কিভাবে ভোক্তার কাছে পৌছানো যায়।বিশাল সম্পদ তুলে আনতে দরকার পাইপ লাইন শুধু সঠিক পাইপ লাইন...ট্রান্স আফগান পাইপ লাইন। তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে পাকিস্তানের কোয়েটা হয়ে করাচী বন্দর,সেখান থেকে লাহোর পাঞ্জাবের উপর দিয়ে দিল্লী, সুরাট, মহারাস্ট্র, গুজরাটের শিল্প নগরীগুলোতে যাবে এই গ্যাস। বিপুল জ্বালানী চীন ও রাশিয়ার হাত এড়িয়ে সোজা মার্কিনী ও পশ্চিমাদের হাতে আসবে ঐ পাইপ লাইনের ফলে। দরকার বিশাল সামরিক ঘাঁটি মধ্য এশিয়ায় যাতে কাস্পিয়ান সাগরের সম্পদে ভাগ বসানো যায় নিরাপদে।
বর্তমান তালেবানঃ বর্তমান তালেবান কোন এক কেন্দ্রীক সংঠন নয়। এক আদর্শিক ম্যানিফেস্টো থাকা সত্যেও এরা মুলত ৩ টি প্রধান ভাগে বিভক্ত
১। কান্দাহার তালেবান বা আদি তালেবান বা আফগান তালেবান।
২। হাক্কানী পরিবার পরিচালিত পাখতিয়া তালেবান। (হাক্কানী নেটওয়ার্ক)
৩। তেহেরিক ই তালেবান বা সালাফিবাদ প্রভাবিত পাকিস্তানী তালেবান ।
আদর্শঃ সুন্নি ইসলাম,দেওবন্দি।
তালেবানের উত্থান যেভাবেঃ আফগানিস্তানে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তালেবানের উত্থান চলচিত্রের কাহিনীকে হার মানায়।
১ দশকের সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধ ও আফগান গৃহযুদ্ধ মিলিয়ে ১৫ বছর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ আঁচ পাওয়া পাকিস্তান তখন সামাজিক ,অর্থনৈতিক সমস্যায় ধুঁকতে থাকা একদেশ। দশ বছর ধরে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশগুলোতে অবস্থা করা পশতুন রিফিউজি তখন এক চরম সংকটের নাম। উগ্র ইসলাম ভিত্তিক দল জামাত ই উলেমা ই ইসলাম সহ কয়েকটি কট্টরপন্থী ইসলামি দলের সাহায্য নিয়ে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বারের মত পাকিস্তানের মসনদে বেনজীর ভুট্টো ও পিপিপি। তার সামনে সমস্যার পাহাড় আর দ্রব্যমুল্যের সংকট নিয়ে দাঁড়ানো পাকিস্তান। ঐ সময় আইএসআই’র হাতে পরিচালিত হচ্ছে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের আফগান নীতি। আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে পাকিস্তান সমর্থিত গুলবদ্দিন হেকমতিয়ার পরাজয়ের মুখে ।
(কাস্পিয়ান সাগর তীর থেকে সদ্য স্বাধীন দেশগুলো তখনকার পাইল লাইনের অবস্থান)
ঐতিহ্যগত ভাবে পিপিপি ও ভুট্টো পরিবারের সাথে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সম্পর্ক ভালো নয়। দ্রব্যমুল্যের চরম উর্ধগতির কারনে শুরু থেকেই জনরোষে পড়া বেনজীর সরকারের ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার আগেই তখন উৎখাত হওয়ার আশংকায় ভীত ছিলেন। এমন এক অবস্থায় পাকিস্তানের অর্থনীতি রক্ষায় বেনজির ভুট্টো মধ্য এশিয়ার সদ্য স্বাধীন দেশগুলিতে পাকিস্তানী পন্য রপ্তানির বাজার তৈরির উদ্যোগ নেন। তাছাড়া যুগের পর যুগ শোষনের ফলে বালুচিস্তানের সুই গ্যাস ফিন্ডের সস্তা গ্যাস প্রায় শেষ হবার পথে থাকায় সে সময় আর্জেন্টাইন তেল কোম্পানী