একবার ভাবুন তো চিড়িয়াখানার পশুর মতো খাঁচায় বন্দী আপনারই মতো কতগুলো মানুষ। আবার এদেরকে টিকিট কেটে যারা দেখতে যাচ্ছে এরাও কতগুলো রক্ত-মাংসের মানুষ। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ঘটনা অবান্তর নয়। সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীতে একসময় মানুষের চিড়িয়াখানা ছিল। আমাদের স্বাভাবিক ধারণায় চিড়িয়াখানায় কেবল পশুপাখি, জন্তু-জানোয়ার থাকে। এদের প্রদর্শনী হয়। কিন্তু রক্ত-মাংসের জ্যান্ত মানুষের প্রদর্শনী? আঠারোশ শতকের দিকে ইউরোপ-আমেরিকার বড় শহরগুলোতে সাদা চামড়ার অভিজাত মানুষের তীব্র জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে কালো মানুষরা পরিণত হয়েছিল প্রদর্শনীর বস্তুতে। মানব চিড়িয়াখানার সেই অজানা গল্প নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন।
কোথাও কোথাও প্রদর্শনীর সময় এদের জলচর প্রাণীর মতো বুক সমান পানির ভিতর রাখা হতো। আর সেখানে বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফালাফি করতে বাধ্য করা হতো এদের। কিছু কিছু প্রদর্শনীতে তাদের নগ্ন হয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো। এখনো সেসব ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। নগ্ন এ ছবিগুলো ছাপার অযোগ্য।
মানব চিড়িয়াখানায় যেসব মানুষকে প্রদর্শন করা হতো তারাও মানুষ ছিল। তাহলে কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই ঘৃণ্য কাজ? সম্ভব হয়েছিল সাদা চামড়ার মানুষের প্রভুত্ব আর কালো চামড়ার মানুষের নিষ্পেষিত হওয়ার সরল সমীকরণের কারণে। শ্রেণিবৈষম্যের চূড়ান্ত শিকার সেই কালো চামড়ার মানুষের অনেককেই জোরপূর্বক আটকে রাখা হতো। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ধার কেউ ধারত না। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে কিংবা আপত্তি করলে তার ভাগ্যে নেমে আসত নির্মম নির্যাতন। এসব বন্দীকে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অপহরণ করে তুলে আনা হতো। আর এ ভয়ঙ্কর কাজটির সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ই সাদা চামড়ার অভিজাত মানুষেরা যুক্ত থাকত।
কেউ কেউ আবার মজুরির বিনিময়ে প্রদর্শনীতে অংশ নিতে রাজি হতো। তবে যথারীতি সেই মজুরির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অধিকাংশ সময়ই এসব মানুষের সঙ্গে খুব নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো। ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না। থাকার ব্যবস্থাও সেরকম ভালো ছিল না। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এদের দাবিয়ে রাখা। আর একজন মানুষকে যত বেশি কিম্ভূত-কিমাকার দেখা যাবে প্রদর্শনীর কাটতি ততই বাড়বে। ফলে বন্দীদের আলাদা খাতিরদারি করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করতেন না মানব চিড়িয়াখানার মালিক কিংবা উদ্যোক্তারা। ফলে প্রদর্শনীতে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ত কালো মানুষগুলো। অনাহার-অনিদ্রা আর রোগ-শোকে অধিকাংশ কালো মানুষই বছরখানেকের ভিতর মারা যেতেন। তখন আবার নতুন কাউকে তুলে এনে কিংবা ভাড়ায় এনে শূন্যস্থান পূরণ করা হতো। প্রদর্শনীতে কালো মানুষদের বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করা হতো। কোথাও কোথাও প্রদর্শনীর সময় তাদের জলচর প্রাণীর মতো বুক সমান পানির ভিতর রাখা হতো। আর সেখানে বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফালাফি করতে বাধ্য করা হতো তাদের। কিছু কিছু প্রদর্শনীতে তাদের নগ্ন হয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো। এখনো সেসব ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। নগ্ন এই ছবিগুলো ছাপার অযোগ্য।
বিশেষ করে কালো চামড়ার নারীদের প্রদর্শনীতে নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হতো। এসব প্রদর্শনী কিংবা চিড়িয়াখানাগুলোতে দর্শনার্থীর সংখ্যাও নেহাত কম হতো না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ১৯৩১ সালে পার্সিয়ান আন্তর্জাতিক মানব চিড়িয়াখানার এক প্রদর্শনীতে ৬ মাসে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন লোকের সমাগম ঘটে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এসব দর্শনার্থীর প্রায় প্রত্যেকেই কালো মানুষের সঙ্গে পশুতুল্য আচরণ করত। বর্তমান সময়ে আমরা চিড়িয়াখানায় গেলে বানর কিংবা হনুমানের খাঁচার সামনে গিয়ে যেমনটা করি, ঠিক তেমনটাই। মানব চিড়িয়াখানার এ ধারণাটি অভিনব এবং দর্শনার্থীদের বিপুল চাহিদার কারণে এটি দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর ব্যবসায়ের একটি উত্তম উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।