বিরদাস ও পাকিস্তান মিলে তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনে গ্যাস পাকিস্তান পর্যন্ত আনার পরিকল্পনা করে। তবে তুর্কমেনিস্তানের সাথে চুক্তিতে এগিয়ে থাকায় মার্কিন ইউনিকল সুযোগ খুজছে ঐ পাইপ লাইন পরিকল্পনা হস্তগত করার। পাকিস্তানে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা যেই বিরদাস বা ইউনিকল যেই সফল হোক পরিকল্পনার পাকিস্তানী পার্টের অংশীদার আফিস আলী জারদারি। তবে সমস্ত বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আগে দরকার মোটামুটি স্থিতিশীল একক ক্ষমতার অধিনে একটি আফগানিস্তান।
এদিকে সদ্য স্বাধীন মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলতে পন্য রপ্তানির মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে মরিয়া পাকিস্তান ঝুকি নিয়েই মধ্য এশিয়ায় পন্য রপ্তানীর সিদ্ধান্ত নেয়। এরজন্য প্রথমে পাকিস্তানিরা তারা তাদের পশতু বংশভুত স্বরাস্ত্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবরের মাধ্যমে আইএসআইর সহায়তায় মধ্য এশিয়ায় স্থল পথে পন্য পরিবহনে নিরাপত্তার জন্য হেরাতে যুদ্ধবাজ নেতা ইসমায়েল খা ও উত্তরের মাজার ই শরিফে আব্দুর রশিদ দোস্তানের সাথে সমঝোতায় আসলেও কান্দাহারের যুদ্ধবাজ গোত্র নেতাদের সাথে স্থানীয় অন্তর্দ্বন্দের কারণে কোন ভাবেই সমঝোতা করতে পারছিলো না। এ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানী পন্যবাহী বিশাল ট্রাক কনভয় সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের চমন কান্দাহার হেরাত মাজার ই শরীফ রুট হয়ে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর দিকে যাত্রা শুরু করলো। কিন্তু কান্দাহারের কাছে পৌছলে কনভয় স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতাদের হাতে শতশত কোটি টাকার পন্যর চালান নিয়ে আটক হয়।দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বেনজির সরকারের তখন আইএসআই’র সহায়তা নেয়া ছাড়া কোন পথ খোলা থাকলো না ।
পাক সমর্থিত গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারের বাহিনীর ক্ষমতা না থাকায় পাক স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানে কর্মরত আইএসআই কর্নেল সুলতান ইমামের সাহায্য চাইলে আইএসআই ঐ সময় কান্দাহারের এক মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রাক্তন মুজাহেদিন ও সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে এক চোখ হারানো মোল্লা ওমরের নেতৃত্তে কান্দাহার মাদ্রাসার ছাত্রদের সহায়তায় পাকিস্তানী মাল বোঝাই কনভয় উদ্ধার করেন। পরবর্তি ঘটনা শুধুই রোমাঞ্চকর ইতিহাস। মোল্লা ওমর কান্দাহারের একটি মসজিদের রক্ষিত ইসলামের নবী পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ এর একটি জামা(কথিত) হাতে দুলিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্রদের সমগ্র কান্দাহারে অরাজকতা অবসানের লড়াইয়ে ডাক দেন । ঐ দিন সুর্যাস্তের আগেই কান্দাহারের গভর্নরকে ধর্ষনের অভিযোগে তারই বাহিনীর ট্যাংকের ব্যারেলে ঝুলিয়া ফাসি দেয়ার মাধ্যমে সমগ্র কান্দাহার মাদ্রাসার ছাত্রদের দখলে চলে আসলো। পরের কয়েক দিন এই সংবাদ জামাত ই উলেমা ই ইসলাম পরিচালিত পেশোয়ারের মাদ্রাসা ও রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে পৌছতে থাকলে সীমান্তের অপর পারের জাতি ভাইদের সাফল্যে উল্লসিত কয়েক হাজার পশতুন বংশভুত মাদ্রাসার ছাত্র সীমান্ত অতিক্রম করে কান্দাহারে মোল্লা ওমরের দলে যোগ দিলো। জন্ম হলো “তালেবান” নামের হিংস্র মধ্যযুগীয় মোল্লা তন্ত্রের।মোল্লা ওমর উপাধি গ্রহন করলেন “আমিরুল মোমেনিন” ।
রিফিউজি ক্যাম্পের সামরিক ট্রেনিং ও সীমান্তের অপর পাড়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকায় খুব দ্রুতই মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত তালেবান অদম্য হয়ে উঠলো। আইএসআই’র একটি দেশ দখলের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হলো। অবশ্য কান্দাহার দখলে মাদ্রাসার ছাত্রদের সাথে কয়েক হাজার পশতুভাষী পাক আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জার সদস্য অংশ নিয়েছিলো বলে অভিযোগ থাকলেও আইএসআই তা অস্বীকার করে। কিছুদিন পরে ইউনিকলের কুট চালের কাছে তুর্কমেনিস্তানে আর্জেন্টাইন তেল কোম্পানী “বিরদাস” হেরে গিয়ে বিদায় নিলে ট্রান্স আফগান পাইপ লাইন ট্যাপ এর দায়িত্ব নিলো মার্কিন ইউনিকল। যার অন্যতম গুরুত্বপুর্ন উপদেস্টা ছিলেন মিঃ হেনরী কিসিঞ্জার ও বর্তমান আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজায়ি।
(বামিয়ানের হাজার বছরের পুরানো বুদ্ধ মুর্তি ধংস করছে তালেবান )
(মেয়েদের স্কুলে তালেবানের এসিড হামায় দগ্ধ স্কুলছাত্রী মেয়ে শিশু।)
তালেবানরা সৌদি ,পাকিস্তান, আরব আমিরাতের অর্থ ,অস্ত্র, স্বীকৃতি আর প্রকাশ্য সমর্থন এবং মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের মৌন সম্মতিতে আফগানিস্তানের প্রতিদিন একের পর এক এলাকা দখলে নিতে থাকা তালেবানরা হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে কায়েম হলো ইসলামিক রিপাব্লিক অফ আফগানিস্তান বা তালেবানিস্তান।ব্রিটিশদের প্রায় ১০০ বছর পর মধ্য এশিয়ার আবারো শুরু হলো নতুন গ্রেট গেম।একবিংশ শতাব্দীর গ্রেট গেম।এবারের গ্রেট গেম জ্বালানী সম্পদের গ্রেট গেম । ধর্মান্ধ মৌলবাদি তালেবানরা শুধু ঘুটির একটি বোড়ে মাত্র। পশ্চিমা ফুয়েল টাইকুনরা সহজলভ্য জ্বালানীর আশায় যেকোন স্থানে যেকোন সময়ে যে কাউকে যে কারো বিরুদ্ধে ব্যাবহার করতে পারে। বাংলাদেশ ও বঙ্গপোসাগর এর বাইরে নয়।কাজেই উন্মাদ ধর্মান্ধদের থেকে সাবধান না হলে বাংলাদেশের লেজও পুড়বে নিশ্চিত ভাবেই।
তথ্যসুত্রঃ
Taleban Islam Oil and new great game iin Central Asia.
-Ahmed Rashid
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ইতিকথা
-ব্রিগেঃজেঃ অব শাখাওয়াত হোসেন। (ইলেকশন কমিশনার)
(পরের পর্ব পাকিস্তানী তালেবান)